০৬:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫

গণমানুষ থেকে উঠে আসা সাংসদ নুরুল হক

  • জোবায়দা হক
  • প্রকাশিত : ১০:১৮:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ মে ২০২১
  • 65

নূরুল হক হাওলাদার

একজন মানুষের গল্প বলছি, যিনি দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। মানুষের সুখে-দুঃখে তাদের সারথী হয়ে যিনি সারাটা জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নয়, তিনি আমার পিতা দক্ষিণ বাংলার ছোট্ট জেলা শরীয়তপুর নড়িয়ার শহীদ সংসদ সদস্য এ এফ এম নুরুল হক হাওলাদার। ১৯৩৫ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি নড়িয়ার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নের সালধ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নুরুল হক হাওলাদারের পিতা মুন্সী জানে আলম হাওলাদার তৎকালীন বৃটিশ শাসনামলে জেলা জুড়ি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। মুন্সী জানে আলম হাওলাদারের ১০ সন্তানের মধ্যে নুরুল হক হাওলাদার ছিলেন পঞ্চম। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম না নিলেও তাঁর পরিবার ছিল শরীয়তপুর জেলার মধ্যে একটি বুনিয়াদী সম্ভ্রান্ত পরিবার। তার পিতা মুন্সী জানে আলম হাওলাদারের ছিল বিশাল ভ‚মিস্বত্ত¡। বিত্ত বৈভব আর পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তি মাঝে বেড়ে উঠেছেন নূরুল হক হাওলাদার। কিন্তু পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর বিত্ত-বৈভব তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন একজন কোমল হৃদয়ের অধিকারী মানুষ। ছোটবেলা থেকে এলাকার মানুষের দুঃখ কষ্ট তাঁকে সব সময় পীড়া দিত। বাড়িতে ধুমধাম করে পিঠা পায়েশের আয়োজন তিনি পছন্দ করতেন না। কারণ মানুষ অভাবের তাড়নায় না খেয়ে থাকবে, আর বাড়িতে পিঠা-পায়েশের আয়োজন হবে এটা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। গ্রামের অভাবগ্রস্ত দারিদ্রপীড়িত মানুষদের জন্য বাবার ধানের গোলা খুলে দিতেন। নিজেদের বাগানের গাছ কেটে মানুষের চলাচলের জন্য সাঁকো তৈরি করে দেয়াসহ এমন অনেক পরোপকারের কথা এখনো মানুষের মুখে মুখে। তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ভাষণ থেকে জানা যায়, নূরুল হক নিজ গ্রামে অবস্থিত তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত সালধ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে পন্ডিতসার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি চাঁদপুর কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন। স্কুল জীবন থেকেই তিনি নিজেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া এবং সমস্যা সমাধানে তিনি সবসময় আপোষহীন ছিলেন। আর তাই তখন থেকেই তিনি ছাত্র-জনতার প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ছাত্র আন্দোলনে তিনি ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি ছাত্রকর্মীদের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬২ সালে তিনি তৎকালীন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তথাকথিত পাকিস্তানের সংবিধানের বিরোধীতা করায় মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন কারারুদ্ধ হন, তখন তাঁকে মুক্ত করার আন্দোলনেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সেমিনারে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেয়ায় তাঁকে একাধিক মামলায় জড়ানো হয় এবং ইপিআর বাহিনীর হাতে তাঁকে অশেষ নির্যাতন ভোগ করতে হয়। নূরুল হক ডিঙ্গামানিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নড়িয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হন এবং তখন দলের সুপ্রীম কাউন্সিলে কাউন্সিলর হিসেবে যোগদান করেন। চাঁদপুর কলেজে অধ্যয়নের সময় কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। তাঁকে নিয়ে চাঁদপুর পুরান বাজারে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। চাঁদপুর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে নুরুল হক হাওলাদার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৬৪ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। পরের বছর তিনি বাংলা সাহিত্যেও এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি আইন শাস্ত্রেও ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে নূরুল হক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান এবং বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে থেকে রাজনীতি চর্চা করেন। নিঃস্বার্থ কর্মী ছিলেন বলে তিনি জাতির জনকের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ‚ত্থানে তিনি রাজপথে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করেন এবং ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে যারা পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তাদের সাথে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্টতা ছিল। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি পারিবারিক ঐতিয্য অনুযায়ী সক্রিয়ভাবে জাতীয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। তিনি তৎকালীন মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন এবং ডিঙ্গামানিক ত্রাণ ও পূনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়া তিনি পিসি কমিটির সভাপতি ও নড়িয়া আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশপ্রেমিক পরোপকারী মানুষটি ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এবং তাঁর নির্দেশে নড়িয়ার সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি একজন সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন এবং তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে শত্রুসেনা নিধনে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে কলকাতার মেলাগড়ে ট্রেনিং সম্পন্ন করে মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অধীনে বিভিন্ন সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর রণকৌশল ও দুঃসাহসিক বিভিন্ন অভিযান এখনো স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধাদের আবেগাপ্লুত করে তুলে। তিনি যেমনি ছিলেন সাহসী তেমনি ছিলেন প্রচন্ড মানবিক গুণের অধিকারী। কথিত রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন হামিদিয়া ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় সেখানে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিলে তিনি নিজে দুই দিন না খেয়ে সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নুরুল হককে জীবিত অথবা মৃত. ধরিয়ে দেয়ার জন্য দখলদার পাকিস্তান সরকার ১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। কিন্তু তিনি এসবের পরোয়া না করে সকল বাধা-বিপত্তি ও হুমকির মুখে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনাব হক যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন ফরিদপুর-১৭ বর্তমান শরীয়তপুর-২ নড়িয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে তিনি প্রায় ৬৯ হাজার ভোট পান। আর তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী মাত্র ৩৭শ’ ভোট পেয়ে জামানত হারান।এটি তাঁর জনপ্রিয়তা ও জনসম্পৃক্ততার আরেকটি বড় প্রমান। নুরুল হক হাওলাদার নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে পৈত্রিক জমিতে এলাকায় “পন্ডিতসার গালর্স স্কুল” নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর মৃত্যুর পর এলাকাবাসী যার নামকরণ করেন-“শহীদ নূরুল হক উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়”। পারবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদলে জাতীয় পার্রি সময়ে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে “টিএম গিয়াস উদ্দিন কলেজ” নামে নামকরণ করা হয়। সংসদ সদস্য থাকাকালীন তিনি শুরেশ্বর লঞ্চ ঘাট নির্মাণসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে বিশেষ ভ‚মিকা রাখেন। নূরুল হক ছিলেন একজন বাগ্মী পুরুষ। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সুন্দর সাবলীল ভাষায় অগ্নিঝরা বক্তৃতা ও বাগ্মীতার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ‘সংসদের গোলাপ’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। প্রথম দিনের ভাষণেই তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুমতিতে তিনি সেদিন নির্ধারিত ১০ মিনিট সময়ের স্থলে অনেক বেশি সময় ধরে (৪৫ মিনিট) সংসদে বক্তৃতা করেন। নুরুল হক হাওলাদার একজন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এছাড়াও তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। যাত্রাদল থেকে মঞ্চে অভিনয় সবখানেই ছিল তার সমান বিচরণ। ১৯৭৩ সালের ৩০ মে জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন তথা বাজেট অধিবেশনের আগের দিন রাত ৮টায় তার নিজ বাড়ির বৈঠকখানায় স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক করার সময় আঁততায়ীরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে নড়িয়ার মাটি ও মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন তাদের স্নেহ ধন্য নুরুল হক হাওলাদারকে হারানোর পাশাপাশি নড়িয়ার উন্নয়নকামী মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। দেশ হারায় একজন মেধাবী সংগঠক ও রাজনৈতিক নেতাকে। স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে তিনি শোক সায়রে রেখে যান। শহীদ নুরুল হক ’৭৩ সালে যখন পাষন্ড খুনীদের হাতে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাত বরণ করেন তখন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী জেবুন্নেসা হক ছিলেন মাত্র কৈশর উত্তীর্ণ এক তরুনী। সেই থেকে তিনি প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা ভরা বুকে আজো পাষাণ হয়ে আছেন।

বিজনেস বাংলাদেশ/ এ আর

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

গণমানুষ থেকে উঠে আসা সাংসদ নুরুল হক

প্রকাশিত : ১০:১৮:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ মে ২০২১

একজন মানুষের গল্প বলছি, যিনি দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। মানুষের সুখে-দুঃখে তাদের সারথী হয়ে যিনি সারাটা জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন। তিনি আর কেউ নয়, তিনি আমার পিতা দক্ষিণ বাংলার ছোট্ট জেলা শরীয়তপুর নড়িয়ার শহীদ সংসদ সদস্য এ এফ এম নুরুল হক হাওলাদার। ১৯৩৫ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি নড়িয়ার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নের সালধ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নুরুল হক হাওলাদারের পিতা মুন্সী জানে আলম হাওলাদার তৎকালীন বৃটিশ শাসনামলে জেলা জুড়ি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। মুন্সী জানে আলম হাওলাদারের ১০ সন্তানের মধ্যে নুরুল হক হাওলাদার ছিলেন পঞ্চম। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম না নিলেও তাঁর পরিবার ছিল শরীয়তপুর জেলার মধ্যে একটি বুনিয়াদী সম্ভ্রান্ত পরিবার। তার পিতা মুন্সী জানে আলম হাওলাদারের ছিল বিশাল ভ‚মিস্বত্ত¡। বিত্ত বৈভব আর পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তি মাঝে বেড়ে উঠেছেন নূরুল হক হাওলাদার। কিন্তু পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর বিত্ত-বৈভব তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন একজন কোমল হৃদয়ের অধিকারী মানুষ। ছোটবেলা থেকে এলাকার মানুষের দুঃখ কষ্ট তাঁকে সব সময় পীড়া দিত। বাড়িতে ধুমধাম করে পিঠা পায়েশের আয়োজন তিনি পছন্দ করতেন না। কারণ মানুষ অভাবের তাড়নায় না খেয়ে থাকবে, আর বাড়িতে পিঠা-পায়েশের আয়োজন হবে এটা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। গ্রামের অভাবগ্রস্ত দারিদ্রপীড়িত মানুষদের জন্য বাবার ধানের গোলা খুলে দিতেন। নিজেদের বাগানের গাছ কেটে মানুষের চলাচলের জন্য সাঁকো তৈরি করে দেয়াসহ এমন অনেক পরোপকারের কথা এখনো মানুষের মুখে মুখে। তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ভাষণ থেকে জানা যায়, নূরুল হক নিজ গ্রামে অবস্থিত তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত সালধ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে পন্ডিতসার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি চাঁদপুর কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন। স্কুল জীবন থেকেই তিনি নিজেকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া এবং সমস্যা সমাধানে তিনি সবসময় আপোষহীন ছিলেন। আর তাই তখন থেকেই তিনি ছাত্র-জনতার প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ছাত্র আন্দোলনে তিনি ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি ছাত্রকর্মীদের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬২ সালে তিনি তৎকালীন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তথাকথিত পাকিস্তানের সংবিধানের বিরোধীতা করায় মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন কারারুদ্ধ হন, তখন তাঁকে মুক্ত করার আন্দোলনেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সেমিনারে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেয়ায় তাঁকে একাধিক মামলায় জড়ানো হয় এবং ইপিআর বাহিনীর হাতে তাঁকে অশেষ নির্যাতন ভোগ করতে হয়। নূরুল হক ডিঙ্গামানিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নড়িয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হন এবং তখন দলের সুপ্রীম কাউন্সিলে কাউন্সিলর হিসেবে যোগদান করেন। চাঁদপুর কলেজে অধ্যয়নের সময় কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। তাঁকে নিয়ে চাঁদপুর পুরান বাজারে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। চাঁদপুর কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে নুরুল হক হাওলাদার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৬৪ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। পরের বছর তিনি বাংলা সাহিত্যেও এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি আইন শাস্ত্রেও ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে নূরুল হক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান এবং বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে থেকে রাজনীতি চর্চা করেন। নিঃস্বার্থ কর্মী ছিলেন বলে তিনি জাতির জনকের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ‚ত্থানে তিনি রাজপথে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করেন এবং ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে যারা পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তাদের সাথে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্টতা ছিল। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি পারিবারিক ঐতিয্য অনুযায়ী সক্রিয়ভাবে জাতীয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। তিনি তৎকালীন মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন এবং ডিঙ্গামানিক ত্রাণ ও পূনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়া তিনি পিসি কমিটির সভাপতি ও নড়িয়া আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশপ্রেমিক পরোপকারী মানুষটি ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে এবং তাঁর নির্দেশে নড়িয়ার সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি একজন সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন এবং তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে শত্রুসেনা নিধনে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে কলকাতার মেলাগড়ে ট্রেনিং সম্পন্ন করে মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অধীনে বিভিন্ন সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর রণকৌশল ও দুঃসাহসিক বিভিন্ন অভিযান এখনো স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধাদের আবেগাপ্লুত করে তুলে। তিনি যেমনি ছিলেন সাহসী তেমনি ছিলেন প্রচন্ড মানবিক গুণের অধিকারী। কথিত রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন হামিদিয়া ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় সেখানে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিলে তিনি নিজে দুই দিন না খেয়ে সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নুরুল হককে জীবিত অথবা মৃত. ধরিয়ে দেয়ার জন্য দখলদার পাকিস্তান সরকার ১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। কিন্তু তিনি এসবের পরোয়া না করে সকল বাধা-বিপত্তি ও হুমকির মুখে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনাব হক যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন ফরিদপুর-১৭ বর্তমান শরীয়তপুর-২ নড়িয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে তিনি প্রায় ৬৯ হাজার ভোট পান। আর তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী মাত্র ৩৭শ’ ভোট পেয়ে জামানত হারান।এটি তাঁর জনপ্রিয়তা ও জনসম্পৃক্ততার আরেকটি বড় প্রমান। নুরুল হক হাওলাদার নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে পৈত্রিক জমিতে এলাকায় “পন্ডিতসার গালর্স স্কুল” নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর মৃত্যুর পর এলাকাবাসী যার নামকরণ করেন-“শহীদ নূরুল হক উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়”। পারবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদলে জাতীয় পার্রি সময়ে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে “টিএম গিয়াস উদ্দিন কলেজ” নামে নামকরণ করা হয়। সংসদ সদস্য থাকাকালীন তিনি শুরেশ্বর লঞ্চ ঘাট নির্মাণসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে বিশেষ ভ‚মিকা রাখেন। নূরুল হক ছিলেন একজন বাগ্মী পুরুষ। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সুন্দর সাবলীল ভাষায় অগ্নিঝরা বক্তৃতা ও বাগ্মীতার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ‘সংসদের গোলাপ’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। প্রথম দিনের ভাষণেই তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুমতিতে তিনি সেদিন নির্ধারিত ১০ মিনিট সময়ের স্থলে অনেক বেশি সময় ধরে (৪৫ মিনিট) সংসদে বক্তৃতা করেন। নুরুল হক হাওলাদার একজন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এছাড়াও তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একজন সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। যাত্রাদল থেকে মঞ্চে অভিনয় সবখানেই ছিল তার সমান বিচরণ। ১৯৭৩ সালের ৩০ মে জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন তথা বাজেট অধিবেশনের আগের দিন রাত ৮টায় তার নিজ বাড়ির বৈঠকখানায় স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক করার সময় আঁততায়ীরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে নড়িয়ার মাটি ও মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন তাদের স্নেহ ধন্য নুরুল হক হাওলাদারকে হারানোর পাশাপাশি নড়িয়ার উন্নয়নকামী মানুষের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। দেশ হারায় একজন মেধাবী সংগঠক ও রাজনৈতিক নেতাকে। স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে তিনি শোক সায়রে রেখে যান। শহীদ নুরুল হক ’৭৩ সালে যখন পাষন্ড খুনীদের হাতে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাত বরণ করেন তখন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী জেবুন্নেসা হক ছিলেন মাত্র কৈশর উত্তীর্ণ এক তরুনী। সেই থেকে তিনি প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা ভরা বুকে আজো পাষাণ হয়ে আছেন।

বিজনেস বাংলাদেশ/ এ আর