০৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সময় না বাড়লে ঝুঁকিতে পড়বে অর্থনীতি

  • তাকী জোবায়ের
  • প্রকাশিত : ১২:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১
  • 34

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়েছে, করোনা মহামারির প্রভাবে ২০২০ সালে বৈশ্বিক প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৪২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আর ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশে নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। একই অবস্থা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগেও। সরকারের ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় প্রচুর ঋণ বিতরণ এবং ঋণ আদায় কমার পরও গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অথচ গত দশ বছর ধরেই দেশে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। বেসরকারি খাতে কম ঋণের মানে হলো- বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন কমে যাওয়া। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ২০২১ সালেও করোনার প্রভাবে প্রবল চাপে থাকবে বিশ্ব অর্থনীতি এবং ২০২১ সালের জুনের পর থেকে আস্তে আস্তে তা স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে শুরু করবে । অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির এই স্থবিরতার কারণে বিপাকে রয়েছেন ব্যবসায়ী সমাজ। এই অবস্থার মধ্যেই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। কিন্তু রফতানি ও আমদানিতে ভাটা চলায় ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ফেরেনি ব্যবসায়ীদের। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাধ্যবাধকতা স্থগিত না করলে অনিচ্ছাকৃতভাবেই খেলাপি হয়ে পড়বেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী। এতে বিপুল খেলাপির চাপে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে দেশের আর্থিক খাত। এতে হুমকিতে পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতি। বাধাগ্রস্ত হবে সরকারের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। তাই ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় আরও অন্তত ছয় মাস বাড়ানো জরুরি বলে মত দিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী মহল।
ব্যাংক কর্মকর্তারাও মনে করছেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় আরও বাড়ানো উচিত। তারা বলেছেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতার স্থগিতাদেশ আরও অন্তত ছয় মাস বৃদ্ধি না করলে দেশের ব্যবসায়ী সমাজ ও আর্থিক খাত- উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলেছি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরও ছয় মাস বাড়ানো উচিত। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্য এখনও ঠিক হয়নি। এখনও করোনা মহামারি চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনার দ্বিতীয় ধাপ চলছে। এর ফলে আমাদের দেশের অর্থনীতিও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদি সময় বাড়ানো না হয় তাহলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর ব্যবসায়ীরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন সেক্ষেত্রে ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে আমাদের দাবি, অন্তত আরও ছয় মাস ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়াতে হবে।
করোনা মহামারি শুরু হলে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত ছিল। এ কারণে কেউ ঋণ পরিশোধ করতে না পারলেও খেলাপি হয়নি। এতে ব্যাংকগুলোও বিপুল প্রভিশনের চাপ থেকে বেঁচে গেছে এবং এই সুবিধার কারণে ভাল অংকের মুনাফা করতে পারায় পুঁজিবাজারও চাঙ্গা রয়েছে। কিন্তু ঋণের কিস্তি পরিশোধের এই সুবিধা আরও ছয় মাস থেকে এক বছর বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবসায়ীরা বার বার আবেদন জানালেও এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি ও সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতেই বলা হয়েছে, অর্থনীতিতে গতি ফিরতে আরও সময় লাগবে। এদিকে আঙ্কটাড জানিয়েছে, মহামারিজনিত অনিশ্চয়তার কারণে চলতি বছরেও এফডিআই ৫-৭ শতাংশ হ্রাস পাবে। অর্থাৎ ২০২১ সালেও বৈশ্বিক বিনিয়োগ বাড়বে না।
অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন এবিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, ‘আশা করছি আগামী চার পাঁচ মাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিকে ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হবে, অন্যদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেও বাঁচাতে হবে। আর এটি করতে হলে, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা আরও ছয় মাস বাড়ানো যেতে পারে।’
এদিকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা আরও এক বছর বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইর সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা আরও অন্তত এক বছর বাড়ানো উচিত। কারণ, দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখনও স্থবির। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা যদি না বাড়ানো হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হয়ে পড়বেন। আর ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হলে ব্যাংকগুলোর জন্য ভালো হবে না। এ কারণে আরও অন্তত এক বছর সময়সীমা বাড়ানো জরুরি।
এদিকে সংসদ সদস্য ও বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যবসায়ীদের আরও ছয় মাস সময় দেওয়া উচিত। যদি ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো না হয়, তাহলে ব্যবসায়ী ও ব্যাংক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, এখনও করোনার সেকেন্ড ওয়েভ চলছে। এখনও অর্ডার বাতিল হচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকের পক্ষেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।’
আতঙ্কিত গ্রাহক ও ব্যাংক
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও ইতিবাচক সাড়া না আসায় আতঙ্কে সময় পাড় করছেন ব্যবসায়ীরা। একদিতে তারা ঋণের কিস্তির টাকা সংস্থান করতে পারছেন না, অন্যদিকে খেলাপি হয়ে পড়ার ভয় কাজ করছে তাদের মধ্যে। কারণ, করোনাকালে অসংখ্য উদ্যোক্তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে কিংবা রপ্তানি বিল দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকে আছে। অনেকে কোনও রপ্তানি আদেশই পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে সরকার ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরো বাড়ানোর বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নিলে ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়েই সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারণ, এমনিতেই বাংলাদেশের ব্যাংক খাত ৯৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের চাপে রয়েছে। এর মধ্যে ঋণ পরশোধের সময়সীমা বাড়ানো না হলে ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে নতুন করে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে যাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। নতুন করে এই বিপুল অংকের ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক মানে মারাত্মক ধস নামবে যার ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়ার আশঙ্কাই বেশি।
এ প্রসঙ্গে কয়েকদিন আগে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস-এর (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছিলেন, ‘ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো না হলে ব্যাংকই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তখন ব্যাংকগুলোতে বিপুল খেলাপি হয়ে যাবে যা ব্যাংকগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার হিসেবে আমি অর্থনীতির বর্তমান চিত্র খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমি ব্যাংকঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে। কারণ দেশে প্রায় এক বছর কোনো ব্যবসা নেই। দুই মাস ব্যবসা না থাকাই যেকোন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেখানে এক বছর ব্যবসা না থাকায় কারও কারও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। যারা আছে, তারাও কোনো রকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তাই এই সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিতকরণের মেয়াদ বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দাবির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ক্ষতির শঙ্কায় বড় ব্যবসায়ীরা এ সময়সীমা আরও বাড়ানোর দাবি আমাদের কাছে জানিয়েছেন। ব্যাংকগুলোর ওপর এর কী প্রভাব পড়বে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। কোন ব্যবসা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা হবে। আমাদেরকে শুধু ব্যবসায়ীদের দিকটি দেখলেই হবে না। ব্যবসায়ীদেরকেও বাঁচাতে হবে, ব্যাংককেও বাঁচাতে হবে।’

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

সময় না বাড়লে ঝুঁকিতে পড়বে অর্থনীতি

প্রকাশিত : ১২:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবেই জানিয়েছে, করোনা মহামারির প্রভাবে ২০২০ সালে বৈশ্বিক প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৪২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আর ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশে নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। একই অবস্থা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগেও। সরকারের ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় প্রচুর ঋণ বিতরণ এবং ঋণ আদায় কমার পরও গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অথচ গত দশ বছর ধরেই দেশে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। বেসরকারি খাতে কম ঋণের মানে হলো- বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন কমে যাওয়া। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, ২০২১ সালেও করোনার প্রভাবে প্রবল চাপে থাকবে বিশ্ব অর্থনীতি এবং ২০২১ সালের জুনের পর থেকে আস্তে আস্তে তা স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে শুরু করবে । অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির এই স্থবিরতার কারণে বিপাকে রয়েছেন ব্যবসায়ী সমাজ। এই অবস্থার মধ্যেই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। কিন্তু রফতানি ও আমদানিতে ভাটা চলায় ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ফেরেনি ব্যবসায়ীদের। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাধ্যবাধকতা স্থগিত না করলে অনিচ্ছাকৃতভাবেই খেলাপি হয়ে পড়বেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী। এতে বিপুল খেলাপির চাপে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে দেশের আর্থিক খাত। এতে হুমকিতে পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতি। বাধাগ্রস্ত হবে সরকারের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। তাই ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় আরও অন্তত ছয় মাস বাড়ানো জরুরি বলে মত দিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী মহল।
ব্যাংক কর্মকর্তারাও মনে করছেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় আরও বাড়ানো উচিত। তারা বলেছেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতার স্থগিতাদেশ আরও অন্তত ছয় মাস বৃদ্ধি না করলে দেশের ব্যবসায়ী সমাজ ও আর্থিক খাত- উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলেছি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরও ছয় মাস বাড়ানো উচিত। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্য এখনও ঠিক হয়নি। এখনও করোনা মহামারি চলছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনার দ্বিতীয় ধাপ চলছে। এর ফলে আমাদের দেশের অর্থনীতিও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদি সময় বাড়ানো না হয় তাহলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর ব্যবসায়ীরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন সেক্ষেত্রে ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে আমাদের দাবি, অন্তত আরও ছয় মাস ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়াতে হবে।
করোনা মহামারি শুরু হলে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত ছিল। এ কারণে কেউ ঋণ পরিশোধ করতে না পারলেও খেলাপি হয়নি। এতে ব্যাংকগুলোও বিপুল প্রভিশনের চাপ থেকে বেঁচে গেছে এবং এই সুবিধার কারণে ভাল অংকের মুনাফা করতে পারায় পুঁজিবাজারও চাঙ্গা রয়েছে। কিন্তু ঋণের কিস্তি পরিশোধের এই সুবিধা আরও ছয় মাস থেকে এক বছর বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবসায়ীরা বার বার আবেদন জানালেও এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি ও সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতেই বলা হয়েছে, অর্থনীতিতে গতি ফিরতে আরও সময় লাগবে। এদিকে আঙ্কটাড জানিয়েছে, মহামারিজনিত অনিশ্চয়তার কারণে চলতি বছরেও এফডিআই ৫-৭ শতাংশ হ্রাস পাবে। অর্থাৎ ২০২১ সালেও বৈশ্বিক বিনিয়োগ বাড়বে না।
অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন এবিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, ‘আশা করছি আগামী চার পাঁচ মাসের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। একদিকে ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হবে, অন্যদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেও বাঁচাতে হবে। আর এটি করতে হলে, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা আরও ছয় মাস বাড়ানো যেতে পারে।’
এদিকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা আরও এক বছর বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইর সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা আরও অন্তত এক বছর বাড়ানো উচিত। কারণ, দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখনও স্থবির। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা যদি না বাড়ানো হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হয়ে পড়বেন। আর ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হলে ব্যাংকগুলোর জন্য ভালো হবে না। এ কারণে আরও অন্তত এক বছর সময়সীমা বাড়ানো জরুরি।
এদিকে সংসদ সদস্য ও বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যবসায়ীদের আরও ছয় মাস সময় দেওয়া উচিত। যদি ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো না হয়, তাহলে ব্যবসায়ী ও ব্যাংক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, এখনও করোনার সেকেন্ড ওয়েভ চলছে। এখনও অর্ডার বাতিল হচ্ছে। এ অবস্থায় অনেকের পক্ষেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।’
আতঙ্কিত গ্রাহক ও ব্যাংক
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনও ইতিবাচক সাড়া না আসায় আতঙ্কে সময় পাড় করছেন ব্যবসায়ীরা। একদিতে তারা ঋণের কিস্তির টাকা সংস্থান করতে পারছেন না, অন্যদিকে খেলাপি হয়ে পড়ার ভয় কাজ করছে তাদের মধ্যে। কারণ, করোনাকালে অসংখ্য উদ্যোক্তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে কিংবা রপ্তানি বিল দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকে আছে। অনেকে কোনও রপ্তানি আদেশই পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে সরকার ঋণ পরিশোধের সময়সীমা আরো বাড়ানোর বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না নিলে ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়েই সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারণ, এমনিতেই বাংলাদেশের ব্যাংক খাত ৯৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের চাপে রয়েছে। এর মধ্যে ঋণ পরশোধের সময়সীমা বাড়ানো না হলে ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে নতুন করে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে যাবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। নতুন করে এই বিপুল অংকের ঋণ খেলাপি হয়ে গেলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক মানে মারাত্মক ধস নামবে যার ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়ার আশঙ্কাই বেশি।
এ প্রসঙ্গে কয়েকদিন আগে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস-এর (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছিলেন, ‘ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো না হলে ব্যাংকই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ তখন ব্যাংকগুলোতে বিপুল খেলাপি হয়ে যাবে যা ব্যাংকগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার হিসেবে আমি অর্থনীতির বর্তমান চিত্র খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমি ব্যাংকঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে। কারণ দেশে প্রায় এক বছর কোনো ব্যবসা নেই। দুই মাস ব্যবসা না থাকাই যেকোন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। সেখানে এক বছর ব্যবসা না থাকায় কারও কারও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। যারা আছে, তারাও কোনো রকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তাই এই সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’
ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিতকরণের মেয়াদ বাড়াতে ব্যবসায়ীদের দাবির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বিজনেস বাংলাদেশকে বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ক্ষতির শঙ্কায় বড় ব্যবসায়ীরা এ সময়সীমা আরও বাড়ানোর দাবি আমাদের কাছে জানিয়েছেন। ব্যাংকগুলোর ওপর এর কী প্রভাব পড়বে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। কোন ব্যবসা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা হবে। আমাদেরকে শুধু ব্যবসায়ীদের দিকটি দেখলেই হবে না। ব্যবসায়ীদেরকেও বাঁচাতে হবে, ব্যাংককেও বাঁচাতে হবে।’