০৫:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপির বড় ধাক্কা

  • তাকী জোবায়ের
  • প্রকাশিত : ১২:০১:১০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১
  • 33

করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা ২০২০ সালের পুরোটা সময় ঋণের কিস্তি অবকাশ সুবিধা পেয়েছেন। এই সময়ে মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলেও কেউ খেলাপি হননি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারি থেকে এই সুবিধা তুলে নেওয়ায় কিস্তি পরিশোধে বাধ্যবাধকতা পুনর্বহাল হয়েছে। অর্থাৎ, জানুয়ারি থেকেই কেউ যদি ঋণ পরিশোধ না করেন তাহলে খেলাপির খাতায় নাম উঠবে তার। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় আন্তর্জাতিক বাজার আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধে বাধ্যবাধকতা পুনর্বহাল হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীর ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ফেরেনি। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি তিন মাস পর পর খেলাপির তথ্য হালনাগাদ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাবে আগামি মার্চ মাসে খেলাপির তথ্য হালনাগাদ হবে। যে কারণে মার্চের খেলাপির হিসাবে নতুন করে বড় অংকের খেলাপি সংযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ঋণের কিস্তি পরিশোধে অবকাশ সুবিধার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর দাবি ছিল এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ সহ দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর। তবে ব্যবসায়ীদের এই দাবি গ্রহণ না করে কিস্তি পরিশোধে ৫০ ভাগ সময় বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়েছে। তবে এই সময় ২ বছরের বেশি হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের ফলে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। এতে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘ঋণের কিস্তি পরিশোধের অবকাশ সুবিধা ঢালাওভাবে বন্ধ না করলে ভালো হতো। যেসব ব্যবসায়ী করোনাকালে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া জরুরি ছিল। এখন আগের সুবিধা অব্যাহত না থাকায় সামনের দিনে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলোও প্রভিশনের বিশাল চাপে পড়বে যা ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিশেষ সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ায় আর্থিক খাতে খেলাপির পরিমাণ বেড়ে যাবে জানিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ছয় মাসের জন্য এই সুবিধা বাড়ালে ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়ের জন্য ভালো হতো। এই সুযোগ না বাড়ানোয় আগামি মার্চ থেকেই দেশের ব্যাংক খাতের চারভাগের একভাগ ঋণ নতুন করে খেলাপির খাতায় যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।’
বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ কোটি টাকা। জ্যেষ্ঠ গবেষক আহসান এইচ মনসুরের আশঙ্কা সত্য হলে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণ নতুন করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
করোনা মহামারিসৃষ্ট প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের শুরু থেকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারের নির্দেশনায় ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঘোষিত অবকাশ সুবিধা বা পেমেন্ট হলিডে কার্যকর ছিল বিদায়ী বছরজুড়ে। যদিও নীতি ছাড়ের এ সুযোগ নেননি সব গ্রাহক। যেসব গ্রাহক করোনাকালে বিপদে পড়েছেন, কেবল তারাই অবকাশ সুবিধা নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, অবকাশ সুবিধা নেওয়া ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ, ৭৭ শতাংশ গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেছেন অর্থনৈতিক স্থবিরতার মাঝেও।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ দেশের ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল আরও ছয় মাস বাড়ানোর । তবে ব্যবসায়ীদের দাবি নাকচ করে মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে খেলাপি ঋণের সময়গণনা শুরু হয়েছে। ডেফারেল সুবিধা নেওয়া গ্রাহকদের জানুয়ারি থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে।
ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থাকার সুবিধার কারণে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে খেলাপি ঋণ ২১ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা কমে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায় নেমেছে। মোট ঋণের যা মাত্র ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকার ঋণ স্থিতির মধ্যে ঋণ অবকাশ সুবিধার আওতায় ছিল দুই লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। বর্তমানে ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতা পুনর্বহাল হাওয়ায় আগামি মার্চের হিসাবে এই বিপুল পরিমাণ ঋণের একটি বড় অংশই খেলাপির হিসাবে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে ১২ লক্ষ ১৪ হাজার টাকা জরিমানা

মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপির বড় ধাক্কা

প্রকাশিত : ১২:০১:১০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১

করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা ২০২০ সালের পুরোটা সময় ঋণের কিস্তি অবকাশ সুবিধা পেয়েছেন। এই সময়ে মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করতে পারলেও কেউ খেলাপি হননি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারি থেকে এই সুবিধা তুলে নেওয়ায় কিস্তি পরিশোধে বাধ্যবাধকতা পুনর্বহাল হয়েছে। অর্থাৎ, জানুয়ারি থেকেই কেউ যদি ঋণ পরিশোধ না করেন তাহলে খেলাপির খাতায় নাম উঠবে তার। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় আন্তর্জাতিক বাজার আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধে বাধ্যবাধকতা পুনর্বহাল হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীর ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ফেরেনি। যে কারণে অনেক ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি তিন মাস পর পর খেলাপির তথ্য হালনাগাদ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাবে আগামি মার্চ মাসে খেলাপির তথ্য হালনাগাদ হবে। যে কারণে মার্চের খেলাপির হিসাবে নতুন করে বড় অংকের খেলাপি সংযুক্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ঋণের কিস্তি পরিশোধে অবকাশ সুবিধার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর দাবি ছিল এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ সহ দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর। তবে ব্যবসায়ীদের এই দাবি গ্রহণ না করে কিস্তি পরিশোধে ৫০ ভাগ সময় বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়েছে। তবে এই সময় ২ বছরের বেশি হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তের ফলে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। এতে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘ঋণের কিস্তি পরিশোধের অবকাশ সুবিধা ঢালাওভাবে বন্ধ না করলে ভালো হতো। যেসব ব্যবসায়ী করোনাকালে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া জরুরি ছিল। এখন আগের সুবিধা অব্যাহত না থাকায় সামনের দিনে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলোও প্রভিশনের বিশাল চাপে পড়বে যা ব্যাংকের মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিশেষ সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ায় আর্থিক খাতে খেলাপির পরিমাণ বেড়ে যাবে জানিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ছয় মাসের জন্য এই সুবিধা বাড়ালে ব্যাংক এবং গ্রাহক উভয়ের জন্য ভালো হতো। এই সুযোগ না বাড়ানোয় আগামি মার্চ থেকেই দেশের ব্যাংক খাতের চারভাগের একভাগ ঋণ নতুন করে খেলাপির খাতায় যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।’
বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ কোটি টাকা। জ্যেষ্ঠ গবেষক আহসান এইচ মনসুরের আশঙ্কা সত্য হলে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা ঋণ নতুন করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
করোনা মহামারিসৃষ্ট প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের শুরু থেকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারের নির্দেশনায় ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঘোষিত অবকাশ সুবিধা বা পেমেন্ট হলিডে কার্যকর ছিল বিদায়ী বছরজুড়ে। যদিও নীতি ছাড়ের এ সুযোগ নেননি সব গ্রাহক। যেসব গ্রাহক করোনাকালে বিপদে পড়েছেন, কেবল তারাই অবকাশ সুবিধা নিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, অবকাশ সুবিধা নেওয়া ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ, ৭৭ শতাংশ গ্রাহক নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেছেন অর্থনৈতিক স্থবিরতার মাঝেও।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ দেশের ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল আরও ছয় মাস বাড়ানোর । তবে ব্যবসায়ীদের দাবি নাকচ করে মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে খেলাপি ঋণের সময়গণনা শুরু হয়েছে। ডেফারেল সুবিধা নেওয়া গ্রাহকদের জানুয়ারি থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে।
ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থাকার সুবিধার কারণে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে খেলাপি ঋণ ২১ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা কমে ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকায় নেমেছে। মোট ঋণের যা মাত্র ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকার ঋণ স্থিতির মধ্যে ঋণ অবকাশ সুবিধার আওতায় ছিল দুই লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। বর্তমানে ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতা পুনর্বহাল হাওয়ায় আগামি মার্চের হিসাবে এই বিপুল পরিমাণ ঋণের একটি বড় অংশই খেলাপির হিসাবে যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।