০৩:০২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫

শিল্প আর বাণিজ্যমুখী নবজাগরণ

  • সুধীর সাহা
  • প্রকাশিত : ১২:০০:৪২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১
  • 57

ব্যবসায়ী পরিচয়টি বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে একটি ‘অপসংস্কৃত’ পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যথেষ্ট টাকা বানানো যেন খুব একটা ভালো লক্ষণ নয়। আয় করাটাও যেন অন্যায়। আমরা যেন ভুলেই গেছি, ভারতবর্ষের দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, রামদুলাল দে, ধীরুভাই আম্বানি, বিড়লা পরিবার, আলামোহন দাশ; বাংলাদেশের কুমুদিনীর আর পি সাহা, স্কোয়ার গ্রুপের স্যামসন চৌধুরী, এপেক্স গ্রুপের সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, মোহাম্মদী গ্রুপের আনিসুল হকসহ আরো কিছু বাঙালি ব্যবসায়ীর কথাÑযারা অবাধ বাণিজ্যের পথে দুঃসাহসিক অভিযানে লিপ্ত ছিলেন। সওদাগরি স্বার্থে নিমগ্ন হয়েও তারা সাংস্কৃতিক কর্তব্য ভুলে যাননি। ষাটের দশক থেকে বামপন্থি আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পের মৃত্যু উপত্যকায় রূপান্তরিত করেছিল। ষাটের দশকে বাঙালি যুবক ব্যবসায়-শিল্পবিরোধী মহৎ চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছিল। তাই চারদিকে শুরু হয়েছিল ব্যবসায়-বাণিজ্যবিরোধী নানা প্রচারণা। ধুলায় মিশে গিয়েছিল শিল্পজাগরণ। এর নবজাগরণ ঘটল না স্বাধীনতার পরেও। বণিক শ্রেণি এবং বিদ্বান শ্রেণি মিলেমিশে গড়ে তুলতে পারল না নবজাগরণ। স্বাধীনতার পর একের পর এক বন্ধ হতে থাকল, রুগ্ন হতে থাকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। আদমজী জুট মিল, ডজনখানেক কটন মিল, মতিঝিল পাড়ার শিল্প অফিসÑসব যেন হঠাৎ নিবুনিবু প্রদীপের আলো পেতেও বঞ্চিত হয়ে পড়ল। অবাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে গড়ে ওঠা ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানগুলো বামপন্থি যুবকদের মিছিল-মিটিংয়ের অন্যতম প্রধান আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হলো। ঢাকার মতিঝিল, তেজগাঁও অঞ্চলের শিল্প এলাকা হয়ে গেল নীরব ভৌতিক অঞ্চল। এভাবেই ঘুমিয়েছিল কিছুদিন এদেশের শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রগুলো। একসময় গুটিগুটি পা করে সামনে এলো পোশাকশিল্প। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কিছু যুবক যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল এর পরিধি। কিছু প্রতিভাবান সাহসী যুবকের প্রচেষ্টা, সস্তা শ্রম এবং মহিলা শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের সুবাদে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প হঠাৎ করে ফুলে-ফেঁপে উঠল। চীনের হাত থেকে ব্যবসায় যত খসে গেল, ততই বাংলাদেশের অর্ডার বৃদ্ধি পেতে থাকল। গন্ধ পেয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরাও ঝুঁকে গেল এদিকটাতে। পোশাকশিল্পের হাত ধরে নতুন করে টেক্সটাইল শিল্পের রমরমা অবস্থা আবার ফিরে এলো বাংলাদেশে। পালটে গেল মতিঝিল, রামপুরা, শাহজাহানপুর, মহাখালী, গুলশান, তেজগাঁওÑসর্বত্র। নতুন করে শিল্পাঞ্চল ছড়িয়ে গেল ধামরাই, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের পথে। গ্রামবাংলার বধুরা সেলাই মেশিনে হাত পাকাতে শুরু করল। গড়ে তুলল এক দক্ষ শ্রমশক্তি। ঘুরে দাঁড়াল নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ, ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ; কিন্তু এতেও শিল্পবিপ্লবের সব রাস্তা খুলে গেল না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো, সামাজিক সমস্যা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা পিছিয়ে দিল এই শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোগকে। বাঙালি অভ্যস্ত পড়াশুনা করে ডিগ্রি আনতে, কবিতা লিখতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে, সংস্কৃতি চর্চা করতে। শিল্প বা ব্যবসায় করার চিন্তা তার প্রাথমিক চিন্তা নয়।
ওটা করে সে বাধ্য হয়ে। যারা ওটা করে, তাদের কাছে সমাজের অন্যরা অনুষ্ঠানের চাঁদা চাওয়া ছাড়া অন্য কোনো কারণে পৌঁছে না। বাঙালি বুদ্ধিজীবী তালিকায় আপনি হয়তো একজন অখ্যাত তৃতীয় শ্রেণির অভিনেতাকেও পেয়ে যেতে পারেন; কিন্তু কোনো ব্যবসায়ীকে সেখানে পাবেন না কিছুতেই। কেননা, ব্যবসায়ীরা সংস্কৃতির ধারেকাছে আসবেনÑএমন কথা পাড়া-মহল্লার ছোকরারা কল্পনায়ও আনতে পারে না। সমাজের পরিবেশটাই যেন এমন। ব্যবসায় করলে কর ফাঁকি দিতে হবে, ভেজাল দিতে হবে, অসত্য কথা বলতে হবে, ঘুষ দিতে হবেÑএসব কোনো ব্যবসায়ী করুক বা না করুক, সামাজিক জনশ্রুতি ঠিক এমনই। তাই দূর থেকে ব্যবসায়ীকে দেখতেই পছন্দ সমাজের সংস্কৃতিমনা মানুষের। এমনটা কিন্তু বাঙালিদের সূচনা ছিল না। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাঙালির ব্যবসায় হাতেখড়ি ঘটেছিল। কলকাতার বণিক শ্রেণি এতটাই অগ্রসর হয়েছিলেন যে, মাত্র ১৫ বছর পর মুর্শিদাবাদকে হটিয়ে ১৭৭৩ সালে কলকাতা হয়েছিল বাংলার রাজধানী। ১৭৭৪ সালে জন্ম রামমোহন রায়ের, যিনি বাংলাসহ ভারতবর্ষের বণিক শ্রেণি আর বিদ্বান শ্রেণিকে একসূত্রে গেঁথে দিয়ে শিল্প ও বাণিজ্যিক নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন। সেই বীরগাথা বাস্তবতা আজ বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় শুধুই ইতিহাস হয়ে আমাদের বিদ্রুপ করছে। আমাদের কৃষি সম্পদ আছে, কৃষক আছে; কিন্তু কৃষিশিল্প গড়ে ওঠেনি। আমাদের শ্রমিক আছে, শক্ত শ্রম দেওয়া হাত আছে; কিন্তু শ্রমশিল্প গড়ে ওঠেনি। আমরা যেন শুধু পোশাকশিল্পেই আটকে আছি অনেকটা সময় ধরে।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের ‘বেস্ট কান্ট্রি ফর এন্ট্রাপ্রেনিওরশিপ’ সূচকে ইদানীং যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। বিশ্বে শিল্পোদ্যোগের অন্য সেরা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০০ দেশের মধ্যে ৮৪তম। এতে পাকিস্তান (৯৯তম) থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও ভারতের (৯ম) তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। ছয়টি সূচকের ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়: উদ্ভাবন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, শ্রমদক্ষতা, অবকাঠামোগত যোগ্যতা, মূলধন এবং মুক্ত ব্যবসায় ব্যবস্থা। বাংলাদেশের মোট স্কোর এসেছে মাত্র ১২ দশমিক ৯৯, যেখানে ভারতের স্কোর ২৫ দশমিক ৪৭, যুক্তরাষ্ট্রের ৪২ দশমিক ৮৮। বাংলাদেশের পয়েন্টগুলো ঠিক এভাবে তারা বিশ্লেষণ করেছেনÑউদ্ভাবনে ৪ দশমিক ৩৪, প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় ৪ দশমিক ৮৯, শ্রমদক্ষতায় ২৩ দশমিক ৫, অবকাঠামোয় ২০ দশমিক ৪৭, মূলধনে ৯৩ দশমিক ৬২ এবং মুক্ত ব্যবসায় ব্যবস্থায় ১ দশমিক ৭ পয়েন্ট। একেবারে সাদামাটাভাবে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে শিল্প ও বাণিজ্যমুখী নবজাগরণের অন্তরালে অবস্থান করছে মুক্ত ব্যবসায় ব্যবস্থা, উদ্ভাবনী যোগ্যতা এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। এই তিনটি স্থানে উন্নতি সাধন করলেই আমরা হয়তো একটি শিল্প ও বাণিজ্যবান্ধব সমাজ এবং রাষ্ট্র লাভ করতে পারি। এই তিনটি ব্যবস্থার একটি পুরোপুরিভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থার হাতে। অন্য দুইটির উন্নয়নেও রাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন। শিক্ষা আর সংস্কৃতিকে শিল্প এবং বাণিজ্য জগতে সমন্বয় করার মাধ্যমে বাংলাদেশ অনায়াসেই লাভ করতে পারে ব্যবসায়ের উদ্ভাবনী যোগ্যতা আর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। এ কাজটি করতে সরকারের বহুমাত্রিক পরিকল্পনা সুফল বয়ে আনতে পারেÑএমনটা শুধু বলার কথা নয়, বিশ্বাসের কথা। শিল্প এবং বাণিজ্য অঞ্চলটি হয়ে উঠুক সামাজিক উন্নয়নের বড় একটি মাধ্যম, শিল্প এবং বাণিজ্যের বিশেষ ভূমিকায় এগিয়ে যাক শিক্ষা আর সংস্কৃতিÑআজ না হয় এটুকুই আশা করে বিদায় হই। শিল্প আর বাণিজ্যমুখী এই নবজাগরণের যুগ আসবে তখনই, যখন বাঙালি চিন্তাবিদ, সংস্কারকদের সঙ্গে বাঙালি ব্যবসায়ী ও উদ্যোগপতিদের সমন্বয় ঘটবে।
লেখক : সুধীর সাহা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

ট্যাগ :

বিএফআইইউ প্রধানের ‘ভিডিও ফাঁস’ বিশেষজ্ঞদের দাবি এআই দারা নির্মিত ষড়যন্ত্র

শিল্প আর বাণিজ্যমুখী নবজাগরণ

প্রকাশিত : ১২:০০:৪২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১

ব্যবসায়ী পরিচয়টি বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে একটি ‘অপসংস্কৃত’ পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যথেষ্ট টাকা বানানো যেন খুব একটা ভালো লক্ষণ নয়। আয় করাটাও যেন অন্যায়। আমরা যেন ভুলেই গেছি, ভারতবর্ষের দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, রামদুলাল দে, ধীরুভাই আম্বানি, বিড়লা পরিবার, আলামোহন দাশ; বাংলাদেশের কুমুদিনীর আর পি সাহা, স্কোয়ার গ্রুপের স্যামসন চৌধুরী, এপেক্স গ্রুপের সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, মোহাম্মদী গ্রুপের আনিসুল হকসহ আরো কিছু বাঙালি ব্যবসায়ীর কথাÑযারা অবাধ বাণিজ্যের পথে দুঃসাহসিক অভিযানে লিপ্ত ছিলেন। সওদাগরি স্বার্থে নিমগ্ন হয়েও তারা সাংস্কৃতিক কর্তব্য ভুলে যাননি। ষাটের দশক থেকে বামপন্থি আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পের মৃত্যু উপত্যকায় রূপান্তরিত করেছিল। ষাটের দশকে বাঙালি যুবক ব্যবসায়-শিল্পবিরোধী মহৎ চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছিল। তাই চারদিকে শুরু হয়েছিল ব্যবসায়-বাণিজ্যবিরোধী নানা প্রচারণা। ধুলায় মিশে গিয়েছিল শিল্পজাগরণ। এর নবজাগরণ ঘটল না স্বাধীনতার পরেও। বণিক শ্রেণি এবং বিদ্বান শ্রেণি মিলেমিশে গড়ে তুলতে পারল না নবজাগরণ। স্বাধীনতার পর একের পর এক বন্ধ হতে থাকল, রুগ্ন হতে থাকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। আদমজী জুট মিল, ডজনখানেক কটন মিল, মতিঝিল পাড়ার শিল্প অফিসÑসব যেন হঠাৎ নিবুনিবু প্রদীপের আলো পেতেও বঞ্চিত হয়ে পড়ল। অবাঙালি ব্যবসায়ীদের হাতে গড়ে ওঠা ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানগুলো বামপন্থি যুবকদের মিছিল-মিটিংয়ের অন্যতম প্রধান আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হলো। ঢাকার মতিঝিল, তেজগাঁও অঞ্চলের শিল্প এলাকা হয়ে গেল নীরব ভৌতিক অঞ্চল। এভাবেই ঘুমিয়েছিল কিছুদিন এদেশের শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রগুলো। একসময় গুটিগুটি পা করে সামনে এলো পোশাকশিল্প। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কিছু যুবক যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল এর পরিধি। কিছু প্রতিভাবান সাহসী যুবকের প্রচেষ্টা, সস্তা শ্রম এবং মহিলা শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের সুবাদে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প হঠাৎ করে ফুলে-ফেঁপে উঠল। চীনের হাত থেকে ব্যবসায় যত খসে গেল, ততই বাংলাদেশের অর্ডার বৃদ্ধি পেতে থাকল। গন্ধ পেয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরাও ঝুঁকে গেল এদিকটাতে। পোশাকশিল্পের হাত ধরে নতুন করে টেক্সটাইল শিল্পের রমরমা অবস্থা আবার ফিরে এলো বাংলাদেশে। পালটে গেল মতিঝিল, রামপুরা, শাহজাহানপুর, মহাখালী, গুলশান, তেজগাঁওÑসর্বত্র। নতুন করে শিল্পাঞ্চল ছড়িয়ে গেল ধামরাই, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জের পথে। গ্রামবাংলার বধুরা সেলাই মেশিনে হাত পাকাতে শুরু করল। গড়ে তুলল এক দক্ষ শ্রমশক্তি। ঘুরে দাঁড়াল নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ, ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ; কিন্তু এতেও শিল্পবিপ্লবের সব রাস্তা খুলে গেল না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো, সামাজিক সমস্যা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা পিছিয়ে দিল এই শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোগকে। বাঙালি অভ্যস্ত পড়াশুনা করে ডিগ্রি আনতে, কবিতা লিখতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে, সংস্কৃতি চর্চা করতে। শিল্প বা ব্যবসায় করার চিন্তা তার প্রাথমিক চিন্তা নয়।
ওটা করে সে বাধ্য হয়ে। যারা ওটা করে, তাদের কাছে সমাজের অন্যরা অনুষ্ঠানের চাঁদা চাওয়া ছাড়া অন্য কোনো কারণে পৌঁছে না। বাঙালি বুদ্ধিজীবী তালিকায় আপনি হয়তো একজন অখ্যাত তৃতীয় শ্রেণির অভিনেতাকেও পেয়ে যেতে পারেন; কিন্তু কোনো ব্যবসায়ীকে সেখানে পাবেন না কিছুতেই। কেননা, ব্যবসায়ীরা সংস্কৃতির ধারেকাছে আসবেনÑএমন কথা পাড়া-মহল্লার ছোকরারা কল্পনায়ও আনতে পারে না। সমাজের পরিবেশটাই যেন এমন। ব্যবসায় করলে কর ফাঁকি দিতে হবে, ভেজাল দিতে হবে, অসত্য কথা বলতে হবে, ঘুষ দিতে হবেÑএসব কোনো ব্যবসায়ী করুক বা না করুক, সামাজিক জনশ্রুতি ঠিক এমনই। তাই দূর থেকে ব্যবসায়ীকে দেখতেই পছন্দ সমাজের সংস্কৃতিমনা মানুষের। এমনটা কিন্তু বাঙালিদের সূচনা ছিল না। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাঙালির ব্যবসায় হাতেখড়ি ঘটেছিল। কলকাতার বণিক শ্রেণি এতটাই অগ্রসর হয়েছিলেন যে, মাত্র ১৫ বছর পর মুর্শিদাবাদকে হটিয়ে ১৭৭৩ সালে কলকাতা হয়েছিল বাংলার রাজধানী। ১৭৭৪ সালে জন্ম রামমোহন রায়ের, যিনি বাংলাসহ ভারতবর্ষের বণিক শ্রেণি আর বিদ্বান শ্রেণিকে একসূত্রে গেঁথে দিয়ে শিল্প ও বাণিজ্যিক নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন। সেই বীরগাথা বাস্তবতা আজ বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় শুধুই ইতিহাস হয়ে আমাদের বিদ্রুপ করছে। আমাদের কৃষি সম্পদ আছে, কৃষক আছে; কিন্তু কৃষিশিল্প গড়ে ওঠেনি। আমাদের শ্রমিক আছে, শক্ত শ্রম দেওয়া হাত আছে; কিন্তু শ্রমশিল্প গড়ে ওঠেনি। আমরা যেন শুধু পোশাকশিল্পেই আটকে আছি অনেকটা সময় ধরে।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের ‘বেস্ট কান্ট্রি ফর এন্ট্রাপ্রেনিওরশিপ’ সূচকে ইদানীং যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। বিশ্বে শিল্পোদ্যোগের অন্য সেরা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০০ দেশের মধ্যে ৮৪তম। এতে পাকিস্তান (৯৯তম) থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও ভারতের (৯ম) তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। ছয়টি সূচকের ওপর এই সমীক্ষা চালানো হয়: উদ্ভাবন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, শ্রমদক্ষতা, অবকাঠামোগত যোগ্যতা, মূলধন এবং মুক্ত ব্যবসায় ব্যবস্থা। বাংলাদেশের মোট স্কোর এসেছে মাত্র ১২ দশমিক ৯৯, যেখানে ভারতের স্কোর ২৫ দশমিক ৪৭, যুক্তরাষ্ট্রের ৪২ দশমিক ৮৮। বাংলাদেশের পয়েন্টগুলো ঠিক এভাবে তারা বিশ্লেষণ করেছেনÑউদ্ভাবনে ৪ দশমিক ৩৪, প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় ৪ দশমিক ৮৯, শ্রমদক্ষতায় ২৩ দশমিক ৫, অবকাঠামোয় ২০ দশমিক ৪৭, মূলধনে ৯৩ দশমিক ৬২ এবং মুক্ত ব্যবসায় ব্যবস্থায় ১ দশমিক ৭ পয়েন্ট। একেবারে সাদামাটাভাবে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে শিল্প ও বাণিজ্যমুখী নবজাগরণের অন্তরালে অবস্থান করছে মুক্ত ব্যবসায় ব্যবস্থা, উদ্ভাবনী যোগ্যতা এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। এই তিনটি স্থানে উন্নতি সাধন করলেই আমরা হয়তো একটি শিল্প ও বাণিজ্যবান্ধব সমাজ এবং রাষ্ট্র লাভ করতে পারি। এই তিনটি ব্যবস্থার একটি পুরোপুরিভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থার হাতে। অন্য দুইটির উন্নয়নেও রাষ্ট্রের সহযোগিতা প্রয়োজন। শিক্ষা আর সংস্কৃতিকে শিল্প এবং বাণিজ্য জগতে সমন্বয় করার মাধ্যমে বাংলাদেশ অনায়াসেই লাভ করতে পারে ব্যবসায়ের উদ্ভাবনী যোগ্যতা আর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। এ কাজটি করতে সরকারের বহুমাত্রিক পরিকল্পনা সুফল বয়ে আনতে পারেÑএমনটা শুধু বলার কথা নয়, বিশ্বাসের কথা। শিল্প এবং বাণিজ্য অঞ্চলটি হয়ে উঠুক সামাজিক উন্নয়নের বড় একটি মাধ্যম, শিল্প এবং বাণিজ্যের বিশেষ ভূমিকায় এগিয়ে যাক শিক্ষা আর সংস্কৃতিÑআজ না হয় এটুকুই আশা করে বিদায় হই। শিল্প আর বাণিজ্যমুখী এই নবজাগরণের যুগ আসবে তখনই, যখন বাঙালি চিন্তাবিদ, সংস্কারকদের সঙ্গে বাঙালি ব্যবসায়ী ও উদ্যোগপতিদের সমন্বয় ঘটবে।
লেখক : সুধীর সাহা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা