১২:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আমার প্রাণের বর্ণমালা

১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বাংলা প্রচলন কমিটি’ নামে একটা সংগঠন গঠন করা হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। একটি প্রচারপত্রের মাধ্যমে দোকানপাটসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৯৬৬ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারির মধ্যে গাড়ির নম্বর প্লেট, বাড়ির নামফলক ও নম্বর এবং দোকান-অফিসের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার আবেদন করা হয়। রথখোলার মোড় থেকে ইসলামপুর, লক্ষ্মীবাজার ও বাংলাবাজার পর্যন্ত সব দোকান ও অফিসের সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলা প্রচলন কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন সুধীর কুমার হাজরা ও শামসুল আলম হাসু। এরপর ১৯৬৬ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশব্যাপী বাংলা প্রচলন সপ্তাহ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেদিন ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল হক বাকী ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বিচারপতি ইব্রাহিম সাহেব বলেছিলেন, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন, সরকারি দপ্তরে বাংলা চালু এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত না করলে বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করা হয়। এ অবহেলার ফলে বাংলার মানুষ স্বাধীনতার দাবি করতে বাধ্য হবে। ছাত্রলীগের কর্মী-সংগঠকরা গাড়ির নম্বর প্লেট, বাড়ির নামফলক ও নম্বর, দোকানের সাইনবোর্ড এবং অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহারের জন্য প্রতিদিন মিটিং-মিছিলসহ গিয়ে সদরঘাট থেকে নবাবপুর পর্যন্ত সব দোকানপাট-অফিস-আদালতের সাইনবোর্ড পরিবর্তনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের পরবর্তী কর্মতৎপরতা, প্রচার-প্রচারণা এবং সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের অভিযানের সুফল অচিরেই পাওয়া যেতে শুরু করে। ইনভেলপের ওপর বাংলায় ঠিকানা লিখতে সচরাচর পোস্ট অফিসের পরিবর্তে ডাকঘর লেখা, ইনভেলপকে খাম বলা, হাউস নম্বরের পরিবর্তে বাড়ি নম্বর লেখা, রোড নম্বরকে সড়ক নম্বর লেখা, স্যার/জনাব ইত্যাদির পরিবর্তে মহোদয়/সুধী লেখা, ক্লাসরুমকে শ্রেণিকক্ষ লেখা, রোল নম্বরকে ক্রমিক মান লেখা এরকম দৈনন্দিন ব্যবহার্য বাংলা শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রীতিমতো জোয়ার দেখা দেয়। দোকানের সাইনবোর্ডগুলোয় বাংলা ব্যবহারে রীতিমতো প্রতিযোগিতাই শুরু হয়ে যায় এবং তখনকার দিনের ক্ষুদ্র পরিসরের নতুন ঢাকার একেকটি সড়ক তো ঊনসত্তরের পর রীতিমতো হয়ে ওঠে বাংলাপাড়া। সড়কের দোকানগুলোর সাইনবোর্ড লিখতে যেন রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দের শরণাপন্ন হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়ে যায়। যেমন ময়ূরাক্ষী, নয়নতারা, বনলতা, ধানসিঁড়ি, কনক, সোনারতরী, ময়ূরী, আঁকাবাঁকা এ ধরনের রীতিমতো সব দুঃসাহসী নামকরণের প্রতিযোগিতা সে সময়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ‘নিউ এলিফ্যান্ট রোড’ বা ‘ল্যাবরেটরি রোড’-এর নামও কেউ কেউ বাংলা করে ‘হাতি সড়ক’ বা ‘গবেষণাগার সড়ক’ লিখতে শুরু করেন। বলাকা ভবনের নিচতলার বইয়ের দোকানগুলোও এখন উঠে গেছে। নিউমার্কেটের দুর্লভ বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকা বিক্রির দোকান নলেজ হোম এখন চামড়াজাত সামগ্রীর বিক্রয়কেন্দ্র। একসময় নলেজ হোমে ১৯৬৮-৬৯ সালে বিক্রি হতো দু’আনা দামের বিখ্যাত এক্সারসাইজ খাতা, যার মলাটে ছোট্ট করে লাল অক্ষরে লেখা থাকত নেতাজির সেই আগুন ধরানো উক্তি ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দেব।’

ট্যাগ :

আমার প্রাণের বর্ণমালা

প্রকাশিত : ১২:০১:৫৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১

১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বাংলা প্রচলন কমিটি’ নামে একটা সংগঠন গঠন করা হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। একটি প্রচারপত্রের মাধ্যমে দোকানপাটসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৯৬৬ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারির মধ্যে গাড়ির নম্বর প্লেট, বাড়ির নামফলক ও নম্বর এবং দোকান-অফিসের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার আবেদন করা হয়। রথখোলার মোড় থেকে ইসলামপুর, লক্ষ্মীবাজার ও বাংলাবাজার পর্যন্ত সব দোকান ও অফিসের সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলা প্রচলন কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন সুধীর কুমার হাজরা ও শামসুল আলম হাসু। এরপর ১৯৬৬ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেশব্যাপী বাংলা প্রচলন সপ্তাহ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেদিন ছাত্রলীগ সভাপতি মাজহারুল হক বাকী ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে বিচারপতি ইব্রাহিম সাহেব বলেছিলেন, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন, সরকারি দপ্তরে বাংলা চালু এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত না করলে বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করা হয়। এ অবহেলার ফলে বাংলার মানুষ স্বাধীনতার দাবি করতে বাধ্য হবে। ছাত্রলীগের কর্মী-সংগঠকরা গাড়ির নম্বর প্লেট, বাড়ির নামফলক ও নম্বর, দোকানের সাইনবোর্ড এবং অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহারের জন্য প্রতিদিন মিটিং-মিছিলসহ গিয়ে সদরঘাট থেকে নবাবপুর পর্যন্ত সব দোকানপাট-অফিস-আদালতের সাইনবোর্ড পরিবর্তনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের পরবর্তী কর্মতৎপরতা, প্রচার-প্রচারণা এবং সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের অভিযানের সুফল অচিরেই পাওয়া যেতে শুরু করে। ইনভেলপের ওপর বাংলায় ঠিকানা লিখতে সচরাচর পোস্ট অফিসের পরিবর্তে ডাকঘর লেখা, ইনভেলপকে খাম বলা, হাউস নম্বরের পরিবর্তে বাড়ি নম্বর লেখা, রোড নম্বরকে সড়ক নম্বর লেখা, স্যার/জনাব ইত্যাদির পরিবর্তে মহোদয়/সুধী লেখা, ক্লাসরুমকে শ্রেণিকক্ষ লেখা, রোল নম্বরকে ক্রমিক মান লেখা এরকম দৈনন্দিন ব্যবহার্য বাংলা শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রীতিমতো জোয়ার দেখা দেয়। দোকানের সাইনবোর্ডগুলোয় বাংলা ব্যবহারে রীতিমতো প্রতিযোগিতাই শুরু হয়ে যায় এবং তখনকার দিনের ক্ষুদ্র পরিসরের নতুন ঢাকার একেকটি সড়ক তো ঊনসত্তরের পর রীতিমতো হয়ে ওঠে বাংলাপাড়া। সড়কের দোকানগুলোর সাইনবোর্ড লিখতে যেন রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দের শরণাপন্ন হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়ে যায়। যেমন ময়ূরাক্ষী, নয়নতারা, বনলতা, ধানসিঁড়ি, কনক, সোনারতরী, ময়ূরী, আঁকাবাঁকা এ ধরনের রীতিমতো সব দুঃসাহসী নামকরণের প্রতিযোগিতা সে সময়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ‘নিউ এলিফ্যান্ট রোড’ বা ‘ল্যাবরেটরি রোড’-এর নামও কেউ কেউ বাংলা করে ‘হাতি সড়ক’ বা ‘গবেষণাগার সড়ক’ লিখতে শুরু করেন। বলাকা ভবনের নিচতলার বইয়ের দোকানগুলোও এখন উঠে গেছে। নিউমার্কেটের দুর্লভ বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকা বিক্রির দোকান নলেজ হোম এখন চামড়াজাত সামগ্রীর বিক্রয়কেন্দ্র। একসময় নলেজ হোমে ১৯৬৮-৬৯ সালে বিক্রি হতো দু’আনা দামের বিখ্যাত এক্সারসাইজ খাতা, যার মলাটে ছোট্ট করে লাল অক্ষরে লেখা থাকত নেতাজির সেই আগুন ধরানো উক্তি ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা এনে দেব।’