০৮:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

উদ্বেগের অবসান, পাশ শতভাগ

এইচএসসির ফল প্রকাশের মাধ্যমে পৌনে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদেরদীর্ঘ কয়েক মাসের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটলো । মহামারীর এই সময়ে পরীক্ষার চেয়ে সরকারের অনুসৃত কর্মপন্থাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা। তারা বলেছেন, সরকার এইচএসসি পরীক্ষা না নিয়ে যে প্রক্রিয়ায় ফলাফল নির্ধারণ করেছে তা সকলের জন্যই মঙ্গলজনক হয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার অনুসৃত পদ্ধতিকে ‘সর্বোত্তম’ বর্ণনা করে শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা এখন ঠাণ্ডা মাথায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে পারবে। এদিকে বিশেষ পদ্ধতিতে এবার যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন তাদেরকে নিয়ে কোন ধারনের বিরূপ মন্তব্য না করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে শনিবার ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের মূল্যায়নের ফল প্রকাশ করেছে সরকার। এদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন।
ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শনিবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ফল প্রকাশ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে ডিজিটালি এই পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে এইচএসসির ফলাফলের সারসংক্ষেপ গ্রহণ করেন।
এদিকে এই ফল প্রকাশের মাধ্যমে উদ্বেগের অবসানেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “একটা উৎকণ্ঠার অবসান ঘটেছে। পরবর্তী স্তরে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা এখন প্রস্তুতি নিতে পারবে।” মহামারীর মধ্যে পরীক্ষা না নেওয়াকেই সমর্থন করছেন রাশেদা চৌধুরী। তার মতে, পরীক্ষা নেওয়া হত ঝুঁকিপূর্ণ। এবার সবাইকে পাস করানোয় একে সবাই ‘অটোপাস’ বললেও তা মানতে রাজি নন রাশেদ কে চৌধুরী। তিনি বলেন, “এটাকে আমি ঢালাওভাবে অটোপাস বলতে রাজি নই, কারণ এরা দুটি পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এভাবে রেজাল্ট দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ দেশই বিকল্প ব্যবস্থা করেছে, আমাদেরও বিকল্প না ভেবে উপায় নেই। আরও যদি আমরা অপেক্ষা করতাম, তাহলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারত।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের অধ্যাপক এম ওয়াহিদুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, “এই পরীক্ষা না নেওয়ায় সবাই উপকৃত হয়েছে। কারণ যদি পরীক্ষা নেওয়া হত যারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই পরীক্ষা দিতে পারত না। কেউ কেউ ফেল করত, এখন সবাই একটা সার্টিফেকেট পাবে। কারও কিন্তু ক্ষতি হয়নি, লেখাপড়া করেই কিন্তু তারা এই সার্টিফিকেট পাচ্ছে।”
গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে তা স্থগিত করা হয়। মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ায় গত অক্টোবর সরকার জানায়, পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনীর মতো এইচএসসি পরীক্ষাও নেওয়া যাচ্ছে না। এরপর আইন সংশোধন করে পরীক্ষা ছাড়াই মূল্যায়নের পথ বের করে এই ফল দেওয়া হল।
‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ করে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণা করায় আগের দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেও এবার ৩৯৬ জন পূর্ণাঙ্গ জিপিএ-৫ পায় পাননি। আবার জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেলেও এবারের ফলাফলে ১৭ হাজার ৪৩ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।
এ নিয়ে রাশেদা চৌধুরী বলেন, “পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতেই হবে। গোল্ডেন জিপিএ পেয়েও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই ভর্তি হতে পারেনি, সেটা আমরা দেখেছি। ফলে জিপিএ-৫ বাড়ল কি, না বাড়ল, সেগুলো না ভেবে এখন শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ। এই ফলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হবেই। কিন্তু পেছনেরটা না ভেবে সামনে যাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিৎ। এখানে সাবজেক্ট ম্যাপিং নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু আমি মনে করি না কোনো আদর্শ বিকল্প ছিল। কোনো বিকল্পই হয়ত আদর্শ হত না। শুধু আমরা না, অন্যরাও ভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।”
ঢাকা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেদর সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেছেন, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণা হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মাথা থেকে ‘বোঝা’ নেমে গেছে। সবার আগে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি দেখতে হবে, সরকার সেটিকে বিবেচনায় নিয়েই এভাবে ফল প্রকাশ করেছে। বলতে গেলে সবার ফলই আগের মতোই হয়েছে। এখন তারা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ঠাণ্ডা মাথায় প্রস্তুতি নিতে পারবে।”
বিরূপ মন্তব্য না করার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এবার ঘোষিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য না করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার গণভবন থেকে অনলানে যুক্ত হয়ে ডিজিটালি এই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অনেকেই এটা নিয়ে কথা বলছেন। আমি মনে করি, খুব বেশি কথা বলা বা এটা নিয়ে বেশি তিক্ততা সৃষ্টি করা উচিৎ না। মনে রাখতে হবে আমাদের ছোট ছেলেমেয়েরা, তাদের জীবনটার দিকে তাকাতে হবে। তারা যেন কোনোভাবেই হতাশাগ্রস্ত না হয়ে পড়ে।”
“এমনিতেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না, এটা তাদের জীবনে বিরাট এক বাধা সৃষ্টি করছে। এরপর যদি আবার ফলাফল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা হয়, এতেও কিন্তু তাদের ওপর মানসিক চাপ পড়বে। যারা এ ধরনের কথা বলছেন, তাদের আমি বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।”
মহামারীর মতো বিরূপ পরিস্থিতি কেন ফলাফল ঘোষণা করা হল, তাও ব্যাখ্যা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “একবার ভেবেছিলাম যে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হবে, অবস্থার পরিবর্তন হলে পরে আমরা পরীক্ষাটা নিতে পারব। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটা কোনোমতেই বন্ধ হচ্ছে না, এমনকি নতুনভাবে সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে, তাদের পড়াশোনার পথ যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এরকম একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে এই ফলাফলটা ঘোষণা করলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও একই পদ্ধতিতে ফলাফল ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েই এই ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। আরেকটা বিষয় হল, আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হয়ে যাক, সেটা আমরা চাই না। তাদের শিক্ষা জীবনটা চলমান থাক সেটাই আমরা চাই। সেই কারণেই আমরা ফলাফলটা ঘোষণা দিলাম। আশা করি, তাদের পড়াশোনা অব্যাহত থাকবে।”
মহামারীর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার সুরক্ষার কথা ভাবতে হচ্ছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “কোভিড সংক্রমণে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, শিক্ষক-শিক্ষিকারা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই ব্যবস্থাগুলো আমরা নিতে বাধ্য হয়েছি। অনেকে সেন্টিমেন্টাল হচ্ছেন, কথা বলছেন পরীক্ষা নিতে। কিন্তু এগুলো করতে গিয়ে যদি কেউ সংক্রমিত হয়, তাহলে তার দায় দায়িত্ব কে নেবে? যারা সমালোচনা করছেন এই পদ্ধতিতে রেজাল্ট দেওয়ার কারণে, তারা নেবেন দায়িত্ব? নিশ্চয়ই তারা নেবেন না। তখন তারা নতুন করে আবার সমালোচনা শুরু করবেন। এটাই আমাদের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য যে কিছু লোক থাকেই, যা কিছু করতে যান তাতেই একটা খুঁত বের করা। ফলাফলটা কি হবে সেটা তারা চিন্তাও করেন না।”
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমরা যথাযথ চেষ্টা করে যাচ্ছি। হয়ত আমরা যখন আরও বেশি সুরক্ষিত করতে পারব, অর্থাৎ এটা সারা বিশ্বব্যাপী একটা মহামারীৃএটা থেকে যখন মানুষ মুক্তি পাবে তখন আবার যথানিয়মে ক্লাস হবে, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যেতে পারবে। যারা প্রমোশন পাবে তারা আগামীতে পড়াশোনা শুরু করতে পারবে, এবং পরবর্তী পরীক্ষার উপর তাদের ভাগ্য নির্ভর করছে।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আমরা খুব দ্রুতই স্কুল খুলে দিতে পারব। করোনাভাইরাস আমরা যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখছি, সবাই যদি আরেকটু (স্বাস্থ্যবিধি) মেনে চলেন আমরা এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব এবং খুব দ্রুতই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে পারব। আমরা আশা করছি, হয়ত আগামী মার্চ-এপ্রিলৃআমরা মার্চ মাসটা দেখব। আমাদের দেশে এই মার্চ মাসেই ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। তবে আমরা ফেব্রুয়ারি মাসটা নজরে রাখব, যদি অবস্থা ভালো থাকে পরবর্তীতে আমরা সীমিত আকারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেব, আমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে যেতে পারে সে ব্যবস্থাটা আমরা নেব, এ ধরনের চিন্তাভাবনা আমাদের আছে। আমরা যত দ্রুত পারি এ ব্যবস্থাটা নেব।”
করোনাভাইরাসের টিকা যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও দেওয়া হয় সেই নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, “ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন বের হয়েছে। যখন থেকেই শুরু হয়েছে গবেষণা তখন থেকেই আগাম টাকা পয়সা দিয়ে আমরা বুক করে রেখেছিলাম। যখনই এটা আবিষ্কার হবে, যখনই এটা ব্যবহার করার অনুমতি পাওয়া যাবে সাথে সাথে আমরা যেন দিতে পারি। আপনারা জানেন যে আমরা করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করেছি। সেখানে আমি এরই মধ্যে নির্দেশ দিয়েছি, আমাদের যারা শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, তাদেরও এই ভ্যাকসিনটা যাতে দ্রুত দেওয়া হয়। তাছাড়া এটা সবচেয়ে বেশি দরকার, সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলা, করোনা মোকাবেলায় যা যা ব্যবস্থা আছে গ্রহণ করা। সেই সাথে ভ্যাকসিন তো সবাই পেয়েই যাবেন, তার জন্য সবার মানসিকভাবে তৈরি থাকা।” ###

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

উদ্বেগের অবসান, পাশ শতভাগ

প্রকাশিত : ১২:০০:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২১

এইচএসসির ফল প্রকাশের মাধ্যমে পৌনে ১৪ লাখ শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদেরদীর্ঘ কয়েক মাসের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটলো । মহামারীর এই সময়ে পরীক্ষার চেয়ে সরকারের অনুসৃত কর্মপন্থাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা। তারা বলেছেন, সরকার এইচএসসি পরীক্ষা না নিয়ে যে প্রক্রিয়ায় ফলাফল নির্ধারণ করেছে তা সকলের জন্যই মঙ্গলজনক হয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণার অনুসৃত পদ্ধতিকে ‘সর্বোত্তম’ বর্ণনা করে শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা এখন ঠাণ্ডা মাথায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রস্তুতি নিতে পারবে। এদিকে বিশেষ পদ্ধতিতে এবার যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন তাদেরকে নিয়ে কোন ধারনের বিরূপ মন্তব্য না করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে শনিবার ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের মূল্যায়নের ফল প্রকাশ করেছে সরকার। এদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন।
ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শনিবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ফল প্রকাশ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে ডিজিটালি এই পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে এইচএসসির ফলাফলের সারসংক্ষেপ গ্রহণ করেন।
এদিকে এই ফল প্রকাশের মাধ্যমে উদ্বেগের অবসানেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “একটা উৎকণ্ঠার অবসান ঘটেছে। পরবর্তী স্তরে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা এখন প্রস্তুতি নিতে পারবে।” মহামারীর মধ্যে পরীক্ষা না নেওয়াকেই সমর্থন করছেন রাশেদা চৌধুরী। তার মতে, পরীক্ষা নেওয়া হত ঝুঁকিপূর্ণ। এবার সবাইকে পাস করানোয় একে সবাই ‘অটোপাস’ বললেও তা মানতে রাজি নন রাশেদ কে চৌধুরী। তিনি বলেন, “এটাকে আমি ঢালাওভাবে অটোপাস বলতে রাজি নই, কারণ এরা দুটি পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এভাবে রেজাল্ট দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ দেশই বিকল্প ব্যবস্থা করেছে, আমাদেরও বিকল্প না ভেবে উপায় নেই। আরও যদি আমরা অপেক্ষা করতাম, তাহলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারত।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের অধ্যাপক এম ওয়াহিদুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, “এই পরীক্ষা না নেওয়ায় সবাই উপকৃত হয়েছে। কারণ যদি পরীক্ষা নেওয়া হত যারা রেজিস্ট্রেশন করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই পরীক্ষা দিতে পারত না। কেউ কেউ ফেল করত, এখন সবাই একটা সার্টিফেকেট পাবে। কারও কিন্তু ক্ষতি হয়নি, লেখাপড়া করেই কিন্তু তারা এই সার্টিফিকেট পাচ্ছে।”
গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে তা স্থগিত করা হয়। মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি না হওয়ায় গত অক্টোবর সরকার জানায়, পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনীর মতো এইচএসসি পরীক্ষাও নেওয়া যাচ্ছে না। এরপর আইন সংশোধন করে পরীক্ষা ছাড়াই মূল্যায়নের পথ বের করে এই ফল দেওয়া হল।
‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ করে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণা করায় আগের দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেও এবার ৩৯৬ জন পূর্ণাঙ্গ জিপিএ-৫ পায় পাননি। আবার জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেলেও এবারের ফলাফলে ১৭ হাজার ৪৩ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।
এ নিয়ে রাশেদা চৌধুরী বলেন, “পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতেই হবে। গোল্ডেন জিপিএ পেয়েও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই ভর্তি হতে পারেনি, সেটা আমরা দেখেছি। ফলে জিপিএ-৫ বাড়ল কি, না বাড়ল, সেগুলো না ভেবে এখন শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিৎ। এই ফলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হবেই। কিন্তু পেছনেরটা না ভেবে সামনে যাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিৎ। এখানে সাবজেক্ট ম্যাপিং নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু আমি মনে করি না কোনো আদর্শ বিকল্প ছিল। কোনো বিকল্পই হয়ত আদর্শ হত না। শুধু আমরা না, অন্যরাও ভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।”
ঢাকা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেদর সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেছেন, উচ্চ মাধ্যমিকের ফল ঘোষণা হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মাথা থেকে ‘বোঝা’ নেমে গেছে। সবার আগে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি দেখতে হবে, সরকার সেটিকে বিবেচনায় নিয়েই এভাবে ফল প্রকাশ করেছে। বলতে গেলে সবার ফলই আগের মতোই হয়েছে। এখন তারা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য ঠাণ্ডা মাথায় প্রস্তুতি নিতে পারবে।”
বিরূপ মন্তব্য না করার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এবার ঘোষিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য না করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার গণভবন থেকে অনলানে যুক্ত হয়ে ডিজিটালি এই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অনেকেই এটা নিয়ে কথা বলছেন। আমি মনে করি, খুব বেশি কথা বলা বা এটা নিয়ে বেশি তিক্ততা সৃষ্টি করা উচিৎ না। মনে রাখতে হবে আমাদের ছোট ছেলেমেয়েরা, তাদের জীবনটার দিকে তাকাতে হবে। তারা যেন কোনোভাবেই হতাশাগ্রস্ত না হয়ে পড়ে।”
“এমনিতেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছে না, এটা তাদের জীবনে বিরাট এক বাধা সৃষ্টি করছে। এরপর যদি আবার ফলাফল নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করা হয়, এতেও কিন্তু তাদের ওপর মানসিক চাপ পড়বে। যারা এ ধরনের কথা বলছেন, তাদের আমি বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি।”
মহামারীর মতো বিরূপ পরিস্থিতি কেন ফলাফল ঘোষণা করা হল, তাও ব্যাখ্যা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “একবার ভেবেছিলাম যে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হবে, অবস্থার পরিবর্তন হলে পরে আমরা পরীক্ষাটা নিতে পারব। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটা কোনোমতেই বন্ধ হচ্ছে না, এমনকি নতুনভাবে সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে, তাদের পড়াশোনার পথ যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এরকম একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে এই ফলাফলটা ঘোষণা করলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও একই পদ্ধতিতে ফলাফল ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েই এই ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। আরেকটা বিষয় হল, আমাদের শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হয়ে যাক, সেটা আমরা চাই না। তাদের শিক্ষা জীবনটা চলমান থাক সেটাই আমরা চাই। সেই কারণেই আমরা ফলাফলটা ঘোষণা দিলাম। আশা করি, তাদের পড়াশোনা অব্যাহত থাকবে।”
মহামারীর মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার সুরক্ষার কথা ভাবতে হচ্ছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “কোভিড সংক্রমণে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, শিক্ষক-শিক্ষিকারা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেওয়ার জন্যই ব্যবস্থাগুলো আমরা নিতে বাধ্য হয়েছি। অনেকে সেন্টিমেন্টাল হচ্ছেন, কথা বলছেন পরীক্ষা নিতে। কিন্তু এগুলো করতে গিয়ে যদি কেউ সংক্রমিত হয়, তাহলে তার দায় দায়িত্ব কে নেবে? যারা সমালোচনা করছেন এই পদ্ধতিতে রেজাল্ট দেওয়ার কারণে, তারা নেবেন দায়িত্ব? নিশ্চয়ই তারা নেবেন না। তখন তারা নতুন করে আবার সমালোচনা শুরু করবেন। এটাই আমাদের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য যে কিছু লোক থাকেই, যা কিছু করতে যান তাতেই একটা খুঁত বের করা। ফলাফলটা কি হবে সেটা তারা চিন্তাও করেন না।”
শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমরা যথাযথ চেষ্টা করে যাচ্ছি। হয়ত আমরা যখন আরও বেশি সুরক্ষিত করতে পারব, অর্থাৎ এটা সারা বিশ্বব্যাপী একটা মহামারীৃএটা থেকে যখন মানুষ মুক্তি পাবে তখন আবার যথানিয়মে ক্লাস হবে, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যেতে পারবে। যারা প্রমোশন পাবে তারা আগামীতে পড়াশোনা শুরু করতে পারবে, এবং পরবর্তী পরীক্ষার উপর তাদের ভাগ্য নির্ভর করছে।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আমরা খুব দ্রুতই স্কুল খুলে দিতে পারব। করোনাভাইরাস আমরা যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখছি, সবাই যদি আরেকটু (স্বাস্থ্যবিধি) মেনে চলেন আমরা এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব এবং খুব দ্রুতই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে পারব। আমরা আশা করছি, হয়ত আগামী মার্চ-এপ্রিলৃআমরা মার্চ মাসটা দেখব। আমাদের দেশে এই মার্চ মাসেই ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। তবে আমরা ফেব্রুয়ারি মাসটা নজরে রাখব, যদি অবস্থা ভালো থাকে পরবর্তীতে আমরা সীমিত আকারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেব, আমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে যেতে পারে সে ব্যবস্থাটা আমরা নেব, এ ধরনের চিন্তাভাবনা আমাদের আছে। আমরা যত দ্রুত পারি এ ব্যবস্থাটা নেব।”
করোনাভাইরাসের টিকা যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও দেওয়া হয় সেই নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, “ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন বের হয়েছে। যখন থেকেই শুরু হয়েছে গবেষণা তখন থেকেই আগাম টাকা পয়সা দিয়ে আমরা বুক করে রেখেছিলাম। যখনই এটা আবিষ্কার হবে, যখনই এটা ব্যবহার করার অনুমতি পাওয়া যাবে সাথে সাথে আমরা যেন দিতে পারি। আপনারা জানেন যে আমরা করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করেছি। সেখানে আমি এরই মধ্যে নির্দেশ দিয়েছি, আমাদের যারা শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, তাদেরও এই ভ্যাকসিনটা যাতে দ্রুত দেওয়া হয়। তাছাড়া এটা সবচেয়ে বেশি দরকার, সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলা, করোনা মোকাবেলায় যা যা ব্যবস্থা আছে গ্রহণ করা। সেই সাথে ভ্যাকসিন তো সবাই পেয়েই যাবেন, তার জন্য সবার মানসিকভাবে তৈরি থাকা।” ###