০৯:০২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

ভাড়াটিয়ারা লজ্জায় মুখ খুলছে না

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত এক দশক অথবা তারও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের মাত্রা ছাড়িয়েছে, সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নির্বিচারে শ্রমিক- কর্মচারী ছাঁটাই চলছে, বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে, রফতানি আয় কমেছে, প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ বা রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে, মানি লন্ডারিং বা বিদেশে অর্থ পাচার অপ্রতিহভাবে চলছে, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে, বাংলা-ভারত বাণিজ্য-বৈষম্য বেড়েছে, পুঁজিবাজারে ১০টি কোম্পানি ৪৩ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছে, ৬টি শিল্প এলাকায় অন্তত দুই হাজারের বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো প্রবলভাবেই ঘটে চলেছে ।চূড়ান্ত পর্যায়ে এর ভয়াবহতা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, কতটা বীভৎস হবে এর মারণ ছোবল আমরা সাধারণ মানুষ তা অনুমানও করতে পারছি না। কিন্তু চোখের সামনে যেটা দেখতে পাচ্ছি সেটি হলো মানুষের দুর্দশা। ২৬ মার্চ থেকে পরবর্তী ৬৬ দিন দেশে লকডাউন বা সাধারণ ছুটি ছিল। এই দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময়কালে মানুষের জীবনযাত্রা ছিল অচলপ্রায় এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিলো স্তব্ধ। লাখ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন। বিভিন্ন হিসাবে সেই অঙ্ক দেড় কোটি থেকে শুরু করে সাড়ে তিন কোটির ঘরও ছাড়িয়ে গেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি না হারালেও বেতন পাচ্ছেন না। অনেকের বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে কারণ তার প্রতিষ্ঠান চলছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়েছে।

অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত মানুষ শুধু বেকার হয়েছেন এমন নয়, তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন এবং
অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষের বা সরকারি ত্রাণ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে ছাঁটাই, প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কর্মহীনতা এসব কারণে দেশে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়ে ভাড়া দিতে না পেরে শহর ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকে । অনেককে ভাড়ার জন্য হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে এমন অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। আবার কেউ ঘরের আসবাব ও ব্যবহারের জিনিসপত্র বিক্রি করেও ভাড়া শোধ করে চলে যাচ্ছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এরই মধ্যে সারা দেশে নতুন করে আরো অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, যারা আগে নিম্ন মধ্যবিত্ত ছিলেন, ছোট চাকরি বা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন।

এদের একটি বড় অংশের বসবাস শহরে। তবে ব্র্যাকের পর্যবেক্ষণ বলছে, করোনার শুরুর দিকে দিনমজুর ও রিকশাচালকদের যে খারাপ অবস্থা হয়েছিল তার উন্নতি হচ্ছে।

শ্রমিকরা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে উপার্জন করতে পেরেছেন। এখন আবার তারা কিছু কাজ পাচ্ছেন। কিন্তু এখন কাজ হারানোর শীর্ষে আছেন পোশাক শ্রমিকরা। তারা গ্রামে চলে যাচ্ছেন। নন-এমপিও শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। মাদ্রাসার শিক্ষকদের বড় একটি অংশ কষ্টে আছেন। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরাও ভালো অবস্থায় নেই।  আমরা যারা শহরে অবস্থান করছি তারা দেখছি আশপাশের অনেক মানুষ পরিবার নিয়ে শহরে থাকার মতো আর্থিক পরিস্থিতিতে নেই। কেউ বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। অনেকে সংসার চালাতে পারছেন না। বউ ছেলেমেয়ে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন এমন ঘটনাও শুনছি। গণমাধ্যমে শিরোনাম দেখছি, বাড়িভাড়া দিতে না পেরে পরিবারসহ গ্রামে ফিরে গেছেন, অভিজাত এলাকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার এলাকায় চলে যাচ্ছেন, ভাড়াটিয়ার অভাবে ফ্ল্যাটবাড়ি খালি পড়ে আছে। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই এ ধরনের নানা কাহিনী শোনা যাচ্ছে। এটা সত্যি যে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে উভয়েই গভীর সঙ্কটে পড়েছেন। অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়া পরিশোধের জন্য ভাড়াটের ওপর অমানবিক চাপ প্রয়োগ করেছেন এবং এখনো করছেন। এরই মধ্যে বাড়িভাড়া নিয়ে বেশ কিছু অমানবিক ঘটনা ঘটে গেছে। ভাড়া দিতে না পারায় ভাড়াটেকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। আবার বেশ কিছু বাড়ির মালিক মানবিক আচরণ করছেন।

কেউ মওকুফ করেছেন। অনেকে বলেছেন, পরে দিলেও চলবে। এ দুর্যোগেও ঘরভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন বস্তির নিয়ন্ত্রক প্রভাবশালীরা। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো এমনিতেই কাজ হারিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে আছেন। ঠিকমতো  ত্রাণও মিলছে না। তার ওপর ঘরভাড়া নিয়ে চাপের মুখে তারা দিশাহারা। জরিপ করে দেখা যায়,বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করা প্রায় ৭০ শতাংশ বাসিন্দাই ভাড়াটিয়া। যারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে এখানে বসবাস করছেন। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সকলেরই একই দশা।

বাড়িওয়ালাদের চাপে তারা দিশেহারা। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের ভাড়াটিয়াদের বাসা
ভাড়া, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিলসহ সব ধরনের ইউটিলিটি বিল মওকুফের দাবি জানিয়েছে ভাড়াটিয়া অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ভাড়াটিয়া অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক কামরুল হুদা বলেছেন, করোনাকালে মানুষ ৩ মাস ঘরে বন্দি থাকায় আয়রোজগার না থাকায় প্রায় মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এই সময়ে ৩ মাসের ভাড়া মওকুফ করার জন্য সরকারকে বাড়ীওয়ালাদের চাপ দিতে হবে। অন্যদিকে গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল ও হোল্ডিং ট্যাক্স সরকারকে মওকূপ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়ির মালিকেরা সংঘবদ্ধ, তাদের বাড়ি নির্মাণে অধিক ব্যয়ের কথা তুলে ধরছে গণমাধ্যমে, আদালতে এবং সুধীমহলে। কিন্তু ভাড়াটিয়ারা লজ্জায় মুখ খুলছে না, নিষ্ফল অভিযোগ করছে এখানে-সেখানে; কোন কর্তৃপক্ষ এর প্রতিকার দেবে, জানা নেই অনেকের। সাধারণ কর্মজীবী মানুষের উপার্জনের অর্ধেক চলে যাচ্ছে বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে।

করোনাকালে বেড়েছে সংসারিক খরচ,বেড়েছে ওষুধপত্রের খরচও। এতে হিমশিম খাচ্ছে
মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ।

কারণ নগরে বসবাসকারী ভাড়াটিয়ারা যেমন অসহায় অবস্থায় পড়েছে তেমনি কিছু কিছু বাড়িওয়ালা
যাদের শুধু ভাড়ার টাকায় সংসার চালাতে হয় তারা পড়েছে বিপাকে।নগরের অধিকাংশ বাড়ির মালিকই অবস্থাসম্পন্ন। তবে সব বাড়িওয়ালা ঋণ নিয়ে বাড়ি করেছেন কিংবা ভাড়ার টাকায় শুধু সংসার চালান তাও পুরোপুরি সত্য নয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল, হোল্ডিং ট্যাক্স এগুলোও বাড়িওয়ালাকে শোধ করতে হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য হলো, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হননি এমন মানুষ কম। বাড়িওয়ালা বা ভাড়াটিয়া উভয় পক্ষকেই পারস্পরিক ভিত্তিতে ক্ষতির দিকটা ভাগ করে নিতে হবে। এছাড়া সরকার এই দুর্যোগকালীন নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত বাড়ির মালিকদের হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করে দিতে পারে। এছাড়া যেসব মালিকের ব্যাংকঋণ আছে তাদের ব্যাংকঋণের কিস্তি নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত সুদমুক্ত অবস্থায় স্থগিত করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আদেশ দিতে পারে। এছাড়া বাসা-বাড়িতে সরকারি বিভিন্ন সেবার বিল সরকার কয়েক মাসের মওকুফ করতে পারে। এতে মানুষের ওপর অনেকাংশে অর্থনৈতিক চাপ কমবে।

বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। সামর্থবান বাড়িওয়ালারা এ ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দিতে পারেন। এই সময়ে কিছু ভাড়া কমিয়ে ভাড়াটিয়াদের ওপর থেকে চাপ কমাতে পারেন।

লেখক: মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট , চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান
দৈনিক আজকের বিজনেস বাংলাদেশ

বিজনেস বাংলাদেশ / ইমরান মাসুদ

ট্যাগ :

ভাড়াটিয়ারা লজ্জায় মুখ খুলছে না

প্রকাশিত : ০৭:৪৬:৫৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ জুলাই ২০২০

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত এক দশক অথবা তারও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের মাত্রা ছাড়িয়েছে, সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নির্বিচারে শ্রমিক- কর্মচারী ছাঁটাই চলছে, বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে, রফতানি আয় কমেছে, প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ বা রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে, মানি লন্ডারিং বা বিদেশে অর্থ পাচার অপ্রতিহভাবে চলছে, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে, বাংলা-ভারত বাণিজ্য-বৈষম্য বেড়েছে, পুঁজিবাজারে ১০টি কোম্পানি ৪৩ হাজার কোটি টাকা হারিয়েছে, ৬টি শিল্প এলাকায় অন্তত দুই হাজারের বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো প্রবলভাবেই ঘটে চলেছে ।চূড়ান্ত পর্যায়ে এর ভয়াবহতা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, কতটা বীভৎস হবে এর মারণ ছোবল আমরা সাধারণ মানুষ তা অনুমানও করতে পারছি না। কিন্তু চোখের সামনে যেটা দেখতে পাচ্ছি সেটি হলো মানুষের দুর্দশা। ২৬ মার্চ থেকে পরবর্তী ৬৬ দিন দেশে লকডাউন বা সাধারণ ছুটি ছিল। এই দীর্ঘ দুই মাসের বেশি সময়কালে মানুষের জীবনযাত্রা ছিল অচলপ্রায় এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিলো স্তব্ধ। লাখ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন। বিভিন্ন হিসাবে সেই অঙ্ক দেড় কোটি থেকে শুরু করে সাড়ে তিন কোটির ঘরও ছাড়িয়ে গেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি না হারালেও বেতন পাচ্ছেন না। অনেকের বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে কারণ তার প্রতিষ্ঠান চলছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচল হয়ে পড়েছে।

অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত মানুষ শুধু বেকার হয়েছেন এমন নয়, তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন এবং
অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষের বা সরকারি ত্রাণ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে ছাঁটাই, প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কর্মহীনতা এসব কারণে দেশে চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়ে ভাড়া দিতে না পেরে শহর ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকে । অনেককে ভাড়ার জন্য হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে এমন অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। আবার কেউ ঘরের আসবাব ও ব্যবহারের জিনিসপত্র বিক্রি করেও ভাড়া শোধ করে চলে যাচ্ছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এরই মধ্যে সারা দেশে নতুন করে আরো অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, যারা আগে নিম্ন মধ্যবিত্ত ছিলেন, ছোট চাকরি বা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন।

এদের একটি বড় অংশের বসবাস শহরে। তবে ব্র্যাকের পর্যবেক্ষণ বলছে, করোনার শুরুর দিকে দিনমজুর ও রিকশাচালকদের যে খারাপ অবস্থা হয়েছিল তার উন্নতি হচ্ছে।

শ্রমিকরা কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে উপার্জন করতে পেরেছেন। এখন আবার তারা কিছু কাজ পাচ্ছেন। কিন্তু এখন কাজ হারানোর শীর্ষে আছেন পোশাক শ্রমিকরা। তারা গ্রামে চলে যাচ্ছেন। নন-এমপিও শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। মাদ্রাসার শিক্ষকদের বড় একটি অংশ কষ্টে আছেন। মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরাও ভালো অবস্থায় নেই।  আমরা যারা শহরে অবস্থান করছি তারা দেখছি আশপাশের অনেক মানুষ পরিবার নিয়ে শহরে থাকার মতো আর্থিক পরিস্থিতিতে নেই। কেউ বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। অনেকে সংসার চালাতে পারছেন না। বউ ছেলেমেয়ে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন এমন ঘটনাও শুনছি। গণমাধ্যমে শিরোনাম দেখছি, বাড়িভাড়া দিতে না পেরে পরিবারসহ গ্রামে ফিরে গেছেন, অভিজাত এলাকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার এলাকায় চলে যাচ্ছেন, ভাড়াটিয়ার অভাবে ফ্ল্যাটবাড়ি খালি পড়ে আছে। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই এ ধরনের নানা কাহিনী শোনা যাচ্ছে। এটা সত্যি যে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে উভয়েই গভীর সঙ্কটে পড়েছেন। অনেক বাড়িওয়ালা ভাড়া পরিশোধের জন্য ভাড়াটের ওপর অমানবিক চাপ প্রয়োগ করেছেন এবং এখনো করছেন। এরই মধ্যে বাড়িভাড়া নিয়ে বেশ কিছু অমানবিক ঘটনা ঘটে গেছে। ভাড়া দিতে না পারায় ভাড়াটেকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। আবার বেশ কিছু বাড়ির মালিক মানবিক আচরণ করছেন।

কেউ মওকুফ করেছেন। অনেকে বলেছেন, পরে দিলেও চলবে। এ দুর্যোগেও ঘরভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন বস্তির নিয়ন্ত্রক প্রভাবশালীরা। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো এমনিতেই কাজ হারিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে আছেন। ঠিকমতো  ত্রাণও মিলছে না। তার ওপর ঘরভাড়া নিয়ে চাপের মুখে তারা দিশাহারা। জরিপ করে দেখা যায়,বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করা প্রায় ৭০ শতাংশ বাসিন্দাই ভাড়াটিয়া। যারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে এখানে বসবাস করছেন। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সকলেরই একই দশা।

বাড়িওয়ালাদের চাপে তারা দিশেহারা। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের ভাড়াটিয়াদের বাসা
ভাড়া, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিলসহ সব ধরনের ইউটিলিটি বিল মওকুফের দাবি জানিয়েছে ভাড়াটিয়া অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ভাড়াটিয়া অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক কামরুল হুদা বলেছেন, করোনাকালে মানুষ ৩ মাস ঘরে বন্দি থাকায় আয়রোজগার না থাকায় প্রায় মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এই সময়ে ৩ মাসের ভাড়া মওকুফ করার জন্য সরকারকে বাড়ীওয়ালাদের চাপ দিতে হবে। অন্যদিকে গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল ও হোল্ডিং ট্যাক্স সরকারকে মওকূপ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়ির মালিকেরা সংঘবদ্ধ, তাদের বাড়ি নির্মাণে অধিক ব্যয়ের কথা তুলে ধরছে গণমাধ্যমে, আদালতে এবং সুধীমহলে। কিন্তু ভাড়াটিয়ারা লজ্জায় মুখ খুলছে না, নিষ্ফল অভিযোগ করছে এখানে-সেখানে; কোন কর্তৃপক্ষ এর প্রতিকার দেবে, জানা নেই অনেকের। সাধারণ কর্মজীবী মানুষের উপার্জনের অর্ধেক চলে যাচ্ছে বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে।

করোনাকালে বেড়েছে সংসারিক খরচ,বেড়েছে ওষুধপত্রের খরচও। এতে হিমশিম খাচ্ছে
মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ।

কারণ নগরে বসবাসকারী ভাড়াটিয়ারা যেমন অসহায় অবস্থায় পড়েছে তেমনি কিছু কিছু বাড়িওয়ালা
যাদের শুধু ভাড়ার টাকায় সংসার চালাতে হয় তারা পড়েছে বিপাকে।নগরের অধিকাংশ বাড়ির মালিকই অবস্থাসম্পন্ন। তবে সব বাড়িওয়ালা ঋণ নিয়ে বাড়ি করেছেন কিংবা ভাড়ার টাকায় শুধু সংসার চালান তাও পুরোপুরি সত্য নয়। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল, হোল্ডিং ট্যাক্স এগুলোও বাড়িওয়ালাকে শোধ করতে হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য হলো, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হননি এমন মানুষ কম। বাড়িওয়ালা বা ভাড়াটিয়া উভয় পক্ষকেই পারস্পরিক ভিত্তিতে ক্ষতির দিকটা ভাগ করে নিতে হবে। এছাড়া সরকার এই দুর্যোগকালীন নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত বাড়ির মালিকদের হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করে দিতে পারে। এছাড়া যেসব মালিকের ব্যাংকঋণ আছে তাদের ব্যাংকঋণের কিস্তি নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত সুদমুক্ত অবস্থায় স্থগিত করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আদেশ দিতে পারে। এছাড়া বাসা-বাড়িতে সরকারি বিভিন্ন সেবার বিল সরকার কয়েক মাসের মওকুফ করতে পারে। এতে মানুষের ওপর অনেকাংশে অর্থনৈতিক চাপ কমবে।

বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। সামর্থবান বাড়িওয়ালারা এ ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দিতে পারেন। এই সময়ে কিছু ভাড়া কমিয়ে ভাড়াটিয়াদের ওপর থেকে চাপ কমাতে পারেন।

লেখক: মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট , চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান
দৈনিক আজকের বিজনেস বাংলাদেশ

বিজনেস বাংলাদেশ / ইমরান মাসুদ