০২:২১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকি ও ভোগান্তির দিনকাল

২৪ জানুয়ারী, বেলা ৩টা, মেষ-বৃষ্টির বালাই নেই, ছোট্ট একটি কক্ষের মেঝেতে ৩টি বিছানা, বইখাতা সাটানো ছোট আকৃতির ২টি পড়ার টেবিল, ২টি প্লাষ্টিকের চেয়ার আছে সেখানে থালা-বাটি-গ্লাস রাখা। কক্ষটির মাঝখান বরাবর একটি দড়ি টাঙানো, এলোমেলো অগোছালো কাপড়-চোপর ঝুলছে, কক্ষের মাঝখানে একটি প্লাষ্টিকের বালতি রাখা, সেখানে উপর থেকে পানির ফোটা পড়ছে টপ টপ শব্দে, মাথার উপর ছাদে (সিলিংএ) ফ্যানের বদলে ঝোলানো কালো রংয়ের পলিথিন। সেখান থেকেই পানি ঝরছে অবিরাম। অন্য একটি কক্ষের সিলিং সবুজ রংয়ের শ্যাওলায় আচ্ছাদিত সেখানে ঝুলন্ত ফ্যানটি না থাকলে ঠাহর করার জো নেই এটা ওই কক্ষের সিলিং অথবা অন্য কিছু। অন্য একটি কক্ষের সিলিংএর অধিকাংশ খসে পড়েছে অনেক আগেই, মরিচায় অধিকাংশ ক্ষয়ে যাওয়া কয়েকটি রডের অস্তিত্ব দেখা যায়। ভিতরের এমন জীর্ণদর্শা ভবনটির বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। কক্ষগুলির মধ্যে কেউ বা বসে পড়ছে, কেউবা দুপুরের খাবার খেয়ে আয়েসী ঘুমের চেষ্টায়। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ঠিক পিছনটায় মাত্র বছর বিশেক পূর্বে চিকিৎসকদের আবাসন হিসেবে নির্মিত হয়েছিলো দ্বিতল বিশিষ্ট এই ভবনটি। বসবাস অযোগ্য ও পরিত্যক্ত হওয়ায় অনেক আগেই সেটি ত্যাগ করেন চিকিৎসকরা। সেখানেই অগত্যা আবাসনের ঠাঁই হয়েছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ৫ম বা শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের। যেখানে হঠাৎ কোন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ প্রবেশ করলে প্রান ভয়ে আঁৎকে উঠবেন অথবা দৌড়ে পালাবেন।

সেখানে ৫ম বর্ষের ‘শাহিদ আলম নামের এক শিক্ষার্থী গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন, ‘আর মাত্র কয়েকটা দিন, পরীক্ষা দিবো রেড়িয়ে যাবো, ব্যাস, এতোদিন যখন মরিনি, যত ঝুঁকিপূর্ন জায়গাতেই থাকি না কেন আল্লাহ সহায় থাকলে এ-কটা দিনও কেটে যাবে। দেখুন এটা কোন সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় যে, শিক্ষার্থীরা তাদের স্বত:সিদ্ধ ন্যুনতম ন্যায় সংগত মোলিক অধিকার নিয়ে কথা বলার সুযোগ আছে। এখানে শিক্ষকরা যেভাবে রাখবেন সেভাবেই থাকতে বাধ্য; তা নাহলে হয় ফেল নতুবা মার্কস কম; সিনিয়র এক বড়ভায়ের নির্মম ভোগান্তির উদাহরন দিয়ে বলছিলেন এই শিক্ষার্থী। সেকারণে সবকিছু জেনেও সবই সইতে হয় নিরবে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে প্রাণ রসায়নে ভর্তি বাতিল করে পরের বছর মেডিকেলে চান্স পেয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেলে ভর্তি হন নাটোরের মেয়ে অনিতা বিশ^াস। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বুক ভরা রঙিন স্বপ্ন নিয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এখানেও একটা সুন্দর ক্যম্পাস পাবো। কিন্তু প্রথম দিনেই ক্যাম্পাসে এসে রহিমা-আফসার ছাত্রী হোষ্টেলে ঢোকার পর আমার সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। প্রথম বছরটা কেটেছে আক্ষেপে। এখানে একাডেমিক কার্যক্রমসহ আবাসনস্থলে চরম ভোগান্তির মধ্যদিয়ে আমরা ৫টি বছর শেষ করলাম। অস্বাস্থ্যকর ঝুঁকিপূর্ণ আবাসনে নেই পানীয় জল, সৌচাগার, স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা, দেয়ালে নেই পলেস্তার, ছাদের পলেস্তার খসে পড়ায় আহত হচ্ছেন সহপাঠী শিক্ষার্থী। দুর্ভোগ আমাদের নিত্য সঙ্গী। বলতে পারেন এখন সব গা সওয়া হয়ে গেছে। দু:খের কথা বলি- আমার মা দেখা করতে এসেও আমার কক্ষে নিয়ে যেতে পারিনি। লজ্জায় ক্ষোভে ডুকরে কেঁদেছি নিরবে। আমি চাই এমন মানবেতর ও ঝুঁকিপূর্ন জীবনের অবসান হোক আমাদের পরবর্তী জুনিয়র শিক্ষার্থীদের জন্য। অবিলম্বে তারা ফিরে যাক তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে।
২০১১ সালে পরিত্যাক্ত জড়াজীর্ণ অবকাঠামো নিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের যাত্রা শুরু কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের। সর্বশেষ ৯ম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। ইতোমধ্যে শিক্ষা শেষে ৪টি ব্যাস বেড়িয়ে যোগদান করেছেন স্বাস্থ্য সেবাই। এখানকার শিক্ষার্থীরা প্রিয় ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক স্বপ্ন ও আকাঙ্খা নিয়ে ভর্তির পর সীমাহিন দুর্ভোগ, নিকৃষ্টতম মানবেতর ও চরম ঝুঁকিপূর্ন জীবন-যাপন করছেন বলে অভিযোগ তাদের। ফিকে হয়ে গেছে তাদের ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক রঙিন স্বপ্ন। আশ^াসের বানী শুনে আসছেন ভর্তির পর থেকে। এমন অবর্ননীয় ভোগান্তিমুক্ত শিক্ষা মনোরম পূর্নাঙ্গ মেডিকেল ক্যাম্পাসে ফিরতে চান শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের পূর্নাঙ্গ ক্যাম্পাসে ফেরানোর দাবি জেলাবাসীর। সরেজমিন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বললে তারা এসব চিত্র তুলে ধরেন।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্প শুরুতে ছাত্রাবাস ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ছয় তলা ভিত্তির ওপর ছয় তলা ভবন নির্মাণে পুরো প্যাকেজের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল আট কোটি সাত লাখ টাকা। এরমধ্যে শুধু ভবন নির্মাণ ব্যয় ছিল সাত কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কিন্তু ছয় তলা ভিত্তির উপর চার তলা ভবন নির্মাণেই চুক্তি হয় ৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকার। এছাড়া আরও এক কোটি ১১ লাখ টাকার বর্ধিত অননুমোদিত ব্যয় দেখানো হয়। এ ভবনটির ভিত্তি ১০ হাজার ৫৪৫ বর্গফুট করার কথা।
একই ভাবে ছয় তলা ভিত্তির উপর ছয় তলার ছাত্রী হল নির্মাণে বরাদ্দ ছিল আট কোটি সাত লাখ টাকা যার অনুমোদিত ব্যয় ছিল সাত কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কিন্তু চার তলার ভবন নির্মাণেই চুক্তি হয় সাত কোটি ৮৬ লাখ টাকার। এই ভবনটি ১০ হাজার ৫৪৫ বর্গফুট ভিত্তি বিশিষ্ট করার কথা।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরেই প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরে আরো দুই দফায় দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ শেষ না হওয়ায় আর বাড়ানো হয়নি। ২০১৬ সালে সেপ্টেম্বরে এসংক্রান্ত আইএমইডির এই প্রতিবেদন জমার পর পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় প্রকল্পটির মেয়াদ নতুন করে আর না বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কুষ্টিয়া জেলার সাধারন সম্পাদক আজগর আলী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘নির্মানাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল প্রকল্পের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দূর্নীতি তদন্তের নির্দেশ দেয়ায় কুষ্টিয়াবাসীর পক্ষ থেকে একনেক সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। তবে যাদের কারনে প্রকল্পটি বার বার মুখ থুবরে পড়ছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচার দাবি করি এবং দ্রুততম সময়ে নির্মাণ শেষ করে মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার দবি করি। তারা যাতে যথার্থ শিক্ষা মনোরম পরিবেশে ফিরে যেতে পারে’।
কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ওইসব ভবন অনেক আগেই বসবাস ও ব্যবহার অযোগ্য ঘোষনা করা হয়েছে। সেখানে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা কিভাবে থাকে সেটা কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন। তাছাড়া কুষ্টিয়া মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের হোষ্টেল নির্মান সংক্রান্ত কোন বিষয়েই আমি কিছু বলতে পারব না। যেহেতু নির্মান প্রকল্পের সময় সম্প্রসারণ প্রস্তাবনাটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সবে মাত্র সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প পরিবীক্ষন ও মূল্যায়ন কমিটি আইএমইডির টিম কয়েকদিন পূর্বে এসে তদন্ত করে গেছেন। উনাদের রিপোর্টের উপর নির্ভর করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি নির্দেশনা দেন। সেকারণে সুরাহা কবে হবে তার কোন নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেম এমুহুর্তে বলতে পারব না।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা: সরোয়ার জাহান বলেন, ‘কুষ্টিয়ায় মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরুকালে তাৎক্ষনিক ভাবে নিরুপায় হয়েই শিক্ষর্থীদের এসব জড়াজীর্ণ আবাসনে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম এটা সাময়িক সময়ের সমস্যা। কিন্তু প্রকল্পের নির্মাণকাল নিয়ে এমন দীর্ঘসূত্রীতার কারণে আজ সকল ধর্য্যরে সীমা পেড়িয়ে গেছে। প্রিয় সন্তানদের এমন পরিত্যক্ত আবাসন বা অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন-যাপন কোন অভিভাবকই মেনে নেবেন না। দ্রুত এই অবস্থার স্থায়ী নিরসন দাবি করছি।
বিষয়টি নিয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ নির্মান প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, দেখুন আমার ছাত্র/ছাত্রীদের দুর্ভোগ কষ্টের বিষয়ে আমরা অবগত। ওরা ওদের মূল ক্যাম্পাসে চলে গেলে সব দুর্ভোগ লাঘব হয়ে যাবে। ওখানে ইতোমধ্যে ছাত্রদের আবাসনের জন্য নির্ধারিত ১টি এবং ছাত্রীদের জন্য ১টি হোষ্টেল নির্মান কাজের প্রায় ৯৫% সম্পন্ন হয়েছে। চাইলে এখনও ওখানে শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু সেটাও হবে ঠিকাদার সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত বিভাগের কাছে হস্তান্তর করার পর। এই কাজটিও আটকে আছে ঠিকাদারের সামান্য কিছু বিল বাকী থাকার কারণে। সেটাও এখন নির্ভর করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের উপর। কেন নির্ধারিত সময়ের তিনগুন বেশী সময় এবং অর্থব্যয়ের পরও এমন অবস্থা হলো প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অতীতে কি হয়েছে বা হয়নি সেসব নিয়ে এখন আর ঘাটাঘাটি না করি। আগামী দিনে কিভাবে দ্রুততম সময়ে আমরা সকল সমস্যার সমাধানে পৌছতে পারি সেটাই এখন মূখ্য। তবে আশা করছি খুব শীঘ্রই আমরা সমাধানে পৌছুব। এর বাইরে এমুহুর্তে আর কিছু বলতে পারব না।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

সীতাকুণ্ডে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৭

কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকি ও ভোগান্তির দিনকাল

প্রকাশিত : ১২:০১:৪৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২১

২৪ জানুয়ারী, বেলা ৩টা, মেষ-বৃষ্টির বালাই নেই, ছোট্ট একটি কক্ষের মেঝেতে ৩টি বিছানা, বইখাতা সাটানো ছোট আকৃতির ২টি পড়ার টেবিল, ২টি প্লাষ্টিকের চেয়ার আছে সেখানে থালা-বাটি-গ্লাস রাখা। কক্ষটির মাঝখান বরাবর একটি দড়ি টাঙানো, এলোমেলো অগোছালো কাপড়-চোপর ঝুলছে, কক্ষের মাঝখানে একটি প্লাষ্টিকের বালতি রাখা, সেখানে উপর থেকে পানির ফোটা পড়ছে টপ টপ শব্দে, মাথার উপর ছাদে (সিলিংএ) ফ্যানের বদলে ঝোলানো কালো রংয়ের পলিথিন। সেখান থেকেই পানি ঝরছে অবিরাম। অন্য একটি কক্ষের সিলিং সবুজ রংয়ের শ্যাওলায় আচ্ছাদিত সেখানে ঝুলন্ত ফ্যানটি না থাকলে ঠাহর করার জো নেই এটা ওই কক্ষের সিলিং অথবা অন্য কিছু। অন্য একটি কক্ষের সিলিংএর অধিকাংশ খসে পড়েছে অনেক আগেই, মরিচায় অধিকাংশ ক্ষয়ে যাওয়া কয়েকটি রডের অস্তিত্ব দেখা যায়। ভিতরের এমন জীর্ণদর্শা ভবনটির বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। কক্ষগুলির মধ্যে কেউ বা বসে পড়ছে, কেউবা দুপুরের খাবার খেয়ে আয়েসী ঘুমের চেষ্টায়। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের ঠিক পিছনটায় মাত্র বছর বিশেক পূর্বে চিকিৎসকদের আবাসন হিসেবে নির্মিত হয়েছিলো দ্বিতল বিশিষ্ট এই ভবনটি। বসবাস অযোগ্য ও পরিত্যক্ত হওয়ায় অনেক আগেই সেটি ত্যাগ করেন চিকিৎসকরা। সেখানেই অগত্যা আবাসনের ঠাঁই হয়েছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ৫ম বা শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের। যেখানে হঠাৎ কোন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ প্রবেশ করলে প্রান ভয়ে আঁৎকে উঠবেন অথবা দৌড়ে পালাবেন।

সেখানে ৫ম বর্ষের ‘শাহিদ আলম নামের এক শিক্ষার্থী গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন, ‘আর মাত্র কয়েকটা দিন, পরীক্ষা দিবো রেড়িয়ে যাবো, ব্যাস, এতোদিন যখন মরিনি, যত ঝুঁকিপূর্ন জায়গাতেই থাকি না কেন আল্লাহ সহায় থাকলে এ-কটা দিনও কেটে যাবে। দেখুন এটা কোন সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয় যে, শিক্ষার্থীরা তাদের স্বত:সিদ্ধ ন্যুনতম ন্যায় সংগত মোলিক অধিকার নিয়ে কথা বলার সুযোগ আছে। এখানে শিক্ষকরা যেভাবে রাখবেন সেভাবেই থাকতে বাধ্য; তা নাহলে হয় ফেল নতুবা মার্কস কম; সিনিয়র এক বড়ভায়ের নির্মম ভোগান্তির উদাহরন দিয়ে বলছিলেন এই শিক্ষার্থী। সেকারণে সবকিছু জেনেও সবই সইতে হয় নিরবে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে প্রাণ রসায়নে ভর্তি বাতিল করে পরের বছর মেডিকেলে চান্স পেয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেলে ভর্তি হন নাটোরের মেয়ে অনিতা বিশ^াস। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বুক ভরা রঙিন স্বপ্ন নিয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এখানেও একটা সুন্দর ক্যম্পাস পাবো। কিন্তু প্রথম দিনেই ক্যাম্পাসে এসে রহিমা-আফসার ছাত্রী হোষ্টেলে ঢোকার পর আমার সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়। প্রথম বছরটা কেটেছে আক্ষেপে। এখানে একাডেমিক কার্যক্রমসহ আবাসনস্থলে চরম ভোগান্তির মধ্যদিয়ে আমরা ৫টি বছর শেষ করলাম। অস্বাস্থ্যকর ঝুঁকিপূর্ণ আবাসনে নেই পানীয় জল, সৌচাগার, স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা, দেয়ালে নেই পলেস্তার, ছাদের পলেস্তার খসে পড়ায় আহত হচ্ছেন সহপাঠী শিক্ষার্থী। দুর্ভোগ আমাদের নিত্য সঙ্গী। বলতে পারেন এখন সব গা সওয়া হয়ে গেছে। দু:খের কথা বলি- আমার মা দেখা করতে এসেও আমার কক্ষে নিয়ে যেতে পারিনি। লজ্জায় ক্ষোভে ডুকরে কেঁদেছি নিরবে। আমি চাই এমন মানবেতর ও ঝুঁকিপূর্ন জীবনের অবসান হোক আমাদের পরবর্তী জুনিয়র শিক্ষার্থীদের জন্য। অবিলম্বে তারা ফিরে যাক তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে।
২০১১ সালে পরিত্যাক্ত জড়াজীর্ণ অবকাঠামো নিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসের যাত্রা শুরু কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের। সর্বশেষ ৯ম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। ইতোমধ্যে শিক্ষা শেষে ৪টি ব্যাস বেড়িয়ে যোগদান করেছেন স্বাস্থ্য সেবাই। এখানকার শিক্ষার্থীরা প্রিয় ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক স্বপ্ন ও আকাঙ্খা নিয়ে ভর্তির পর সীমাহিন দুর্ভোগ, নিকৃষ্টতম মানবেতর ও চরম ঝুঁকিপূর্ন জীবন-যাপন করছেন বলে অভিযোগ তাদের। ফিকে হয়ে গেছে তাদের ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক রঙিন স্বপ্ন। আশ^াসের বানী শুনে আসছেন ভর্তির পর থেকে। এমন অবর্ননীয় ভোগান্তিমুক্ত শিক্ষা মনোরম পূর্নাঙ্গ মেডিকেল ক্যাম্পাসে ফিরতে চান শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের পূর্নাঙ্গ ক্যাম্পাসে ফেরানোর দাবি জেলাবাসীর। সরেজমিন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বললে তারা এসব চিত্র তুলে ধরেন।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্প শুরুতে ছাত্রাবাস ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ছয় তলা ভিত্তির ওপর ছয় তলা ভবন নির্মাণে পুরো প্যাকেজের জন্য মোট বরাদ্দ ছিল আট কোটি সাত লাখ টাকা। এরমধ্যে শুধু ভবন নির্মাণ ব্যয় ছিল সাত কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কিন্তু ছয় তলা ভিত্তির উপর চার তলা ভবন নির্মাণেই চুক্তি হয় ৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকার। এছাড়া আরও এক কোটি ১১ লাখ টাকার বর্ধিত অননুমোদিত ব্যয় দেখানো হয়। এ ভবনটির ভিত্তি ১০ হাজার ৫৪৫ বর্গফুট করার কথা।
একই ভাবে ছয় তলা ভিত্তির উপর ছয় তলার ছাত্রী হল নির্মাণে বরাদ্দ ছিল আট কোটি সাত লাখ টাকা যার অনুমোদিত ব্যয় ছিল সাত কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কিন্তু চার তলার ভবন নির্মাণেই চুক্তি হয় সাত কোটি ৮৬ লাখ টাকার। এই ভবনটি ১০ হাজার ৫৪৫ বর্গফুট ভিত্তি বিশিষ্ট করার কথা।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরেই প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরে আরো দুই দফায় দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ শেষ না হওয়ায় আর বাড়ানো হয়নি। ২০১৬ সালে সেপ্টেম্বরে এসংক্রান্ত আইএমইডির এই প্রতিবেদন জমার পর পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভায় প্রকল্পটির মেয়াদ নতুন করে আর না বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কুষ্টিয়া জেলার সাধারন সম্পাদক আজগর আলী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘নির্মানাধীন কুষ্টিয়া মেডিকেল প্রকল্পের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দূর্নীতি তদন্তের নির্দেশ দেয়ায় কুষ্টিয়াবাসীর পক্ষ থেকে একনেক সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। তবে যাদের কারনে প্রকল্পটি বার বার মুখ থুবরে পড়ছে, তাদের চিহ্নিত করে বিচার দাবি করি এবং দ্রুততম সময়ে নির্মাণ শেষ করে মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার দবি করি। তারা যাতে যথার্থ শিক্ষা মনোরম পরিবেশে ফিরে যেতে পারে’।
কুষ্টিয়া গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম বলেন, ওইসব ভবন অনেক আগেই বসবাস ও ব্যবহার অযোগ্য ঘোষনা করা হয়েছে। সেখানে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা কিভাবে থাকে সেটা কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন। তাছাড়া কুষ্টিয়া মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের হোষ্টেল নির্মান সংক্রান্ত কোন বিষয়েই আমি কিছু বলতে পারব না। যেহেতু নির্মান প্রকল্পের সময় সম্প্রসারণ প্রস্তাবনাটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সবে মাত্র সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প পরিবীক্ষন ও মূল্যায়ন কমিটি আইএমইডির টিম কয়েকদিন পূর্বে এসে তদন্ত করে গেছেন। উনাদের রিপোর্টের উপর নির্ভর করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি নির্দেশনা দেন। সেকারণে সুরাহা কবে হবে তার কোন নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেম এমুহুর্তে বলতে পারব না।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা: সরোয়ার জাহান বলেন, ‘কুষ্টিয়ায় মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরুকালে তাৎক্ষনিক ভাবে নিরুপায় হয়েই শিক্ষর্থীদের এসব জড়াজীর্ণ আবাসনে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম এটা সাময়িক সময়ের সমস্যা। কিন্তু প্রকল্পের নির্মাণকাল নিয়ে এমন দীর্ঘসূত্রীতার কারণে আজ সকল ধর্য্যরে সীমা পেড়িয়ে গেছে। প্রিয় সন্তানদের এমন পরিত্যক্ত আবাসন বা অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবন-যাপন কোন অভিভাবকই মেনে নেবেন না। দ্রুত এই অবস্থার স্থায়ী নিরসন দাবি করছি।
বিষয়টি নিয়ে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ নির্মান প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, দেখুন আমার ছাত্র/ছাত্রীদের দুর্ভোগ কষ্টের বিষয়ে আমরা অবগত। ওরা ওদের মূল ক্যাম্পাসে চলে গেলে সব দুর্ভোগ লাঘব হয়ে যাবে। ওখানে ইতোমধ্যে ছাত্রদের আবাসনের জন্য নির্ধারিত ১টি এবং ছাত্রীদের জন্য ১টি হোষ্টেল নির্মান কাজের প্রায় ৯৫% সম্পন্ন হয়েছে। চাইলে এখনও ওখানে শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু সেটাও হবে ঠিকাদার সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত বিভাগের কাছে হস্তান্তর করার পর। এই কাজটিও আটকে আছে ঠিকাদারের সামান্য কিছু বিল বাকী থাকার কারণে। সেটাও এখন নির্ভর করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের উপর। কেন নির্ধারিত সময়ের তিনগুন বেশী সময় এবং অর্থব্যয়ের পরও এমন অবস্থা হলো প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অতীতে কি হয়েছে বা হয়নি সেসব নিয়ে এখন আর ঘাটাঘাটি না করি। আগামী দিনে কিভাবে দ্রুততম সময়ে আমরা সকল সমস্যার সমাধানে পৌছতে পারি সেটাই এখন মূখ্য। তবে আশা করছি খুব শীঘ্রই আমরা সমাধানে পৌছুব। এর বাইরে এমুহুর্তে আর কিছু বলতে পারব না।