দীর্ঘদিন ধরেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সর্বশেষ ড. সুফী সাগর সামস নামের একজন অভিভাবক দুর্নীতি দমন কমিশন, শিক্ষামন্ত্রনালয়সহ অন্যান্য জায়গায় লিখিত অভিযোগ দায়েরের পর সংবাদ সম্মেলণ করেন। এই সংবাদ সম্মেলণে নর্থ সাউথের দুই ট্রাস্টি এমএ কাসেম ও আজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ তোলা হয়। সংবাদ সম্মেলণে বলা হয় মূলত আজিম-কাসেম সিন্ডিকেটের নেতৃত্বেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিপুল দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাটের কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। মূলত এরপরই নর্থ সাউথ ইস্যুতে সবার নতুন করে টনক নড়ে। এরই ধারবাহিকতায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ আহবায়ক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. ওমর ফারুক সদস্য সচিব ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাহমুদুল আলম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিকে ১৬ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব শামিমা বেগমের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলা হয়। চিঠিতে কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কেও বলা হয়েছে। সেই মতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম তদন্তপূর্বক দায়ীদের চিহ্নিত করে সুপারিশমূলক প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এতে আরো বলা হয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যয় করা যাবে না। তাই এর ব্যত্যয় ঘটলে আত্মসাতের সে অর্থ পুনরুদ্ধারে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা দায়ের করার সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এর আগে দুই ট্রাস্টি আজিম-কাসেম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগই ওঠেছিল। এমনকি সে অভিযোগ দুদকেও হলফনামা স্বাক্ষর করে অভিযোগ করেছিলেন ড.সুফী সাগর সামস। অনুমোদনহীন বিভাগ খুলে টাকা আত্মসাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় বিলাসবহুল রেঞ্জ রোভার, জমি কেনায় দুর্নীতি এমনকি জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতারও অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি এরই মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। এরই মধ্যে ভার্চুয়ালি তদন্ত কমিটির সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে তদন্ত প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ। এদিকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনিয়মের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজকে (বিওটি) ঘিরে। বর্তমান ট্রাস্টি চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন এবং সাবেক বোর্ড চেয়ারম্যান এমএ কাসেম সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে রয়েছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির তহবিল থেকে নিজেদের ইচ্ছামতো অর্থ ব্যয় করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির বিওটি সদস্যরা। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির টাকায় একেকজন ট্রাস্টি প্রায় ৩ কোটি টাকার ল্যান্ড রোভারের বিলাসবহুল রেঞ্জ রোভার গাড়ি কিনে ব্যবহার করছেন। বিওটিসহ নিজেদের তৈরি করা বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় কমিটির সভা ডেকে বড় অংকের সিটিং অ্যালাউন্স নেন ট্রাস্টিরা। সভাভেদে সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ একেকজন সদস্য নিচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত, একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে সেটি ১ লাখ পর্যন্ত ছিল। নিজেদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও কেনাকাটা কিংবা সেবার নামে মোটা অংকের অর্থ বের করে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে এনএসইউর কয়েকজন ট্রাস্টির বিরুদ্ধে। এমনকি স্ত্রীসহ আত্মীয়-স্বজনদের নামমাত্র নিয়োগ দিয়ে তাদের বেতন-ভাতা বাবদও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন অনেক ট্রাস্টি। এছাড়া দরিদ্র কোটায় শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে।
এর আগেও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম তদন্তে ইউজিসির মাধ্যমেও একাধিক তদন্ত পরিচালনা করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও সেসব তদন্তে বিভিন্ন অনিয়মের প্রমাণ মিললেও তা বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ইউজিসির সাবেক একজন চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নর্থ সাউথের অনিয়ম প্রমাণের জন্য তো তদন্ত কমিটির প্রয়োজন হয় না। সেখানকার বিওটি সদস্যরা তো গণমাধ্যমের কাছেই গাড়ি কেনার কথা স্বীকার করে সেটি কোনো দোষের নয় বলে দাবি করেছেন। বিওটির রেজল্যুশনের ভিত্তিতে বৈধভাবে সিটিং অ্যালাউন্স নেন বলে বক্তব্য দিয়েছেন। এছাড়া ইউজিসির আগেকার তদন্তেও বিভিন্ন অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে। যদিও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, অদৃশ্য কারণে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেখিনি মন্ত্রণালয়কে। এমনকি মন্ত্রণালয় থেকে নর্থ সাউথের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গায়েব হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এসব কারনে এনএসইউর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্যরা এখন বেশ চাপে রয়েছেন। চাপের মুখে তাদের নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেঞ্জ রোভারগুলোকেও এখন এনএসইউর পার্কিংয়ে ঢেকে রাখা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৯ সালে বিওটির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ল্যান্ড রোভারের ‘রেঞ্জ রোভার ২০১৯’ মডেলের নয়টি গাড়ি কেনে এনএসইউ কর্তৃপক্ষ। একেকটি গাড়ি কেনায় খরচ হয় প্রায় ৩ কোটি টাকা। গাড়িগুলোর চালক, জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে। বিলাসবহুল এসব গাড়ি ব্যবহার করতেন বিওটি চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ ও সদস্য বেনজীর আহমেদ, এমএ কাসেম, রেহানা রহমান, মোহাম্মদ শাহজাহান, ফৌজিয়া নাজ, ইয়াসমীন কামাল ও তানভীর হারুন। প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এমএ হাসেম একটি গাড়ি ব্যবহার করলেও তার মৃত্যুর পর গাড়িটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ফেরত দেয়া হয়। এমএ হাসেমের মৃত্যুর পর তার ছেলে আজিজ আল কায়সার (টিটু) বিওটি সদস্য হিসেবে যুক্ত হলেও তিনি কোনো ধরনের গাড়ি সুবিধা নিচ্ছেন না। বাকি ট্রাস্টি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা সার্বক্ষণিকভাবে এসব গাড়ি ব্যবহার করতেন। তবে সম্প্রতি এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে গাড়িগুলো একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্কিংয়ে ফেরত পাঠানো হয়। সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে ট্রাস্টি সদস্য বেনজীর আহমেদ ও মোহাম্মদ শাহজাহানের গাড়ি পার্কিংয়ে যুক্ত হয়েছে।
এদিকে তদন্ত বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য বর্তমান চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিনকে ফোন করার পরও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। হলফনামায় স্বাক্ষর করে অভিযোগ করা ড. সুফী সাগর সামস বলেন, ‘নর্থ সাউথের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লুটে পুটে খাচ্ছে আজিম-কাসেম সিন্ডিকেট। দুদকসহ সরকারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে আমি আমার অভিযোগের অনুলিপি পাঠিয়েছি। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে জেনে খুশি হয়েছি। সুষ্ঠু তদন্তের পর দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’