০৮:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪

কাঁচামালের দাম বাড়ায় আবারও অনিশ্চয়তা পুস্তক-প্রকাশনা শিল্পে

বাংলাবাজার পুরাতন বই-পুস্তকের দোকান

করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকায় এবছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের বই কেনার ধুম পড়ে বাংলাবাজারে। এতে স্থবিরতা কাটিয়ে দীর্ঘদিন পর কিছুটা আশার আলো জ্বলে উঠে এখানকার পুস্তক-প্রকাশনা শিল্পে। তবে কাগজ ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম বাড়ায় আবারো অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে শিল্পটি ঘিরে। হিমশিম খেতে হচ্ছে শিল্পটির সাথে সংশ্লিষ্টদের লাভ ও পুঁজির হিসাব মেলাতেই।

জানা যায়, এ বছরের শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তি মৌসুমকে ঘিরে ব্যস্ততা বাড়ে বাংলাবাজারের খুচরা ও পাইকারী বই-পুস্তকের দোকানগুলোতে। ফলে বাংলাবাজারের প্রকাশনাগুলোতে আবারও কিছুটা নতুন উদ্যমের সম্ভাবনা জাগে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা মহানগর গার্লস কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, মুসলিম গভর্নমেন্ট হাই স্কুল সহ বাংলাবাজারের আশেপাশে প্রায় ২০টি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের বই কেনার একমাত্র ভরসাস্থল বাংলাবাজার হওয়ায় প্রকাশনা শিল্পে ফিরে আসে পুরনো চিত্র। তবে করোনা মহামারীর পূর্বে বই-পুস্তক বিক্রয় ও লভ্যাংশের যে অবস্থা ছিল সেই অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

বাংলাবাজারে পুরাতন বই-পুস্তকের দোকান রয়েছে প্রায় অর্ধশত। লাইব্রেরি রয়েছে শতাধিক। করোনার পূর্বে পুরাতন বইগুলোর দোকানে প্রতিদিন ১২-১৫ হাজার টাকার বই বিক্রি হত। আর লাইব্রেরিগুলোতে প্রতিদিন বিক্রি হত দেড়-দুই লাখ টাকার বই।

সম্প্রতি প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের মুদ্রণ প্রকাশনা ও প্যাকেজিং শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করার প্রস্তাব এবং প্লেট, কালি ও অন্যান্য কাঁচামালের উচ্চ দামকে ঘিরে আবারও শঙ্কায় পড়েছে মুদ্রণ শিল্প। বিপরীতে কমেছে দৈনিক বিক্রির পরিমাণ।

বাংলাবাজারের পুরাতন বইয়ের দোকানগুলোতে বর্তমানে দৈনিক এক-দেড় হাজার টাকার বই এবং লাইব্রেরিগুলোতে আট-দশ হাজার টাকার বই বিক্রি হচ্ছে। কাগজের দামের সাথে বাড়ানো হয়েছে অধিকাংশ বইয়ের দামও। যার ফলে উচ্চমূল্যে বই নিতে অনীহাও পুস্তক বিক্রি না হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিক্রেতারা।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বাংলাবাজারের পুরাতন বইয়ের তিন-চারটি দোকানে কয়েকজন শিক্ষার্থী বই কেনার জন্য এসেছেন। তবে অধিকাংশ দোকানই ছিল একদম ক্রেতাশূন্য।

লাইব্রেরিগুলোতেও ম্যানেজার আর বিক্রেতা বসে আছেন। মাঝে মধ্যে কয়েকটি লাইব্রেরিতে কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের উপস্থিতির দেখা মিলে। অনেকে আবার বইয়ের মূল্য শুনেই সেটি রেখে চলে যাচ্ছেন। চিরচেনা সেই বই কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন এবং বিক্রেতাদের ব্যস্ততা একদমই যেন নেই।

লাইব্রেরিগুলোর ভাড়া,কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতিমাসে ব্যয় হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা৷ কিন্তু বই বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় সার্বিক হিসাব মিটিয়ে টিকে থাকতেই হিমশিম খেতে লহচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাবাজারে ৩০ বছর ধরে পুরাতন বই বিক্রি করেন বিপ্লব দাস৷ তিনি বলেন, করোনার পূর্বে যে অবস্থা ছিল সেসময় মোটামুটি থেকে খেয়ে সুন্দরভাবে বাঁচা যেত। বর্তমানে সারাদিনে ক্রেতা আসে ৮-১০ জন। তাও কয়েকঘন্টা পর পর। এবছরের শুরুতে মোটামুটি ভালো বই বিক্রি হয়। তবে কাগজের মূল্য বাড়ানোর পর সেটি আর হচ্ছেনা৷ আর এখন বছরের শেষের দিকে যাচ্ছে সময়। সরকারি প্রণোদনা বা সহায়তা পেলে হয়ত ঘুরে দাঁড়ানোর কিছুটা সুযোগ হবে।

দুলাল বুক হাউসের বিক্রেতা ফরহাদ হোসেন বলেন, এখন করোনা না থাকলেও স্থবিরতা পুরোপুরি কাটেনি৷ ভালো বই বিক্রি হয়েছিল এবছরের শুরুতেই৷ কারণ তখন ভর্তি মৌসুম ছিল৷ কিন্তু এখন বই ছাপানোর সব কাঁচামাল বিশেষ করে কাগজের দাম বাড়ায় আমাদের খরচও বেড়েছে৷ তবে সে অনুযায়ী বিক্রি বাড়েনি৷ বিক্রি না বাড়লে লাভ হবেনা৷ আর এতে করে দোকানের খরচ চালিয়ে ও কর্মচারীদের বেতন দিয়ে লাভের অংশ নামমাত্র থাকে।

কাজল বুক ডিপোর ম্যানেজার সঞ্জয় সরকার বলেন, এখন বই-পুস্তক বিক্রির পরিমাণ এতটাই কমেছে যে আমাদের সব খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ কাগজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বাড়ায় বইয়ের দাম বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা এত দামে বই কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কাগজের মূল্য কমানোর উদ্যোগের পাশাপাশি প্রণোদনার সুযোগ থাকলে এই শিল্প টিকে থাকতো।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরিচালক এবং মূল্য নির্ধারনী কমিটির আহবায়ক কাজী জহুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠার জন্য আমরা চেষ্টা করছিলাম। কিছুটা সম্ভবও হয়েছিল। তবে এর মধ্যে কাগজ, প্লেট ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে যা আমাদের জন্য হতাশাজনক। বইয়ের মূল্য বৃদ্ধি করলে বিক্রি আরও কমে যাবে৷ আমরা এখনো অপেক্ষায় আছি দাম কমে কিনা সেটির জন্য৷ সহনীয় পর্যায়ে না আসলে বইয়ের দামও বৃদ্ধি করতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সহ বেশ কিছু জায়গায় দাবি জানিয়েছি কাগজের ওপর নির্ধারিত শুল্ক যেন কমানো হয়৷ তবে এখনো তেমন সাড়া পাচ্ছিনা। বাংলাবাজারের বইয়ের দোকানগুলোতে নামমাত্র বেচাকেনা হচ্ছে এখন।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব

 

জনপ্রিয়

রংপুরে রেল স্টেশনে বৈষম্য উন্নয়ন হয়নি,প্রতিবাদে অবরোধ

কাঁচামালের দাম বাড়ায় আবারও অনিশ্চয়তা পুস্তক-প্রকাশনা শিল্পে

প্রকাশিত : ০৩:৩৪:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকায় এবছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের বই কেনার ধুম পড়ে বাংলাবাজারে। এতে স্থবিরতা কাটিয়ে দীর্ঘদিন পর কিছুটা আশার আলো জ্বলে উঠে এখানকার পুস্তক-প্রকাশনা শিল্পে। তবে কাগজ ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম বাড়ায় আবারো অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে শিল্পটি ঘিরে। হিমশিম খেতে হচ্ছে শিল্পটির সাথে সংশ্লিষ্টদের লাভ ও পুঁজির হিসাব মেলাতেই।

জানা যায়, এ বছরের শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তি মৌসুমকে ঘিরে ব্যস্ততা বাড়ে বাংলাবাজারের খুচরা ও পাইকারী বই-পুস্তকের দোকানগুলোতে। ফলে বাংলাবাজারের প্রকাশনাগুলোতে আবারও কিছুটা নতুন উদ্যমের সম্ভাবনা জাগে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি কবি নজরুল কলেজ, সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা মহানগর গার্লস কলেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, মুসলিম গভর্নমেন্ট হাই স্কুল সহ বাংলাবাজারের আশেপাশে প্রায় ২০টি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের বই কেনার একমাত্র ভরসাস্থল বাংলাবাজার হওয়ায় প্রকাশনা শিল্পে ফিরে আসে পুরনো চিত্র। তবে করোনা মহামারীর পূর্বে বই-পুস্তক বিক্রয় ও লভ্যাংশের যে অবস্থা ছিল সেই অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

বাংলাবাজারে পুরাতন বই-পুস্তকের দোকান রয়েছে প্রায় অর্ধশত। লাইব্রেরি রয়েছে শতাধিক। করোনার পূর্বে পুরাতন বইগুলোর দোকানে প্রতিদিন ১২-১৫ হাজার টাকার বই বিক্রি হত। আর লাইব্রেরিগুলোতে প্রতিদিন বিক্রি হত দেড়-দুই লাখ টাকার বই।

সম্প্রতি প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের মুদ্রণ প্রকাশনা ও প্যাকেজিং শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করার প্রস্তাব এবং প্লেট, কালি ও অন্যান্য কাঁচামালের উচ্চ দামকে ঘিরে আবারও শঙ্কায় পড়েছে মুদ্রণ শিল্প। বিপরীতে কমেছে দৈনিক বিক্রির পরিমাণ।

বাংলাবাজারের পুরাতন বইয়ের দোকানগুলোতে বর্তমানে দৈনিক এক-দেড় হাজার টাকার বই এবং লাইব্রেরিগুলোতে আট-দশ হাজার টাকার বই বিক্রি হচ্ছে। কাগজের দামের সাথে বাড়ানো হয়েছে অধিকাংশ বইয়ের দামও। যার ফলে উচ্চমূল্যে বই নিতে অনীহাও পুস্তক বিক্রি না হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিক্রেতারা।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বাংলাবাজারের পুরাতন বইয়ের তিন-চারটি দোকানে কয়েকজন শিক্ষার্থী বই কেনার জন্য এসেছেন। তবে অধিকাংশ দোকানই ছিল একদম ক্রেতাশূন্য।

লাইব্রেরিগুলোতেও ম্যানেজার আর বিক্রেতা বসে আছেন। মাঝে মধ্যে কয়েকটি লাইব্রেরিতে কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকের উপস্থিতির দেখা মিলে। অনেকে আবার বইয়ের মূল্য শুনেই সেটি রেখে চলে যাচ্ছেন। চিরচেনা সেই বই কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন এবং বিক্রেতাদের ব্যস্ততা একদমই যেন নেই।

লাইব্রেরিগুলোর ভাড়া,কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতিমাসে ব্যয় হয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা৷ কিন্তু বই বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় সার্বিক হিসাব মিটিয়ে টিকে থাকতেই হিমশিম খেতে লহচ্ছে সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাবাজারে ৩০ বছর ধরে পুরাতন বই বিক্রি করেন বিপ্লব দাস৷ তিনি বলেন, করোনার পূর্বে যে অবস্থা ছিল সেসময় মোটামুটি থেকে খেয়ে সুন্দরভাবে বাঁচা যেত। বর্তমানে সারাদিনে ক্রেতা আসে ৮-১০ জন। তাও কয়েকঘন্টা পর পর। এবছরের শুরুতে মোটামুটি ভালো বই বিক্রি হয়। তবে কাগজের মূল্য বাড়ানোর পর সেটি আর হচ্ছেনা৷ আর এখন বছরের শেষের দিকে যাচ্ছে সময়। সরকারি প্রণোদনা বা সহায়তা পেলে হয়ত ঘুরে দাঁড়ানোর কিছুটা সুযোগ হবে।

দুলাল বুক হাউসের বিক্রেতা ফরহাদ হোসেন বলেন, এখন করোনা না থাকলেও স্থবিরতা পুরোপুরি কাটেনি৷ ভালো বই বিক্রি হয়েছিল এবছরের শুরুতেই৷ কারণ তখন ভর্তি মৌসুম ছিল৷ কিন্তু এখন বই ছাপানোর সব কাঁচামাল বিশেষ করে কাগজের দাম বাড়ায় আমাদের খরচও বেড়েছে৷ তবে সে অনুযায়ী বিক্রি বাড়েনি৷ বিক্রি না বাড়লে লাভ হবেনা৷ আর এতে করে দোকানের খরচ চালিয়ে ও কর্মচারীদের বেতন দিয়ে লাভের অংশ নামমাত্র থাকে।

কাজল বুক ডিপোর ম্যানেজার সঞ্জয় সরকার বলেন, এখন বই-পুস্তক বিক্রির পরিমাণ এতটাই কমেছে যে আমাদের সব খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ কাগজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বাড়ায় বইয়ের দাম বেড়েছে। কিন্তু ক্রেতারা এত দামে বই কিনতে আগ্রহ হারাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কাগজের মূল্য কমানোর উদ্যোগের পাশাপাশি প্রণোদনার সুযোগ থাকলে এই শিল্প টিকে থাকতো।

সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরিচালক এবং মূল্য নির্ধারনী কমিটির আহবায়ক কাজী জহুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠার জন্য আমরা চেষ্টা করছিলাম। কিছুটা সম্ভবও হয়েছিল। তবে এর মধ্যে কাগজ, প্লেট ও অন্যান্য কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে যা আমাদের জন্য হতাশাজনক। বইয়ের মূল্য বৃদ্ধি করলে বিক্রি আরও কমে যাবে৷ আমরা এখনো অপেক্ষায় আছি দাম কমে কিনা সেটির জন্য৷ সহনীয় পর্যায়ে না আসলে বইয়ের দামও বৃদ্ধি করতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সহ বেশ কিছু জায়গায় দাবি জানিয়েছি কাগজের ওপর নির্ধারিত শুল্ক যেন কমানো হয়৷ তবে এখনো তেমন সাড়া পাচ্ছিনা। বাংলাবাজারের বইয়ের দোকানগুলোতে নামমাত্র বেচাকেনা হচ্ছে এখন।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব