নারীদের নিয়ে মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে ভেঙ্গে দিতে চান একজন ভিক্ষুণী। তিনি মঠে আর সমাজে তাদের ভূমিকার পরিবর্তন আনতে চান। এজন্য বিপুল বাধাও তাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে।
মিয়ানমারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কথা সবাই জানেন। কিন্তু দেশটিতে ৬০ হাজার ভিক্ষুণী আছে সে কথা কজনই বা জানেন। পুরষতান্ত্রিক সমাজে সেখানেও তারা বঞ্চনার শিকার হন। নানা ধরনের নির্যাতনের মধ্যে পড়েন। এই সব বিষয় নিয়েই উচ্চকিত ৪০ বছর বয়সী ভিক্ষুণী কেতুমালা।
তিনি বলেন, একজন পুরুষ ভিক্ষু যখন সন্ন্যাস যাপন শুরু করেন, মানুষ তখন তার প্রশংসা করে। ধর্মের জন্য তা ভাল বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু একজন ভিক্ষুণী যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তখন সবাই মনে করে তার কোন সমস্যা আছে।
দরিদ্র্য, বয়স্ক, অসুস্থ, তালাকপ্রাপ্ত কিংবা যারা অসহায় তারাই সাধারণত এই জীবন বেছে নেন বলে প্রচলিত ধারণা। যা ভেঙ্গে দিচ্ছেন কেতুমালা। বাগ্মীতা আর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে এরিমধ্যে তিনি সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ধম্ম স্কুল ফাউন্ডেশন। দেশজুড়ে শিশুদের জন্য এই সংস্থাটির চার হাজার ৮০০ টি বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে।
তারপরও ভিক্ষুণীদের অবহেলা আর অশ্রদ্ধা চোখে দেখা হয় বলে আপশোস তার। বৌদ্ধ মঠে তারা যথাযথ সম্মান পান না। আবার বাইরে সাধারণ মানুষের কাছেও লাঞ্ছনার শিকার হন। এমনকি রাস্তাঘাটেও তাদেরকে হয়রানি করা হয়ে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এই পরিস্থিতি বদলাতে চান কেতুমালা। আর সে কারণেই মিয়ানমারে ভিক্ষুণীদের জন্য স্বীকৃতি ও সম্মান আদায়ে লড়ে যাচ্ছেন তিনি।
অবশ্য শুধু ধর্মীয় অঙ্গনেই নয়, মিয়ানমারে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীদের অধিকার ও অংশগ্রহণের ঘাটতি রয়েছে। যেমন দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি অং সান সুচি। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নারীদের হার মাত্র সাড়ে দশভাগ। যদিও নভেম্বরের নির্বাচনের পর তা কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুরুষতান্ত্রিক ধারণা এখনও ভীষণ প্রকট মিয়ানমারের পরিবার থেকে শুরু করে সমাজে। নারীরা সহিংসতার শিকার যেমন হচ্ছেন তেমনি আছে নানা কুসংস্কারও। যেমন, পরিবারে নারীদের কাপড়ের সঙ্গে পুরুষের কাপড় একসঙ্গে ধোয়া এখনও নেতিবাচক চোখে দেখা হয়। এর ফলে পুরুষরা তাদের পুরুষত্ব হারাবেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
অনেকে বৌদ্ধ স্থাপনা ও মন্দিরে নারীদের প্রবেশ নিষেধ। আবার পুরষ ভিক্ষুদের সামনেও তাদের বসা নিষিদ্ধ। সেগুলোর পরিবর্তন কেতুমালার একার পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, ভিক্ষুণীদের বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত ভিক্ষুরাই নিয়ে থাকেন, বলেন তিনি।
এমনকি ধম্ম স্কুল ফাউন্ডেশনের যখন যাত্রা শুরু হয় তখনও তিনি কারো সহযোগিতা পাননি। কারণ উদ্যোগটি যতই ভালো হোক একজন ভিক্ষুণীর পরিকল্পনার পেছনে ভিক্ষুরা দাড়াতে চান না। এমনকি সেটি চালুর পর তাকে নির্বাহী পদে থাকতে দেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার সমস্ত দায়িত্বই ভিক্ষুরাই নিয়ে নেন।
জীবনের শুরুতে অবশ্য ধর্ম নিয়ে অতটা আগ্রহ ছিল না কেতুমালার। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের দর্শন পড়ে পরবর্তীতে তিনি মুগ্ধ হন। বস্তুগত সাফল্যের চেয়ে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাই বড় অর্জন বলে উপলব্ধি করেন তিনি। তবে ভিক্ষুণী হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবারও। বৌদ্ধ শাস্ত্রে দুইটি ডিগ্রি নিয়ে পরবর্তীতে নিজের ইচ্ছা পূরণ করেন কেতুমালা।
মিয়ানমারসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়বৌদ্ধদের ধর্মীয় প্রথার কারণে মঠে ভিক্ষুদের সমান অধিকার পাওয়া যে নারীদের পক্ষে সম্ভব নয় সেটি এখন স্বীকার করেন তিনি। তবে মিয়ানমারের কয়েক হাজার ধর্মীয় নারীর জীবনে পরিবর্তন আনতে চান তিনি, যাতে নিজেদের সামর্থ্যকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারেন তারা। ভিক্ষুণীদের ক্ষমতায়নের জন্য তিনি ২০১৬ সালে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেন। নেতৃত্ব এবং ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে ভিক্ষুণীদের দীক্ষা দিতে আলাদা একটি সংগঠন গড়ে তোলারও পরিকল্পনা রয়েছে তার।
কেতুমালা বিশ্বাস করেন নারীদেরকে প্রান্তিক অবস্থান থেকে তুলে আনতে হলে শত্রু তৈরি করে লাভ নেই। বরং সমাজ কিংবা মঠের মধ্য থেকেই বন্ধু খুঁজে নিয়ে পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে। তিনি যোগ করেন, প্রতিক্রিয়াশীলরা সবখানেই আছে। আর তাই পরিস্থিতি নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার খুব বেশি সুযোগ আপনাকে দিবে না।
বিজনেস বাংলাদেশ/এসএম
																			
																		

























