০১:০৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০২৪

রাজস্ব আহরণে ছন্দপতন, বছর শেষে লক্ষ্য পূরণ হবে-এনবিআর

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই ও আগস্টে রাজস্ব আয়ে উল্লম্ফন হলেও তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ছন্দপতন ঘটেছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণের গতি কমে গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

প্রসঙ্গত, আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আমদানি কমে আসায় রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট আহরণে তার প্রভাব পড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণে ছন্দপতন ঘটেছে।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত বিলাসী পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার পর থেকেই রাজস্ব আয় কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ কেনাকাটা কমিয়েছে। ফলে রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় খাত ভ্যাট থেকে উল্লেখযোগ্য আয় আসেনি। বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। গত আগস্টে সেটি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছেছিল।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৭ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৫৮ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে সরকারের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এনবিআরের শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এ সময়ে এনবিআর আদায় করেছে ৬৭ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। এই তিন মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৭১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।

এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বৈশ্বিক মন্দার পূর্বাভাসের কারণে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতির কিছুটা শ্লথগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। এনবিআর কর্মকর্তারা অবশ্য আশা করেন, দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য আবারও গতি পাবে। তখন রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।

আমদানি, ভ্যাট ও আয়কর- এই তিন উৎস থেকে রাজস্ব আহরণ করে এনবিআর। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান ভ্যাটের। মোট রাজস্বের ৩৯ শতাংশ আসে ভ্যাট থেকে। আয়কর থেকে আসে ৩৭ শতাংশ। বাকি রাজস্ব আসে আমদানি শুল্ক থেকে।

এনবিআর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট সবচেয়ে বেশি আদায় হয়েছে। এ খাতে আদায় ২৪ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। এই খাতে ঘাটতি হয়েছে ৯৬ কোটি টাকা। এরপর আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। আয়কর খাতে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ১০২ কোটি টাকা। এ খাতে লক্ষ্যের চেয়ে ১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা পিছিয়ে আছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব আয়ে এবার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে কমপক্ষে ৩১ শতাংশ। যদিও এনবিআরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, রাজস্ব আয়ের চলমান ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে।

মূলত, সরকার বাজেট বাস্তবায়নে যে অর্থায়ন করে তার ৮৫ থেকে ৮৬ শতাংশ জোগান দেয় এনবিআর। আর রাজস্ব আয় ভালো হলে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ সহনীয় থাকে। এতে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারেন। তাতে অর্থনীতি গতিশীল হয়।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আদায় কমে গেলে সরকার ব্যাংক থেকে বা দেশের বাইরে থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী রাজস্ব আয় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই রাজস্ব আয় আরও বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে রাজস্ব বাড়াতে বিশেষ তৎপরতা চালানোর জন্য এনবিআরকে পরামর্শ দেন তিনি।

রাজস্ব বোর্ডের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি শুল্ক খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে শুল্ক খাতে আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের এই সময়ে আদায় ছিল ১৯ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।

এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ভ্যাটে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ এই তিন মাসে ভ্যাট আদায় হয়েছে ২৪ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এই সময়ে ভ্যাট আদায় হয় ২১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।

আয়কর খাতে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আয়কর থেকে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ১০২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই খাতে আদায় হয় ১৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।

এদিকে সেপ্টেম্বর মাসেও রাজস্ব আদায়ে সামান্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই মাসে সর্বমোট ২৬ হাজার ৮৩৩ রাজস্ব আদায় হয়েছে; যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি।

গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ২৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকার রাজস্ব। গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৩২ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

সেপ্টেম্বর মাসে আমদানি শুল্ক আদায় হয়েছে ৭ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার যা গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম আর চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা কম।

সেপ্টেম্বরে ৯ হাজার ৫১৩ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আদায় হয়েছে ১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। এই আয় গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে আয়কর থেকে পাওয়া আয় লক্ষ্যমাত্রা ও গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বরে আয়কর থেকে আয় হয়েছে ৯ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২৫ কোটি টাকা বেশি। আর গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে আয়কর থেকে আদায় হয়েছিল ৯ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।

এদিকে এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এবারও আয়কর মেলা হবে না। এনবিআরের পরিচালক (জনসংযোগ) সৈয়দ এ মুমেন বলেন, এবারও আয়কর মেলা হবে না। তবে কর কার্যালয়ে রিটার্ন দেওয়ার সুবিধা দিতে নভেম্বর মাসজুড়ে সেবা মাস পালন করবে এনবিআর। তিনি উল্লেখ করেন, মেলা না হলেও আশা করা যায়, অর্থবছর শেষে রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের লক্ষ্য পূরণ হবে।

উল্লেখ্য, গত দুই বছর করোনার কারণে কর মেলা হয়নি। এবার পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক থাকায় কর মেলায় আয়কর রিটার্ন দেবেন, সেই আশায় বসেছিলেন বহু করদাতা। সাধারণ করদাতারা নভেম্বর মাস এলেই কর মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কর মেলা নিয়ে সাধারণ করদাতাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের কারণ, কর মেলায় কোনও হয়রানি হয় না। তা ছাড়া একই জায়গাতেই রিটার্ন ফরম পূরণ থেকে শুরু করে কর পরিশোধের টাকাও জমা দেওয়া যায়। কর কর্মকর্তারাও মেলায় কর দিতে আসা করদাতাদের বেশ সহযোগিতা করেন।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৩ লাখ ৩০ হাজার করদাতা রিটার্ন জমা দিয়েছেন। বর্তমানে ৭৯ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাদের সবার রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক।

আগামী ৩০ নভেম্বর জাতীয় আয়কর দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সভা-সেমিনারসহ নানা আয়োজন থাকবে। প্রতিবারের মতো এবারও জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে ১৪১ জন সেরা করদাতাকে কর কার্ড ও সম্মাননা দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে কর বিভাগ এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

বিজনেস বাংলাদেশ/ হাবিব

 

লে.কর্নেল মুনীম ফেরদৌস হলেন র‍্যাবের নতুন মুখপাত্র

রাজস্ব আহরণে ছন্দপতন, বছর শেষে লক্ষ্য পূরণ হবে-এনবিআর

প্রকাশিত : ১১:২৫:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ অক্টোবর ২০২২

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই ও আগস্টে রাজস্ব আয়ে উল্লম্ফন হলেও তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ছন্দপতন ঘটেছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণের গতি কমে গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

প্রসঙ্গত, আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আমদানি কমে আসায় রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট আহরণে তার প্রভাব পড়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আহরণে ছন্দপতন ঘটেছে।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত বিলাসী পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার পর থেকেই রাজস্ব আয় কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ কেনাকাটা কমিয়েছে। ফলে রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় খাত ভ্যাট থেকে উল্লেখযোগ্য আয় আসেনি। বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। গত আগস্টে সেটি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছেছিল।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৭ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৫৮ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে সরকারের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এনবিআরের শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এ সময়ে এনবিআর আদায় করেছে ৬৭ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। এই তিন মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৭১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।

এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বৈশ্বিক মন্দার পূর্বাভাসের কারণে দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতির কিছুটা শ্লথগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। এনবিআর কর্মকর্তারা অবশ্য আশা করেন, দ্বিতীয়ার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য আবারও গতি পাবে। তখন রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।

আমদানি, ভ্যাট ও আয়কর- এই তিন উৎস থেকে রাজস্ব আহরণ করে এনবিআর। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান ভ্যাটের। মোট রাজস্বের ৩৯ শতাংশ আসে ভ্যাট থেকে। আয়কর থেকে আসে ৩৭ শতাংশ। বাকি রাজস্ব আসে আমদানি শুল্ক থেকে।

এনবিআর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট সবচেয়ে বেশি আদায় হয়েছে। এ খাতে আদায় ২৪ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। এই খাতে ঘাটতি হয়েছে ৯৬ কোটি টাকা। এরপর আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। আয়কর খাতে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ১০২ কোটি টাকা। এ খাতে লক্ষ্যের চেয়ে ১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা পিছিয়ে আছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজস্ব আয়ে এবার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে কমপক্ষে ৩১ শতাংশ। যদিও এনবিআরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, রাজস্ব আয়ের চলমান ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে।

মূলত, সরকার বাজেট বাস্তবায়নে যে অর্থায়ন করে তার ৮৫ থেকে ৮৬ শতাংশ জোগান দেয় এনবিআর। আর রাজস্ব আয় ভালো হলে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ সহনীয় থাকে। এতে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারেন। তাতে অর্থনীতি গতিশীল হয়।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজস্ব আদায় কমে গেলে সরকার ব্যাংক থেকে বা দেশের বাইরে থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী রাজস্ব আয় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই রাজস্ব আয় আরও বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে রাজস্ব বাড়াতে বিশেষ তৎপরতা চালানোর জন্য এনবিআরকে পরামর্শ দেন তিনি।

রাজস্ব বোর্ডের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি শুল্ক খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রথম তিন মাসে শুল্ক খাতে আদায় হয়েছে ২২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের এই সময়ে আদায় ছিল ১৯ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।

এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ভ্যাটে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ এই তিন মাসে ভ্যাট আদায় হয়েছে ২৪ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এই সময়ে ভ্যাট আদায় হয় ২১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।

আয়কর খাতে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আয়কর থেকে আদায় হয়েছে ২০ হাজার ১০২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই খাতে আদায় হয় ১৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।

এদিকে সেপ্টেম্বর মাসেও রাজস্ব আদায়ে সামান্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই মাসে সর্বমোট ২৬ হাজার ৮৩৩ রাজস্ব আদায় হয়েছে; যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি।

গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ২৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকার রাজস্ব। গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৩২ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

সেপ্টেম্বর মাসে আমদানি শুল্ক আদায় হয়েছে ৭ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার যা গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম আর চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা কম।

সেপ্টেম্বরে ৯ হাজার ৫১৩ কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আদায় হয়েছে ১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। এই আয় গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে আয়কর থেকে পাওয়া আয় লক্ষ্যমাত্রা ও গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বরে আয়কর থেকে আয় হয়েছে ৯ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২৫ কোটি টাকা বেশি। আর গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে আয়কর থেকে আদায় হয়েছিল ৯ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।

এদিকে এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এবারও আয়কর মেলা হবে না। এনবিআরের পরিচালক (জনসংযোগ) সৈয়দ এ মুমেন বলেন, এবারও আয়কর মেলা হবে না। তবে কর কার্যালয়ে রিটার্ন দেওয়ার সুবিধা দিতে নভেম্বর মাসজুড়ে সেবা মাস পালন করবে এনবিআর। তিনি উল্লেখ করেন, মেলা না হলেও আশা করা যায়, অর্থবছর শেষে রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের লক্ষ্য পূরণ হবে।

উল্লেখ্য, গত দুই বছর করোনার কারণে কর মেলা হয়নি। এবার পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক থাকায় কর মেলায় আয়কর রিটার্ন দেবেন, সেই আশায় বসেছিলেন বহু করদাতা। সাধারণ করদাতারা নভেম্বর মাস এলেই কর মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কর মেলা নিয়ে সাধারণ করদাতাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের কারণ, কর মেলায় কোনও হয়রানি হয় না। তা ছাড়া একই জায়গাতেই রিটার্ন ফরম পূরণ থেকে শুরু করে কর পরিশোধের টাকাও জমা দেওয়া যায়। কর কর্মকর্তারাও মেলায় কর দিতে আসা করদাতাদের বেশ সহযোগিতা করেন।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৩ লাখ ৩০ হাজার করদাতা রিটার্ন জমা দিয়েছেন। বর্তমানে ৭৯ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাদের সবার রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক।

আগামী ৩০ নভেম্বর জাতীয় আয়কর দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সভা-সেমিনারসহ নানা আয়োজন থাকবে। প্রতিবারের মতো এবারও জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে ১৪১ জন সেরা করদাতাকে কর কার্ড ও সম্মাননা দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে কর বিভাগ এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

বিজনেস বাংলাদেশ/ হাবিব