সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ার সাথে সাথেই চাঁদপুরের হাইমচরের প্রত্যন্ত এলাকায় গায়ের গৃহবধূ ও কিশোরীদের অন্যতম প্রধান শকের কাজ ছিলো শীতল পাটি বুনন। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রঙ বেরঙের শীতলপাটি তৈরি হতো। কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গৃহবধূরা হয়েছেন সৌখিন। তাই তেমন বেঁচাবিক্রি না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম হাইমচরের ঐতিহ্য বহনকারী শীতলপাটি।
স্থানীয়রা চুন্নু মিয়া সরকার, অলি উল্লাহ চৌকিদারসহ আরও অনেকে জানান, এক সময় গ্রামের বাড়িতে অতিথিরা এলে প্রথমেই বসতে দেয়া হতো শিতল পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্যও ছিলো বিশেষ ধরনের সৌন্দর্যবর্ধক শীতল পাটি। আর তাই হাইমচরের বিভিন্ন গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে শীতলপাটি বুনন ছিল পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ।কিন্তু এখন আর সেসব দেখা যায়না।
স্থানীয়রা আরও জানান, বিবাহযোগ্য কন্যার পাটি বুনন জ্ঞানকে বিবেচনা করা হতো বিশেষ যোগ্যতায়। গরমে শীতলপাটির কদর ছিল বেশ।কেননা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের রৌদ্রময় দুপুরে এই পাটি দেহ-মনে শীতলতা আনে। বর্তমানে যুগের আধুনিকায়নে পাটি শিল্পের স্থান দখল করে নিয়েছে সুরম্য টাইলস, ফ্লোরম্যাট ও প্লাস্টিক সামগ্রী ও চাদর। হাইমচরের বিভিন্ন গ্রামের বধু-কন্যাদের নান্দনিক এ কারুকার্য এখন হারিয়েছে গেছে সৌখিনতায়।
হাইমচরের চরভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল কাদির মিজির স্ত্রী হাসিনা বেগম জানান, শীতলপাটি বুনন ছিল তাঁর পেশা। তিনি এ শীতলপাটিকে বানিজ্যিকভাবে নিয়েছিলেন। হাতপাখা, নামাজের চিউনী, খাটে ঘুমানো পাটি বিক্রি করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন শিতলপাটির তেমন চাহিদা না থাকায় তিনি শীতল পাটি বুনন ছেড়ে দিয়েছেন। তার মতো শত শত নারীও ছেড়েছেন এ ‘শীতল পাটি’ বানানো। কারন পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পাটি বুনতাম এখন আর এসব চলে না।
১লা জুুন মঙ্গলবার সরেজমিনে হাইমচরের চরভাঙ্গা, কৃষ্ণপুর, লামচরী ও মহজমপুর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দুয়েকটি ঘরে শীতল পাটি থাকলেও নেই বুনন কার্যক্রম। এ পাটি বুননের জন্য ব্যবহৃত মোস্তাইক গাছের তেমন উৎপত্তি নেই। মূলত বেচাবিক্রি না থাকাতেই কারোই যেনো আগ্রহ নেই এসব শিল্প টিকিয়ে রাখার।
স্থানীয়রা জানান, শীতল পাটি তৈরির মূল উপাদান (কাঁচামাল) বেতি তৈরিতে অনেক পরিশ্রমের প্রয়োজন। পরিশ্রমের বিপরীতে বাজার দর ভালো না হওয়ায় দিন দিন একেবারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন শীতল পাটি তৈরির কারিগররা।
এদিকে হাইমচর বাজার, হাওলাদার বাজার, চরভৈরবী বাজারের মাটির তৈজসপত্র বিক্রেতা শ্যামল দত্ত, অরুন কুমার,মোঃ মিজানুর রহমানসহ আরও অনেক বিক্রেতাগণ জানান, একটি নামাজের পাটির দাম ২’শ ৫০ টাকা থেকে ৩’শ টাকা। অথচ ১’শ ২০ টাকা হতে ১’শ ৫০ টাকার খসালেই প্লাস্টিকের একটি নামাজের পাটি কেনা সম্ভব। আবার একটি বড় পাটির দাম ৮’শ টাকা হতে ১ হাজার টাকা। অতছ এর বিপরীতে ৪’শ থেকে ৫’শ টাকা দিয়ে প্লাস্টিকের পাটি বা ফ্লোরম্যাট কেনা সম্ভব। তাই বাজারে শীতল পাটির কিঞ্চিৎ চাহিদা থাকলেও বিকল্প পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় তা টিকছে না।
বাংলাদেশ সচেতন নাগরিক কমিটি চাঁদপুর জেলার সদস্য সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত সাহা বলেন, শীতল পাটি আগে হাইমচরে স্থানীয়ভাবে তৈরি ও সরবরাহ হলেও এখন কমদামে অন্যজেলা থেকে কিনে আনা যায়। কাছাকাছি উপজেলা চাঁদপুরের কচুয়া ও শাহরাস্তিতে কিছু শিতল পাটি পাওয়া গেলেও তার দাম অনেক বেশি। তাই শীতল পাটির চাহিদা কম হওয়ায় সর্বত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার অন্যতম ঐতিহ্য বহনকারী শিল্প ‘শীতলপাটি’। সুতরাং বাজার ব্যবস্থা ঠিক হলে হাইমচরের শীতল পাটির চাহিদা আবারও বৃদ্ধি পাবে বলে আমি মনে করছি।