১০:৩৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

বাংলা সাহিত্যে ভাইরাল রোগ, প্রকৃত লেখক লেখিকাদের জন্য অশনি সংকেত

  • আল সাদি
  • প্রকাশিত : ০৬:১৯:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
  • 371

ছোটবেলায় জ্ঞান হওয়ার পর থেকে লেখক হিসেবে চিনতাম হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, জাফর ইকবাল, কবি নির্মলেন্দু গুণ সহ অনেককে। কারন ছোটবেলায় দেখেছিলাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে আমার দাদার ঘরে ছিলো ছোট্র একটি লাইব্রেরী। যেখানে প্রতিটা তাকে তাকে সাজানো ছিলো এ-ই সকল লেখকদের বই। তবে সেই সময়কার লেখকেরা যেসকল বই লিখতেন তার সাথে বর্তমান এই আকাশ সংস্কৃতির যুগের লেখকদের বইয়ের আকাশ পাতাল তফাত। বর্তমানে সোশাল মিডিয়ার কল্যানে আমাদের সকলেরই একটি শব্দের সাথে বেশ পরিচয়, সেটি হচ্ছে ‘ভাইরাল’ এই ভাইরাল হওয়ার জন্য মানুষ কতো কি-ই-বা না করে। কেউ কেউ ভাইরাল হওয়ার জন্য নিজের জীবনকে বিপদে ফেলে আবার কেউ কেউ নিজেকে হাসির খোড়াক বানিয়ে ভাইরাল হয়ে আনন্দিত হয়। বর্তমানে যোগ্য-দক্ষ, জ্ঞানী-গুণী হওয়া নয়, সোসাল মিডিয়া নির্ভর নতুন একটা সম্প্রদায় তৈরি হয়েছে, যাদের একমাত্র ধান্দা হলো বিখ্যাত হওয়া, আলোচিত হওয়া, ভাইরাল হওয়া। বিখ্যাত ও আলোচিত হতে তাদের মধ্যে সব সময় একটা ছটফটানি কাজ করে। তারা সারাক্ষণ খবর হতে চায়, আলোচনায় থাকতে চায়। অন্যের মাথা ফাটাতে না পারলে এরা নিজের মাথা নিজে ফাটিয়ে হলেও খবরের শিরোনাম হয়। আবার ভাইরাল হওয়াটাই অনেকের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয় থাকে। কিছুদিন আগে ফেসবুক স্ক্রলিং করতে করতে একবার দেখেছিলাম, সদ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এক তরুণীকে একজন সাংবাদিক জিগ্যেস করেছেন যে, ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?’ উত্তরে সে বলেছিল, ‘ভাইরাল হওয়া।’

যদি গভীরভাবে চিন্তা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, যাচ্ছেতাই করে ভাইরাল হওয়ার এই সংস্কৃতি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধীরে ধীরে একগুঁয়ে করে তুলছে, ভিন্ন এক সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, ক্রমেই পড়াশোনা, পরিবার ও সভ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, নিজেদের আত্মসম্মানবোধ হারাচ্ছে। সেই সাথে হারাচ্ছে চক্ষুলজ্জা, ব্যক্তিত্ব ও পারিবারিক সম্মান।

সাম্প্রতিক সময়ের অমর একুশে বইমেলার দিকে একটু নজর দিলেই দেখা যায় ভাষার মাসে আমাদের প্রাণের বইমেলাতেও লেগেছে ভাইরাল রোগের ছুঁয়া। যে রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন লেখক-লেখিকাও। সোসাল মিডিয়াতে যে ব্যক্তিই ভাইরাল হচ্ছেন হাসি-ঠাট্টার খোঁড়াক হচ্ছেন তার পেছনেই ঘুরছে আমাদের প্রকাশনীগুলো। তাদের পেছন পেছন ঘুরঘুর করে তাদেরকে দিয়ে লেখাচ্ছেন অখাদ্য কিছু বই। যা আলোচিতও হচ্ছে সোসাল মিডিয়ার। তবে বাস্তব জীবনে সে সকল বইয়ের কোনো মূল্য নেই। নাই বা আছে শেখার কিছু বা জানার।

আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যেকের‌ই মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভাইরাল লেখকেরা হচ্ছেন মুড়ি-মুড়কির মতো। আজ আছে তো কাল নেই। ভাইরাল লেখক-লেখিকাদের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত লেখকেরা। বর্তমান সময়ে লেখক-পাঠক উভয়েই ভাইরাল হতে চায়। যেসকল প্রকাশকেরা ভাইরাল ব্যক্তিদের দিয়ে বই লিখে ছাপিয়ে থাকেন তারা হচ্ছে ‘সিজনাল পাবলিশার’ যারা মূলত নিজেদের প্রচারনার জন্য এগুলো করে থাকেন। এবছর অমর একুশে বইমেলায় গেলেই দেখা মিলবে সারি সারি ফেসবুক সেলেব্রিটিদের বই। তাদের স্টলগুলোও বেশ উপচে পড়া ভিড় কারন সেখানে রয়েছে মিডিয়া কাভারেজ। যেকোনো বক্তব্য দিলেই সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল সেই ইচ্ছে থেকেই পাঠকেরা ধুঁকছেন ভাইরাল লেখকদের স্টলে। বই মেলায় মৌসুমি ব্যবসায়িদের নিয়ো বাংলাদেশের একজন চলচিত্র অভিনেতা জায়েদ খান তিনি সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘যে কিছু প্রকাশনী আছে, যারা ভাইরাল হওয়া ব্যক্তিদের ধরে বই প্রকাশ করায়। এখানে শুধু তারা ব্যবসা করে। কারণ এসব প্রকাশনী কেউ ভাইরাল হলেই তার বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দিয়ে বই প্রকাশ করে।’

যেকোনো শিল্পের বিকাশে কালচারাল কনজুমারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে উন্মার্গগামী শিল্পকে সঠিক পথে আনতে একদল রুচিশীল পাঠক/শ্রোতা/দর্শক অকল্পনীয় ভূমিকা রাখেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটাও ঘটে,যেমন রুচিশীল ভোক্তার অভাবে শিল্পের নিয়ন্ত্রকরা অখাদ্যকে উঁচুমানের কোনকিছু হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করেন আর শিল্পের প্রকৃত স্বাদ না জানা একশ্রেণির ভোক্তারা ওই অখাদ্যকেই হাপুস-হুপুস করে গিলতে থাকে যার মধ্য দিয়ে একটি শিল্পের কফিনে পেরেক ঠোকা শুরু হয়। বই মেলায় আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বই মেলায় যায়। তবে তাদের মাঝে অনেকেই বলতে পারেনা ভাষা আন্দোলন কত সালে হয়েছে। বলতে পারেনা কোনো ভাষা শহীদের নাম। তবে কি এভাবেই ভাইরালের ভিড়ে হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের ইতিহাস?

আজ থেকে হাজার বছরের বেশি সময় আগে সূচিত হওয়া বাংলা সাহিত্যের এই পথচলা আপন গতিতে চলতে থাকুক। আবারো শৃঙ্খলে ফিরে আসুক বাংলা সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্য ধ্বংস করা প্রকাশক নামক রাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা মিলুক পাঠকদের। আমাদের বইমেলায় আসুক ভালো ভালো লেখক-লেখিকাদের বই যা থেকে আমাদের তরুণ প্রজন্ম ভালো কিছু শিখতে ও জানতে পারবে। বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে।

লেখক : আল সাদি, সাংবাদিক ও কলাম লেখক
ই-মেইল : [email protected]

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ

বাংলা সাহিত্যে ভাইরাল রোগ, প্রকৃত লেখক লেখিকাদের জন্য অশনি সংকেত

প্রকাশিত : ০৬:১৯:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

ছোটবেলায় জ্ঞান হওয়ার পর থেকে লেখক হিসেবে চিনতাম হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, জাফর ইকবাল, কবি নির্মলেন্দু গুণ সহ অনেককে। কারন ছোটবেলায় দেখেছিলাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে আমার দাদার ঘরে ছিলো ছোট্র একটি লাইব্রেরী। যেখানে প্রতিটা তাকে তাকে সাজানো ছিলো এ-ই সকল লেখকদের বই। তবে সেই সময়কার লেখকেরা যেসকল বই লিখতেন তার সাথে বর্তমান এই আকাশ সংস্কৃতির যুগের লেখকদের বইয়ের আকাশ পাতাল তফাত। বর্তমানে সোশাল মিডিয়ার কল্যানে আমাদের সকলেরই একটি শব্দের সাথে বেশ পরিচয়, সেটি হচ্ছে ‘ভাইরাল’ এই ভাইরাল হওয়ার জন্য মানুষ কতো কি-ই-বা না করে। কেউ কেউ ভাইরাল হওয়ার জন্য নিজের জীবনকে বিপদে ফেলে আবার কেউ কেউ নিজেকে হাসির খোড়াক বানিয়ে ভাইরাল হয়ে আনন্দিত হয়। বর্তমানে যোগ্য-দক্ষ, জ্ঞানী-গুণী হওয়া নয়, সোসাল মিডিয়া নির্ভর নতুন একটা সম্প্রদায় তৈরি হয়েছে, যাদের একমাত্র ধান্দা হলো বিখ্যাত হওয়া, আলোচিত হওয়া, ভাইরাল হওয়া। বিখ্যাত ও আলোচিত হতে তাদের মধ্যে সব সময় একটা ছটফটানি কাজ করে। তারা সারাক্ষণ খবর হতে চায়, আলোচনায় থাকতে চায়। অন্যের মাথা ফাটাতে না পারলে এরা নিজের মাথা নিজে ফাটিয়ে হলেও খবরের শিরোনাম হয়। আবার ভাইরাল হওয়াটাই অনেকের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয় থাকে। কিছুদিন আগে ফেসবুক স্ক্রলিং করতে করতে একবার দেখেছিলাম, সদ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এক তরুণীকে একজন সাংবাদিক জিগ্যেস করেছেন যে, ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য কী?’ উত্তরে সে বলেছিল, ‘ভাইরাল হওয়া।’

যদি গভীরভাবে চিন্তা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে, যাচ্ছেতাই করে ভাইরাল হওয়ার এই সংস্কৃতি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধীরে ধীরে একগুঁয়ে করে তুলছে, ভিন্ন এক সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে, ক্রমেই পড়াশোনা, পরিবার ও সভ্য সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, নিজেদের আত্মসম্মানবোধ হারাচ্ছে। সেই সাথে হারাচ্ছে চক্ষুলজ্জা, ব্যক্তিত্ব ও পারিবারিক সম্মান।

সাম্প্রতিক সময়ের অমর একুশে বইমেলার দিকে একটু নজর দিলেই দেখা যায় ভাষার মাসে আমাদের প্রাণের বইমেলাতেও লেগেছে ভাইরাল রোগের ছুঁয়া। যে রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন লেখক-লেখিকাও। সোসাল মিডিয়াতে যে ব্যক্তিই ভাইরাল হচ্ছেন হাসি-ঠাট্টার খোঁড়াক হচ্ছেন তার পেছনেই ঘুরছে আমাদের প্রকাশনীগুলো। তাদের পেছন পেছন ঘুরঘুর করে তাদেরকে দিয়ে লেখাচ্ছেন অখাদ্য কিছু বই। যা আলোচিতও হচ্ছে সোসাল মিডিয়ার। তবে বাস্তব জীবনে সে সকল বইয়ের কোনো মূল্য নেই। নাই বা আছে শেখার কিছু বা জানার।

আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যেকের‌ই মতামত পোষণ এবং মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভাইরাল লেখকেরা হচ্ছেন মুড়ি-মুড়কির মতো। আজ আছে তো কাল নেই। ভাইরাল লেখক-লেখিকাদের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃত লেখকেরা। বর্তমান সময়ে লেখক-পাঠক উভয়েই ভাইরাল হতে চায়। যেসকল প্রকাশকেরা ভাইরাল ব্যক্তিদের দিয়ে বই লিখে ছাপিয়ে থাকেন তারা হচ্ছে ‘সিজনাল পাবলিশার’ যারা মূলত নিজেদের প্রচারনার জন্য এগুলো করে থাকেন। এবছর অমর একুশে বইমেলায় গেলেই দেখা মিলবে সারি সারি ফেসবুক সেলেব্রিটিদের বই। তাদের স্টলগুলোও বেশ উপচে পড়া ভিড় কারন সেখানে রয়েছে মিডিয়া কাভারেজ। যেকোনো বক্তব্য দিলেই সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল সেই ইচ্ছে থেকেই পাঠকেরা ধুঁকছেন ভাইরাল লেখকদের স্টলে। বই মেলায় মৌসুমি ব্যবসায়িদের নিয়ো বাংলাদেশের একজন চলচিত্র অভিনেতা জায়েদ খান তিনি সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘যে কিছু প্রকাশনী আছে, যারা ভাইরাল হওয়া ব্যক্তিদের ধরে বই প্রকাশ করায়। এখানে শুধু তারা ব্যবসা করে। কারণ এসব প্রকাশনী কেউ ভাইরাল হলেই তার বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দিয়ে বই প্রকাশ করে।’

যেকোনো শিল্পের বিকাশে কালচারাল কনজুমারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে উন্মার্গগামী শিল্পকে সঠিক পথে আনতে একদল রুচিশীল পাঠক/শ্রোতা/দর্শক অকল্পনীয় ভূমিকা রাখেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটাও ঘটে,যেমন রুচিশীল ভোক্তার অভাবে শিল্পের নিয়ন্ত্রকরা অখাদ্যকে উঁচুমানের কোনকিছু হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করেন আর শিল্পের প্রকৃত স্বাদ না জানা একশ্রেণির ভোক্তারা ওই অখাদ্যকেই হাপুস-হুপুস করে গিলতে থাকে যার মধ্য দিয়ে একটি শিল্পের কফিনে পেরেক ঠোকা শুরু হয়। বই মেলায় আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ বই মেলায় যায়। তবে তাদের মাঝে অনেকেই বলতে পারেনা ভাষা আন্দোলন কত সালে হয়েছে। বলতে পারেনা কোনো ভাষা শহীদের নাম। তবে কি এভাবেই ভাইরালের ভিড়ে হারিয়ে যাবে বাংলাদেশের ইতিহাস?

আজ থেকে হাজার বছরের বেশি সময় আগে সূচিত হওয়া বাংলা সাহিত্যের এই পথচলা আপন গতিতে চলতে থাকুক। আবারো শৃঙ্খলে ফিরে আসুক বাংলা সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্য ধ্বংস করা প্রকাশক নামক রাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা মিলুক পাঠকদের। আমাদের বইমেলায় আসুক ভালো ভালো লেখক-লেখিকাদের বই যা থেকে আমাদের তরুণ প্রজন্ম ভালো কিছু শিখতে ও জানতে পারবে। বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে।

লেখক : আল সাদি, সাংবাদিক ও কলাম লেখক
ই-মেইল : [email protected]

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ