প্রাকৃতিক জলাভুমি, কৃষি ফসলী জমি এবং সুস্থ্য পরিবেশ রক্ষায় মরনঘাতি অশুভ পুকুর খননের বিরূদ্ধে ঐক্য গড়ে তুলে শ্লোগান দেই‘ পুকুর খননকে না বলি। পুকুর খনন কার্য্যক্রম বন্ধ করা না গেলে অতি নিকটেই চলনবিলসহ সব কয়টি বিল ও মুল্যবান ফসলী জমি পুকুরের পেটে চলে যাবে বলে কৃষিবিদ এবং পরিবেশ বাদীরা আশংকা করছেন।
প্রাচীন প্রবাদে আছে“ বিল দেখ তো চলন, গ্রাম দেখ তো কলম , শিব দেখ তো তালম , আর পুল দেখ তে সাড়ার পুল”। এই চলনবিল পাকভারত উপমহাদেশের ঐতিহাসিক বিল বলে খ্যাত। চলনবিলের কথা লিখতে হলে অনেক গবেষনার প্রয়োজন আছে। ১৯৬০ সালে জন্ম থেকে আমি শিশুকাল, বাল্যকাল, যুবাকাল পার হয়ে বর্তমানে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এই চলনবিলের ঢে য়ের তালে তালে, মাছ, শাপলা-শালুক, নানা জাতের পাখির কলতানের সাথে মিশে বেড়ে উঠেছি। চলনবিলের বিশালত্ব আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখে আসছি। মানুষ বাড়ার সাথে উন্নয়নের প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। উন্নয়নের ছোঁয়ায় সংকুচিত হতে হতে বিশাল অখন্ড চলনবিল তার একক অখন্ড বিশালত্ব হারিয়ে আজ অর্ধশতাধিক বিলে খন্ডিত হয়ে জীবন-য়ৌবন হারিয়ে বিলুপ্তপ্রায়। উন্নয়নের ধাক্কায় জলবায়ু পরিবর্তন, অপরাজনীতির প্রভাবে পরিক্ষা-নিরীক্ষা না করেই চলনবিলের প্রান সঞ্চালনকারী বড়াল নদীর উৎসমুখ চারঘাট, দয়ারামপুর ও আটঘড়িয়ায় অপরিকল্পিতভাবে ¯øুইসগেট নির্মান, তিস্তা ব্যরেজ নির্মান , যত্রতত্র বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, রেললাইন, অসংখ্য ব্রীজ, কালভার্ট, ¯øুইসগেটসহ নানা অবকাঠামো নির্মান ,নগরায়ন, শিল্পকারখানা গড়ে উঠায় এবং প্রভাবশালীদের দখল-দুষনে স্রোতস্বনী অখন্ড চলনবিলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।শুকনা মওসুমে বিলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত ৭৭ টি নদি, বিল, খাড়ি, জলাশয় ভরাট হয়ে আবাদি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে।বিলুপ্তির পথে ৬৫ প্রজাতির মাছ।
চলনবিলের অতীত ইতিহাসে দেখা যায়- এককালে অখন্ড চলনবিল ছিল তৎকালীন নাটোর মহকুমার তিন চতুর্থাংশ, নওগাঁ মহকুমার মান্দা, রানীনগর ও আত্রাই থানা এবং পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমা ও সদরের চাটমোহর, ফরিদপুর ও বেড়া থানায় বিস্তৃত। বগুড়া জেলার দক্ষিন প্রান্তের আদমদীঘি ও নন্দীগ্রাম থানা চলনবিলের মধ্যে ছিল। শুধু বাঙলাদেশের নয়,পাকভারত উপমহাদেশে চলনবিলের ন্যায় আয়তন বিশিষ্ট আরকোন বিল আছে বলে ইতিহাসে জানা যানা।
চলনবিলের সিমা উত্তরে বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম এবং শেরপুর থানা, দক্ষিনে পাবনা জেলার আটঘড়িয়া ও ঈশরদী থানা , পুর্বে সারা-সিরাজগঞ্জ রেললাইন, পশ্চিমে নাটোর সদর থানাএবং নওগাাঁ জেলার আত্রাই ও রানীনগর থানা।
চলনবিলের উৎপত্তি কখন হয় এবং কেন এর নামকরন চলনবিল হয় এর সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না। দুই হাজার বছর পুর্বে চলনবিল নামে কোন বিলের অস্তিত্ত¦ ছিলনা বলে ইতিহাস সাক্ষি দিচ্ছে। তখন বিল ছিল সমুদ্রের গর্ভে। কেননা তখন বগুড়ার মহাস্থান পর্যন্ত বঙ্গপসাগর বিস্তৃত ছিল বলে বলা হয়। কিছুকাল পরে সমুদ্র চলনবিলকে প্রসব করে জন্ম দিয়ে দক্ষিন দিকে সরে পরে।তখন পদ্মা ও যমুনা নদী শিশু চলনবিলকে অঙ্গে ধারন করে। গঙ্গা নদীর যেখান থেকে ভাগিরথি নদী প্রবাহিত , তার নি¤œাংশের পুর্বগামি শাখা পদ্মা এবং ব্রম্মপুত্রের দক্ষিন-পশ্চিমগামী শাখা যমুনা চলনবিলের বুকচিড়ে প্রবাহমান ছিল। চলনবিলের জলরাশি বদ্ধবিলের ন্যায় স্থির না হয়ে নদীর ¯্রােতের ন্যায় চলন্ত বা গতিশীল ছিল বলেই হয়তো এর নামকরন করা হয় ‘চলনবিল’ অথ্যৎ চলন্ত বিল।মতান্তওে ‘চোল সমুদ্র’ হতে চলনবিলের উৎপত্তির কথা অনুমান করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোন গ্রন্থে ‘ চোলসমুদ্র’ নামে সমুদ্রের নাম বা পরিচয় পাওয়া যায়না।
ইম্পেরিয়াল গেজেট অব ইন্ডিয়া হতে জানা যায়- অএককালে নাটোরের লালপুর থানা ব্যাতীত প্রায় সমগ্র মহকুমু বিলময় ছিল।ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ারের রাজশাহী অংশে বলা হয়েছে-“ চলনবিল রাজশাহী জেলার একটি বিশাল জলাভ’মি যার দৈর্ঘ্য ২১ মাইল, প্রস্থ ১০ মাইল।অতএব রাজশাহী বর্তমান নাটোর জেলা অংশের বিলের ক্ষেত্রফল ১২০ বর্গমাইল এবং পাবনা জেলা অংশের ৩৪০ বর্গমাইল। সব মিলে বিল অংশের মোট আয়তন দাঁড়াচ্ছে ৫৬০ বর্গমাইল। এর সাথে স্থলভাগের গ্রাম সমুহের আয়তন প্রাং ২৫০ বর্গমাইল যেগ করলে চলনবি অঞ্চলের মোট আয়তন প্রায় ৮০০ বর্গমাইল।
১৯১৪ সালে পাবনা জেলার ঈশ^র্দীর পদ্মা নদীর উপড় রেললাইনের সংযোগ পুল নির্মান করে সারা-ঈশর্দী-সিরাজগঞ্জএবং ঈশ^র্দী শান্তাহার রেললাইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অখন্ড চলনবিল দ্বিধবিভক্ত হয়ে উভয় রেললাইনের মধ্যবতী শুধু নিঞ্চল চলনবিল নামে পরিচিত হয়। এছাড়া নাটোর-সিংড়া-বগুড়া এবং বনপাড়া-তাড়াশ- হাটিকুমরু মহাসড়কসহ চাটমোহরের নিমাইচরা-হান্ডয়াল-তাড়াশ-বিনসারা বাঁধ,তাড়াশ-বারুহাস- বিয়াস , তাড়াশ-নওগাঁ সড়কসহঅগনিত সড়ক, বাঁধ, ¯øুইসগেট, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মান করায় চলনবিল আরো খন্ড-বিখন্ড হয়ে পড়েছে। বর্তমানে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, সিংড়া ও বড়াইগ্রাম , সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ,রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়ার আংশিক এবং পাবন্ াপাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহরসহ আট উপজেলাকে চলনবিল নামে অভিহিত করা হয়।বর্তমানে চলনবিল এলাকার আয়তন ৮০০ বর্গমাইল। পুর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ৩২ মাইল এবং উত্তর – দক্ষিনে প্রস্থ ২৪ মাইল।
বিস্তীর্ন অখন্ড চলনবিল আজ মানুষের প্রয়োজনে উন্নয়নের নামে খন্ডবিখন্ড হতে হতে প্রায় অর্ধশতাধিক পৃথক পৃথক নাম ধারন করে বিলের সৃষ্টি হয়েছে। বিলগুলি হচ্ছে-
দক্ষিন চলনবিল, নলখোলা বিল, চঁড়ালের বিল, রয়নার বিল,চকপাড়া বিল, মানিকপুর বিল,হাাঁড়িভাঙ্গ বিল,বড়দোহা বিল ,চিনাডাঙ্গা বিল, বিল বাহাত্তর, খলিশাডাঙ্গা বিল,মেরিগাছার বিল, চেঁচুয়ার বিল, আইড়মারি বিল, গলিয়া বিল, কানচগাড়ি বিল, কৈখোলা বিল, পাতিয়া বিল,ছয়আনি বিল, বাঁড়ার বিল, সাধুগাড়ী বিল, সাঁতৈল বিল, বিকুড়ালিয়া, বড়বিলা বিল, ঝাঁকড়ার বিল, কচুগাড়ির বিল, চাতরার বিল, নিহলগাড়ির বিল, টেঙরাগাড়ির বিল, খোলার বিল, কুমড়াগাড়ির বিল, খৈগাড়ির বিল, বৃগড়িলা বিল, দিগদারিয়ার বিল, খুলুগাড়ির বিল, কচিয়ার বিল, ধলার বিল,ধরাইল বিল, বালোয়া বিল, আমদাকুড়ি বিল,বাঙ্গাজালিয়া বিল, হুলহুলিায়া বিল, কালামকুড়ি বিল, রঘুকদমা বিল, কুমিরা বিল, মরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, পাঙ্গাসিয়ার বিল,হরি বিল, বুড়ি বিল, বহয়া বিল, সোনাডাঙ্গা বিল,তাড়াশের বড়বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুনের বিল, নলুয়াকান্দি বিল, ঘরগ্রাম বিল, বেরল বিল, কাশিয়ার বিল, চাকলের বিল, কাতল বিল, বাঘমারা বিল, চিরল বিল, ডিকশির বিল, রুখলীডাঙ্গা বিল,রউল শেওলা বিল, রুইমারির বিল, ঝিনিগাড়ির বিল, চকিরভিটা বিল, হাসমারির বিল, চাকলের বিল, লক্ষীচামারী বিল ইত্যাদি। এছাড়াও চলনবিলে রয়েছে সাড়ে চার হাজার হেক্টর আয়তনের ১৬ টি নদী, প্রায় ২ শত কিলেমিটার আয়তনের অর্ধশত খাল, এবং অসংখ্য পুকুর ও জলাশয়।
বর্তমান বৃহত্তর চলনবিল সহ উল্লেখিত বিল সমুহে জমির অধিক ব্যবহার ও অর্থনৈতিক লাভের আশায় চলনবিলের মানুষ পুকুর খনন করে মাছ চাষে মেতে উঠেছে। প্রত্যেকটা বিলেই চলছে পুকুর খননের মহৎসব। পুকুর গিলে খাচ্ছে জলাভুমি এবং বিলের ফসলী জমি। সরকার আইন করেও থামাতে পারছেনা পুকুর খননের অভিশপ্ত কার্যক্রম। পুকুর খননের উৎসবে হারিয়ে যাচ্ছে চলনবিল এবং বিলের প্লাবনভুমি,ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র। বেড়ে উঠছে জলাবদ্ধতা। দুষিত হচ্ছে পরিবেশ। এর প্রভাবে মানুষ আক্রন্ত হচ্ছে নানারকম নতুন নতুন রোগব্যাধিতে। তাছাড়া জলাবদ্ধ জমিতেও আবাদ করতে না পেরে জমির মালিকেরা বাধ্য হচ্ছে পুকুর খনন করতে। স্থানীয় প্রশাসন বাধা দিলেও মানছেনা প্রভাবশালীরা। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং রাজনৈতিক নেতারা পুকুর মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে নিরব ভুমিকা পালন করে পুকুর খননে সহযোগীতা করছেন।চলনবিলের কৃষক, মৎসজীবি, সাধারন মানুষ, ছাত্র- শিক্ষক, পরিবেশবাদী, রাজনৈতিক কর্মী, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিল এবং ফসলী জমি ধ্বংস করে বেপরোয়া পুকুর খননের প্রতিবাদে মানববন্ধন, মাটিকাটার মেশিন জাবালিয়ে দেওয়া সহ নানা কর্মসুচিও কওে আসছেন। তারপরও বন্ধ করা যাচ্ছেনা পুকুর খননের কার্য্যক্রম। পুকুর খনন কার্য্যক্রম বন্ধ করা না গেলে অতি নিকটেই চলনবিলসহ এবং উল্লেখিত বিল ও ফসলী মুল্যবান জমি পুকুরের পেটে চলে যাবে বলে কৃষিবিদ এবং পরিবেশ বাদীরা আশংকা করছেন। আসুন আমরা সবাই ঐতিহাসিক চলনবিলসহ উল্লেখিত বিল, প্রাকৃতিক জলাভুমি, কৃষি ফসলী জমি এবং সুস্থ্যপরিবেশ রক্ষায় মরনঘাতি অশুভ পুকুর খননের বিরূদ্ধে ঐক্য গড়ে তুলে শ্লোগান দেই‘ পুকুর খননকে না বলি।’
বিজনেস বাংলাদেশ/ এ আর