০৯:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫

আইসিইউ খুঁজতে খুঁজতে আঠার ঘন্টা অতঃপর মৃত্যু

সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট উত্তর সলিমপুরের নেওয়াজ সারাং বাড়ির তৌহিদুল আনোয়ার আরজুর স্ত্রী গৃহবধু মুক্তার সাতদিন পর ছিল বাচ্চা ডেলিভারির তারিখ । এরি মধ্যেই দেখা দিল প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট।
পেটে অনাগত সেই বাচ্চা নিয়ে গৃহবধূ কে তার স্বামীও স্বজনরা নিয়ে দিনভর ঘুরলেন চট্টগ্রামের সকল বেসরকারি ক্লিনিক ও এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে।
টানা ১৮ ঘন্টা চেষ্টা করেও পুরো চট্টগ্রামে মেলেনি একটি আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। শেষে অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই গভীর রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ১০ মাসের গর্ভবতী ওই নারী।
মাত্র এক সপ্তাহ পর, ১৮ জুন বাচ্চাটি পৃথিবীতে আসার সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত ছিল । ফৌজদারহাটের কবরস্থানে মায়ের সঙ্গী হল ওই অনাগত সন্তানটি ও।
মঙ্গলবার (৯ জুন) সকাল থেকে ৩০ বছর বয়সী ওই গর্ভবতী নারীর জন্য তার স্বজনরা চট্টগ্রামের এমন কোনো হাসপাতাল বাদ রাখেননি, যেখানে তারা একটি আইসিইউ বেডের খোঁজে যাননি।
কোথাও না পেয়ে নিরোপায় হয়ে স্বজনরা ফেসবুকে স্ট্যাটার্স দিয়ে একটি আইসিইউর জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ ও করেছেন। হাসপাতাল আর ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ডে দৌড়াদৌড়ি করে মঙ্গলবার (১০ জুন) দিবাগত রাত ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের করোনা ওয়ার্ডে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মুক্তা (৩০) নামের ওই নারী।
অথচ আট দিন আগে করোনার সময়ে সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে প্রসূতি মায়েদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনা পরীক্ষাসহ অন্যান্য সুচিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্নিষ্ট বিবাদীদের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল।
মঙ্গলবার (৯ জুন) সারাদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে মুক্তার ভাই সোলাইমান রনি বলেন, ‘মঙ্গলবার সকালে আমার বোনের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সকাল ৯ টার দিকে তাকে আমরা প্রথমে আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাই।
তার শ্বাসকষ্ট দেখামাত্রই তারা সেখানে তাকে ভর্তি নিতে পারবে না বলে জানায়। আমরা অনেক অনুরোধ করার পর তারা বলে ঠিক আছে প্রথমে উনার এক্সরে করিয়ে আনেন। তারপর ভর্তি নেবো।
ওই অবস্থায় চিকিৎসা না দিয়ে তাকে নিয়ে আমাদের এক্সরে করতে ছুটতে হয়েছে। অনেক কষ্টে যখন এক্সরে রিপোর্ট পেলাম, রিপোর্ট দেখে তারা জানায় আপুর আইসিইউ লাগবে।
তারা সাফ জানিয়ে দেয় তাদের আইসিইউ নেই। অথচ আমরা ওই হাসপাতালেরই এক পরিচিত সূত্রে জেনেছি, তাদের আইসিইউ সিট ছিল।
শুধুমাত্র করোনা সন্দেহে আপুকে তারা আইসিইউ দিচ্ছিল না।’ মা ও শিশু হাসপাতালে আর চিকিৎসা মিলবে না— এটি নিশ্চিত হয়ে মুক্তার পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
১০ মাসের গর্ভবতী জেনেও সেখানে মুক্তাকে ভর্তি নেওয়া হয় করোনা ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড থেকে তাকে আইসিইউতে রেফার করা হলেও সেখানেও বলে দেওয়া হয়— আইসিইউতে সিট খালি নেই।
চোখের সামনে অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকলে মুক্তার স্বামী ও ভাই আইসিইউতে ছুটে গিয়ে অনুরোধ জানান, ‘এক ঘন্টার জন্য হলেও তাকে একটা আইসিইউতে রেখে আবার ওয়ার্ডে ফিরিয়ে নেওয়া যায় কিনা।’কোন সাড়া মিলেনি।
জীবন ও হাসপাতালের সঙ্গে সারাদিনের যুদ্ধ শেষে বিনা চিকিৎসায় এভাবেই মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগোতে থাকেন মুক্তা। শেষে রাত ৪টার দিকে মারা যান তিনি। শেষ হয় মুক্তা ও তার অনাগত সন্তানের ১৮ ঘন্টার যুগপৎ লড়াই।
করোনা সন্দেহে এমন নির্মম ভোগান্তির শিকার হলেও মুক্তার ভাই রনি জানান, ‘আমার আপুর দুই ছেলে-মেয়ে। আগেরবারও তার বাচ্চা হওয়ার পর এরকম শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। সেবার তো করোনা ছিল না। সে চিকিৎসাও পেয়েছিল। বেঁচেও ফিরেছিল। এবারেই শুধু চিকিৎসার অভাবে আর পারলো না।’
জানা গেছে, গর্ভের ১০ মাসের বাচ্চাসহ মা-সন্তান দুজনকেই মৃত ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার। বুধবার (১০ জুন) সকাল ১১টায় গর্ভের সন্তানসহ ফৌজদারহাটের শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
মৃত মুক্তার স্বামী তৌহিদুল আনোয়ার আরজু বলেন আল্লাহর ইচছাই যা হারানোর হারিয়েছি আপনারা সকলে আমাদের দুই সন্তানের জন্য দোয়া করবেন। আমার মাসুম বাচ্চাদের মত যেন আর কারো মা এভাবে বিনা চিকিৎসা মারা না যাই।
একজন গর্ভবতী নারীর এমন শ্বাসকষ্ট হলে কী করণীয়— এই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল একজন নামকরা গাইনি বিশেষজ্ঞের সাথে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘শ্বাসকষ্টের কারণটা দেখতে হবে। প্রসব বেদনার সাথে যদি রক্তচাপ বেশি থাকে তাহলে এমন হতে পারে। এ সময় ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়।
এরকম হলে তো বাচ্চা বের করতে হবে। না হলে তো শ্বাসকষ্ট কমবে না। তবে অন্য কোন ব্যাপার থাকলে সেটা ভিন্ন বিষয়। আর ১৮ জুন ডেলিভারি ডেইট হওয়া মানে তো বাচ্চা ম্যাচিউরড হয়ে গিয়েছিল।’
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘এই বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।

 

জনপ্রিয়

আইসিইউ খুঁজতে খুঁজতে আঠার ঘন্টা অতঃপর মৃত্যু

প্রকাশিত : ০৪:৫৫:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ জুন ২০২০
সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট উত্তর সলিমপুরের নেওয়াজ সারাং বাড়ির তৌহিদুল আনোয়ার আরজুর স্ত্রী গৃহবধু মুক্তার সাতদিন পর ছিল বাচ্চা ডেলিভারির তারিখ । এরি মধ্যেই দেখা দিল প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট।
পেটে অনাগত সেই বাচ্চা নিয়ে গৃহবধূ কে তার স্বামীও স্বজনরা নিয়ে দিনভর ঘুরলেন চট্টগ্রামের সকল বেসরকারি ক্লিনিক ও এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে।
টানা ১৮ ঘন্টা চেষ্টা করেও পুরো চট্টগ্রামে মেলেনি একটি আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)। শেষে অনেকটা বিনা চিকিৎসাতেই গভীর রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ১০ মাসের গর্ভবতী ওই নারী।
মাত্র এক সপ্তাহ পর, ১৮ জুন বাচ্চাটি পৃথিবীতে আসার সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত ছিল । ফৌজদারহাটের কবরস্থানে মায়ের সঙ্গী হল ওই অনাগত সন্তানটি ও।
মঙ্গলবার (৯ জুন) সকাল থেকে ৩০ বছর বয়সী ওই গর্ভবতী নারীর জন্য তার স্বজনরা চট্টগ্রামের এমন কোনো হাসপাতাল বাদ রাখেননি, যেখানে তারা একটি আইসিইউ বেডের খোঁজে যাননি।
কোথাও না পেয়ে নিরোপায় হয়ে স্বজনরা ফেসবুকে স্ট্যাটার্স দিয়ে একটি আইসিইউর জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ ও করেছেন। হাসপাতাল আর ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ডে দৌড়াদৌড়ি করে মঙ্গলবার (১০ জুন) দিবাগত রাত ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের করোনা ওয়ার্ডে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মুক্তা (৩০) নামের ওই নারী।
অথচ আট দিন আগে করোনার সময়ে সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে প্রসূতি মায়েদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনা পরীক্ষাসহ অন্যান্য সুচিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্নিষ্ট বিবাদীদের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল।
মঙ্গলবার (৯ জুন) সারাদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে মুক্তার ভাই সোলাইমান রনি বলেন, ‘মঙ্গলবার সকালে আমার বোনের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সকাল ৯ টার দিকে তাকে আমরা প্রথমে আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাই।
তার শ্বাসকষ্ট দেখামাত্রই তারা সেখানে তাকে ভর্তি নিতে পারবে না বলে জানায়। আমরা অনেক অনুরোধ করার পর তারা বলে ঠিক আছে প্রথমে উনার এক্সরে করিয়ে আনেন। তারপর ভর্তি নেবো।
ওই অবস্থায় চিকিৎসা না দিয়ে তাকে নিয়ে আমাদের এক্সরে করতে ছুটতে হয়েছে। অনেক কষ্টে যখন এক্সরে রিপোর্ট পেলাম, রিপোর্ট দেখে তারা জানায় আপুর আইসিইউ লাগবে।
তারা সাফ জানিয়ে দেয় তাদের আইসিইউ নেই। অথচ আমরা ওই হাসপাতালেরই এক পরিচিত সূত্রে জেনেছি, তাদের আইসিইউ সিট ছিল।
শুধুমাত্র করোনা সন্দেহে আপুকে তারা আইসিইউ দিচ্ছিল না।’ মা ও শিশু হাসপাতালে আর চিকিৎসা মিলবে না— এটি নিশ্চিত হয়ে মুক্তার পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
১০ মাসের গর্ভবতী জেনেও সেখানে মুক্তাকে ভর্তি নেওয়া হয় করোনা ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড থেকে তাকে আইসিইউতে রেফার করা হলেও সেখানেও বলে দেওয়া হয়— আইসিইউতে সিট খালি নেই।
চোখের সামনে অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকলে মুক্তার স্বামী ও ভাই আইসিইউতে ছুটে গিয়ে অনুরোধ জানান, ‘এক ঘন্টার জন্য হলেও তাকে একটা আইসিইউতে রেখে আবার ওয়ার্ডে ফিরিয়ে নেওয়া যায় কিনা।’কোন সাড়া মিলেনি।
জীবন ও হাসপাতালের সঙ্গে সারাদিনের যুদ্ধ শেষে বিনা চিকিৎসায় এভাবেই মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগোতে থাকেন মুক্তা। শেষে রাত ৪টার দিকে মারা যান তিনি। শেষ হয় মুক্তা ও তার অনাগত সন্তানের ১৮ ঘন্টার যুগপৎ লড়াই।
করোনা সন্দেহে এমন নির্মম ভোগান্তির শিকার হলেও মুক্তার ভাই রনি জানান, ‘আমার আপুর দুই ছেলে-মেয়ে। আগেরবারও তার বাচ্চা হওয়ার পর এরকম শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। সেবার তো করোনা ছিল না। সে চিকিৎসাও পেয়েছিল। বেঁচেও ফিরেছিল। এবারেই শুধু চিকিৎসার অভাবে আর পারলো না।’
জানা গেছে, গর্ভের ১০ মাসের বাচ্চাসহ মা-সন্তান দুজনকেই মৃত ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার। বুধবার (১০ জুন) সকাল ১১টায় গর্ভের সন্তানসহ ফৌজদারহাটের শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
মৃত মুক্তার স্বামী তৌহিদুল আনোয়ার আরজু বলেন আল্লাহর ইচছাই যা হারানোর হারিয়েছি আপনারা সকলে আমাদের দুই সন্তানের জন্য দোয়া করবেন। আমার মাসুম বাচ্চাদের মত যেন আর কারো মা এভাবে বিনা চিকিৎসা মারা না যাই।
একজন গর্ভবতী নারীর এমন শ্বাসকষ্ট হলে কী করণীয়— এই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল একজন নামকরা গাইনি বিশেষজ্ঞের সাথে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘শ্বাসকষ্টের কারণটা দেখতে হবে। প্রসব বেদনার সাথে যদি রক্তচাপ বেশি থাকে তাহলে এমন হতে পারে। এ সময় ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়।
এরকম হলে তো বাচ্চা বের করতে হবে। না হলে তো শ্বাসকষ্ট কমবে না। তবে অন্য কোন ব্যাপার থাকলে সেটা ভিন্ন বিষয়। আর ১৮ জুন ডেলিভারি ডেইট হওয়া মানে তো বাচ্চা ম্যাচিউরড হয়ে গিয়েছিল।’
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘এই বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।