তের বছরের স্কুল ছাত্র, দুরন্ত বালক তিতাশ ঘোষ।সম্প্রতি মোটর বাইক দুর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে যখম হলে পরিবার তাকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন।নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলেও কোন এক ভিআইপির জন্য ফেরি অপেক্ষা করছিল। ততক্ষণে মৃত্যুর সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছিল শিশু তিতাস ঘোস।
বাচ্চার এমন মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্নসমর্পণের দৃশ্য দেখে পরিবারের লোকজন ফেরির দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে হাজার অনুনয় করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে শিশু তিতাস এমন অমানবিকতাকে থুথু দিয়ে ফেরিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। রাজধানীর আরেক বাসিন্দা পেয়ারা খাতুন, খুব সাধারণ এক জনসাধারণ। করোনার সকল উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র পরীক্ষা করাতেই প্রহর গুনতে হয়েছে দুই সপ্তাহের। শিশু তিতাশ কিংবা পেয়ারা বেগমের দুর্দশা বাংলাদেশ সাধারণ জনগণের দুইটি খন্ড চিত্রমাত্র। প্রতিদিন টেলিভিশন কিংবা খবরের পাতায় শিশু তিতাস বা পেয়ারা বেগমদের সাথে অমানবিক আচরণের এমন চিত্র মানবিকতাকে রুদ্ধ করেই যাচ্ছে। স্বাধীন ও গনতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হয়ে তাঁদের এমন আচরণের শিকার কেন হতে হচ্ছে? কারণ তারা সাধারণ আমজনতা, কোন ভিআইপি ট্যাগ পাওয়া ব্যক্তিবর্গ নয়। ক্ষমতার কিংবা আধিপত্যের সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ নিজের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করার জন্য এক অলিখিত দলিল তৈরি করেছে যা ভিআইপি( ভেরি ইম্পর্টেন্ট পার্সন) নামে নামকরণ করেছে।
ভিআইপি বর্তমানে এমন একটি জঘন্য শব্দ যা দেশের জনসাধারণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ভিআইপি যাতা কলে পিষ্ঠ হচ্ছে দেশের প্রতিটি খাতে সেবা নিতে আসা জনসাধারণ। করোনার মত মহামারীতেই থেমে নেই ভিআইপি সংস্কৃতির দৌরাত্ম। সারা দেশে আইসিইউ সংকট থাকলেও আনায়সে তার সুবিধা দিতে কার্পণ্য করা হচ্ছেনা এই ভিআইপি শ্রেণীকে।
দেশের জনসাধারণ যখন করোনার ভয়াবহ উপসর্গ নিয়ে সরকারি হাসপাতাল আসেন, তখন হাসপাতালের করিডোরে তাদের স্থান না হলেও বেড পেতে বেগ পেতে হয় হয়না ভিআইপি শ্রেণীর। অনেক ভিআইপি আবার চিকিৎসা নিচ্ছেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যেখানে আমজনতার অঘোষিত প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে।
শুধু স্বাস্থ্যখাত নয়, কোন খাতে নেই ভিআইপি ব্যাধির ভয়াবহতা? চাকুরী কিংবা নানান নিয়োগে যেখানে সাধারণ প্রার্থীরা নিজের মেধার যোগ্যতা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নিয়ে স্বপ্ন পূরণের পথে অগ্রসর হয়, সেখানে ভিআইপিদের সুপারিশে ভিআইপির পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করা হচ্ছে এসব মেধাবী সাধারণ প্রার্থীদের।
শুধু তাই নয়, ভিআইপি সংস্কৃতি সাধারণ জনসাধারণকে বঞ্চিত করছে ন্যায় বিচার থেকেও। কোন অন্যায় বা অবিচারের শিকার হয়ে দেশের জনসাধারণ যখন পুলিশের আশ্রয় খুঁজেন, তখন ভিআইপির আধিপত্যে পুলিশ কখনো মামলা নেন না কিংবা মামলা নিলেও গঠিত তদন্ত কমিটি বছরের পর বছর আর আলোর মুখ দেখেন না। দেশের ট্রাফিক আইন মেনে চলা বা না মেনে চললে জরিমানার বোঝা বহন করাও কেবল সাধারণ জনগণের জন্যই।
মন্ত্রী, এমপি, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ অভিজাত শ্রেণী যখন ভিআইপি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাস্তার চলাচল করেন, তখন থাকেনা কোন নিয়ম কানুন বা জেল জরিমানা।উল্টো আলাদা সুবিধা দিয়ে জনসাধারণের ভোগান্তির কারণ হতে সাহায্য করেন খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স যখম যানজটে আটকে তখন, তখন উল্টো রাস্তা দিয়ে আনায়সেই চলে চলে যেতে পারেন ভিআইপি ব্যক্তিবর্গরা। কিন্তু ভিন্নচিত্র দেখি আমরা বহির্বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে।
সম্প্রতি করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী বয়কো বোরিসোভকে ১৭৪ ডলার জরিমানা করেছে দেশটির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও কোন ভিআইপি ট্যাগ ব্যবহার না করে এই সাজা তিনি মাথানত করে মেনে নিলেন। প্রমাণ করে দিলেন আইন সকলের জন্য সমান। আমাদের দেশেও হয়ত এমনটাই হওয়া উচিত ছিল। ভিআইপি প্রশ্নে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ব্যতীত অন্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে ঘোষণা দিলেও তা শুধুমাত্র কাগজে কলমের ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভিআইপিদের আজ্ঞাবহ দাস হিসেবে সকল অনিয়মকে নিয়ম বলে পালন করতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ভিআইপিদের ক্ষমতা কিংবা বিত্তের কাছে মাথানত করছেন অবিরত। ক্ষমতা কখনো নিজের জন্য হতে পারে না। যে ক্ষমতা মানুষকে অন্য থেকে আলাদা করে তা কখনোই প্রকৃত ক্ষমতা হতে পারেনা। ক্ষমতা হওয়া উচিত দেশ ও দশের জন্য, দেশের জনসাধারণ উন্নতি ও শৃঙ্খলার জন্য।সাধারণ ও অসাধারণের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করার জন্য নয়। ক্ষমতাকে পূজি করে ভিআইপি তকমা লাগিয়ে জনসাধারণকে শোষণ করার জন্য নয়। ক্ষমতার এমন অপব্যবহার কিংবা বিত্তের গন্ডি থেকে বেরিয়ে ভিআইপি সংস্কৃতির ইতি টানতে আর কত অপেক্ষা করতে হবে বাংলাদেশকে?
লেখক- তানভীর আহমেদ রাসেল, শিক্ষার্থী, ফার্মেসী বিভাগ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়