০৬:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

স্বাধীনতার মাপকাঠিতে আমরা কতটুকু স্বাধীন?

“সারা জীবন তুমি আমায় এত স্বাধীনতা দিয়েছ”, ” তোমার স্বাধীনতা কি আমার পকেটে থাকে যে মাঝে মাঝে বের করে দেব? তোমার স্বাধীনতা তোমারই বস্তু।”

কয়েকদিন আগে পড়া একটি উপন্যাসে এক দম্পতির কথোপকথন এটি। পুরো উপন্যাসটা পড়ার সময় স্বাভাবিক লাগলেও এইটুকু পড়ার সময় মনে হয়েছিল রূপকথার গল্প পড়ছি। কারণ এখনো অন্তত আমি যে সমাজে বাস করি সেখানে অধিকাংশ পুরুষই নারীদের স্বাধীনতাকে তাদের, পকেটের রুমাল মনে করে। ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যবইয়ে একটা কথা পড়ে এসেছি এরকম যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিরোধীদলীয় নেতা নারী সুতরাং এটা নারী ক্ষমতায়নের এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরন। কিন্তু নিজের চোখেই দেখেছি নারী প্রধান এমন দলের রাজনীতি করা ব্যক্তিও তার অধীনস্ত নারীকে “তুমি মাইয়া মানুষ তুমি কি বুঝবা” ধরণের কথা শুনাতে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নারীরা কতটুকু স্বাধীন? এই প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই কারণ স্বাধীনতা মাপার কোন বিশ্বজনীন মাপকাঠি নেই। কাগজে কলমে মোটামুটি স্বাধীনতার সংজ্ঞা এক হলেও সমাজভেদে স্বাধীনতার মানদন্ড আলাদা। আমেরিকার সমাজে নারীর স্বাধীনতা বলে যা স্বীকৃত তা বাংলাদেশের সমাজে হয়ত স্বীকৃতি দেয় না। আবার রাষ্ট্র আইনগতভাবে যা স্বীকৃতি দিয়েছে তা হয়ত সমাজ বাস্তবায়ন করতে দেয় না। সে যাই হোক, সেই বেগম রোকেয়া, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় দের হাত ধরে বাংলার নারী সমাজের জাগরনের যে সূচনা হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই অনেক স্বাধীনতা পেয়েছে। এখন কন্যা শিশু হলেও অনেক বাবা খুশি হন, মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, কলেজ ভার্সিটিতেও পড়ছে, সব পেশায়ই কমবেশি নারী কাজ করছে এমনকি যে কাজ মেয়েদের না বলে স্বীকৃত ছিল তাতেও তারা মেধার স্বাক্ষর রাখছে।নানারকম বৈষম্য, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সমাজের শ্যেন দৃষ্টি সহ্য করেও মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের, পরিবারের ও সর্বোপরি দেশের ভাগ্যোন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

আমাদের সমাজ লিঙ্গ ভিত্তিক যে আচরনবিধি এবং কাজ নির্ধারন করে রাখে, যথাযথ সুযোগ পেলেই নারীরা তা ভুল প্রমান করে দেখাচ্ছে। কোন ব্যক্তির নিজের স্বতন্ত্র মতপ্রকাশ, চিন্তা বা কর্মের ক্ষমতা বা অধিকার থাকাকেই স্বাধীনতা বলা যেতে পারে। অথবা বলা যেতে পারে, স্বাধীনতা নৈতিক দায়িত্ব দ্বারা ভারসাম্যপূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। অনেকেই স্বাধীনতার কোন সীমা আছে বলে মানতে চান না আবার অনেকেই নানা নিয়মের দ্বারা স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতা থেকে আলাদা করতে চান। সংজ্ঞা যাই হোক, একজনের স্বাধীনতার চর্চা যতক্ষন পর্যন্ত অন্য আরেকজনের স্বাধীনতায় অন্তরায় না হয় সেটাই কাম্য। তবে পৃথিবীতে মানুষই মনেহয় একমাত্র প্রানী যার স্বাধীনতা হামেশাই মানুষের হাতেই খর্ব হয়।সবলের স্বেচ্ছাচারিতা সর্বত্রই দুর্বলের স্বাধীনতা পদদলিত করে। ইংরেজীতে একটা কথা প্রচলিত আছে, “A rusty lock might be oiled so that the key has the freedom to turn.” নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত করতেও জং ধরা সব সিস্টেমকে পরিবর্তন করতে হবে- শুধু নারী নয়, গোটা মানবজাতীর ভালর জন্য।

স্বাধীনতা সব মানুষের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ তাহলে কেন আমরা নারী স্বাধীনতা নিয়ে আলাদা ভাবে কথা বলছি? কেন গোটা মানব জাতীর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছি না? কারণ, এমন কিছু সমস্যা আছে যেগুলা শুধুমাত্র নারীদেরকেই ভোগ করতে হয় এবং এই সমস্যা গুলো নারী স্বাধীনতার প্রধান অন্তরায়। যেমন ধর্ষন এবং যৌন হয়রানি। যেহেতু এখনে পর্যন্ত নারীরাই ধর্ষনের মূল শিকার এবং যৌন হয়রানির আশঙ্কায় অনেক নারীই এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিচরন করতে পারে না, সেহেতু নারীর স্বাধীনতা নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক পুলিশের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু বরন করেন। যার ফলে গোটা আমেরিকা সহ পৃথিবীব্যাপী ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। এই আন্দোলনের আগে পরেও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ড কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।অতএব কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের নিজেদের সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীনতা এবং অধিকার আলাদা করে চাইতে হচ্ছে কারণ স্বাভাবিকভাবে যা পাওয়ার কথা তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছিল।তেমনি নারীদের স্বাধীনতা নিয়েও আমাদের আরো অনেক বছর আলাদা করে কথা বলতে হবে। কথা বলতে হবে ততদিন যতদিন না নারীরা তাদের সব ন্যায়সঙ্গত অধিকারের চর্চা স্বাধীন ভাবে করতে পারে।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

পিরোজপুরে ছাত্রলীগ কর্মীকে পিটিতে হত্যা মামলায় ২ আসামী গ্রেপ্তার

স্বাধীনতার মাপকাঠিতে আমরা কতটুকু স্বাধীন?

প্রকাশিত : ০৪:৩৮:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ জুলাই ২০২০

“সারা জীবন তুমি আমায় এত স্বাধীনতা দিয়েছ”, ” তোমার স্বাধীনতা কি আমার পকেটে থাকে যে মাঝে মাঝে বের করে দেব? তোমার স্বাধীনতা তোমারই বস্তু।”

কয়েকদিন আগে পড়া একটি উপন্যাসে এক দম্পতির কথোপকথন এটি। পুরো উপন্যাসটা পড়ার সময় স্বাভাবিক লাগলেও এইটুকু পড়ার সময় মনে হয়েছিল রূপকথার গল্প পড়ছি। কারণ এখনো অন্তত আমি যে সমাজে বাস করি সেখানে অধিকাংশ পুরুষই নারীদের স্বাধীনতাকে তাদের, পকেটের রুমাল মনে করে। ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যবইয়ে একটা কথা পড়ে এসেছি এরকম যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিরোধীদলীয় নেতা নারী সুতরাং এটা নারী ক্ষমতায়নের এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরন। কিন্তু নিজের চোখেই দেখেছি নারী প্রধান এমন দলের রাজনীতি করা ব্যক্তিও তার অধীনস্ত নারীকে “তুমি মাইয়া মানুষ তুমি কি বুঝবা” ধরণের কথা শুনাতে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নারীরা কতটুকু স্বাধীন? এই প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই কারণ স্বাধীনতা মাপার কোন বিশ্বজনীন মাপকাঠি নেই। কাগজে কলমে মোটামুটি স্বাধীনতার সংজ্ঞা এক হলেও সমাজভেদে স্বাধীনতার মানদন্ড আলাদা। আমেরিকার সমাজে নারীর স্বাধীনতা বলে যা স্বীকৃত তা বাংলাদেশের সমাজে হয়ত স্বীকৃতি দেয় না। আবার রাষ্ট্র আইনগতভাবে যা স্বীকৃতি দিয়েছে তা হয়ত সমাজ বাস্তবায়ন করতে দেয় না। সে যাই হোক, সেই বেগম রোকেয়া, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় দের হাত ধরে বাংলার নারী সমাজের জাগরনের যে সূচনা হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই অনেক স্বাধীনতা পেয়েছে। এখন কন্যা শিশু হলেও অনেক বাবা খুশি হন, মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, কলেজ ভার্সিটিতেও পড়ছে, সব পেশায়ই কমবেশি নারী কাজ করছে এমনকি যে কাজ মেয়েদের না বলে স্বীকৃত ছিল তাতেও তারা মেধার স্বাক্ষর রাখছে।নানারকম বৈষম্য, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সমাজের শ্যেন দৃষ্টি সহ্য করেও মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের, পরিবারের ও সর্বোপরি দেশের ভাগ্যোন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

আমাদের সমাজ লিঙ্গ ভিত্তিক যে আচরনবিধি এবং কাজ নির্ধারন করে রাখে, যথাযথ সুযোগ পেলেই নারীরা তা ভুল প্রমান করে দেখাচ্ছে। কোন ব্যক্তির নিজের স্বতন্ত্র মতপ্রকাশ, চিন্তা বা কর্মের ক্ষমতা বা অধিকার থাকাকেই স্বাধীনতা বলা যেতে পারে। অথবা বলা যেতে পারে, স্বাধীনতা নৈতিক দায়িত্ব দ্বারা ভারসাম্যপূর্ণ স্বাধীন ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। অনেকেই স্বাধীনতার কোন সীমা আছে বলে মানতে চান না আবার অনেকেই নানা নিয়মের দ্বারা স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতা থেকে আলাদা করতে চান। সংজ্ঞা যাই হোক, একজনের স্বাধীনতার চর্চা যতক্ষন পর্যন্ত অন্য আরেকজনের স্বাধীনতায় অন্তরায় না হয় সেটাই কাম্য। তবে পৃথিবীতে মানুষই মনেহয় একমাত্র প্রানী যার স্বাধীনতা হামেশাই মানুষের হাতেই খর্ব হয়।সবলের স্বেচ্ছাচারিতা সর্বত্রই দুর্বলের স্বাধীনতা পদদলিত করে। ইংরেজীতে একটা কথা প্রচলিত আছে, “A rusty lock might be oiled so that the key has the freedom to turn.” নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত করতেও জং ধরা সব সিস্টেমকে পরিবর্তন করতে হবে- শুধু নারী নয়, গোটা মানবজাতীর ভালর জন্য।

স্বাধীনতা সব মানুষের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ তাহলে কেন আমরা নারী স্বাধীনতা নিয়ে আলাদা ভাবে কথা বলছি? কেন গোটা মানব জাতীর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছি না? কারণ, এমন কিছু সমস্যা আছে যেগুলা শুধুমাত্র নারীদেরকেই ভোগ করতে হয় এবং এই সমস্যা গুলো নারী স্বাধীনতার প্রধান অন্তরায়। যেমন ধর্ষন এবং যৌন হয়রানি। যেহেতু এখনে পর্যন্ত নারীরাই ধর্ষনের মূল শিকার এবং যৌন হয়রানির আশঙ্কায় অনেক নারীই এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিচরন করতে পারে না, সেহেতু নারীর স্বাধীনতা নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক পুলিশের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু বরন করেন। যার ফলে গোটা আমেরিকা সহ পৃথিবীব্যাপী ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। এই আন্দোলনের আগে পরেও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ড কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।অতএব কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের নিজেদের সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীনতা এবং অধিকার আলাদা করে চাইতে হচ্ছে কারণ স্বাভাবিকভাবে যা পাওয়ার কথা তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছিল।তেমনি নারীদের স্বাধীনতা নিয়েও আমাদের আরো অনেক বছর আলাদা করে কথা বলতে হবে। কথা বলতে হবে ততদিন যতদিন না নারীরা তাদের সব ন্যায়সঙ্গত অধিকারের চর্চা স্বাধীন ভাবে করতে পারে।