লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর ফলকন ইউনিয়নের পশ্চিম লুধুয়া গ্রামের বাসিন্দা স্বামী পরিত্যক্তা বিবি শাহিদা (২৮)। ১৬ শতাংশ জমিসহ বাবার রেখে যাওয়া বাড়িতে বৃদ্ধা মা, স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন বিবি শাহিদা। গ্রামের আর ১০টি পরিবারের মতোই কৃষিপণ্যের আয়ে চলত তার সংসার। কিন্তু সেই দিনগুলো এখন শাহিদার কাছে কেবইল স্মৃতি। চার বছর আগে মেঘনার করাল গ্রাসে বিলীন হয়েছে তার শেষ আশ্রয়স্থল। একই সময় ভেঙে যায় স্বামীর সঙ্গে গড়া সংসারও। সর্বস্ব হারিয়ে বৃদ্ধা মা ও সন্তানদের নিয়ে নদীপাড়েই অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। আশপাশের মানুষের সহযোগিতা পেলে পরিবারের সদস্যদের খাবার জোটে।
আট বছর ধরে লুধুয়া মাছঘাটে চায়ের দোকান করছেন চার সন্তানের জনক আবদুল মালেক। গত কয়েক বছরে মেঘনায় তার বাড়ি চারবার ভেঙেছে।
মেঘনা নদীর পাড়ে ১২০টি দোকান নিয়ে গড়ে ওঠে মোশারফ হোসেন বাঘার হাটবাজার। দীর্ঘদিনের পুরনো বাজারটি এখন মাঝনদীর তলদেশে। ওই বাজারের হোটেল ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম জানান, এক যুগে ৩০ বার তার হোটেল স্থানান্তর করতে হয়েছে। এর মধ্যে গত মাসেই চারবার সরিয়েছেন খাবারের হোটেলটি।
শুধু বিবি শাহিদা, দোকানদার আবদুল মালেক ও হোটেল ব্যবসায়ী তাজুল ইসলামই নন, মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনের কবলে নিঃস্ব হয়েছে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতি উপজেলার লক্ষাধিক বাসিন্দা। তীব্র স্রোতে একের পর এক বিলীন হয়েছে নদীতীরের হাজারো মানুষের বসতভিটা, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ক্লিনিক ও আশ্রয় কেন্দ্র। ছোট ছোট প্রকল্পে বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলেও ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হয়নি। দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া না হলে তীব্র ভাঙনে বিলীন হবে দুই উপজেলার সরকারি-বেসরকারিসহ গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক স্থাপনা।
এদিকে গত ১ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় মেঘনার ভাঙন রোধে রামগতি-কমলনগর উপজেলার ৩১ কিলোমিটার তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য ৩ হাজার ৮৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেন প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা। সব প্রক্রিয়া শেষে এ অর্থ বরাদ্দ পেলে ১০ কিলোমিটার হারে তিন ধাপে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে বলে জানান লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী। তবে তীর রক্ষ বাঁধ বাস্তবায়নে কোনো ঠিকাদার নয়, বরং সরকারি কোনো সংস্থার মাধ্যমে পুরো ৩১ কিলোমিটার টেকসই রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি উপকূলের বাস্তুহারা বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের।
জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের পাঁচ উপজেলার মধ্যে সদর আংশিক, রায়পুর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলা মেঘনার তীরে। এর মধ্যে কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ৩৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বছরের পর বছর ধরে চলছে মেঘনার ভাঙন। কমলনগরে মেঘনার তীর ১৭ ও রামগতি অংশে ২০ কিলোমিটার।স্থানীয়রা জানান, ২০১৭ সালে ১৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রক্ষা বাঁধ দুটির মধ্যে রামগতি অংশে সাড়ে চার কিলোমিটারের নির্মাণকাজ করে সেনাবাহিনী, যা আজও অক্ষত। অথচ অন্য অংশে কমলনগরের মাতাব্বরহাট এলাকায় ঠিকাদার দিয়ে এক কিলোমিটার তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ হতে না হতেই আটবার ধসে যায় বাঁধটি। এতে বারবারই ক্ষতির শিকার হচ্ছে স্থানীয়রা। তাই স্থানীয়দের মূল দাবিতে পরিণত হয়েছে টেকসই রক্ষা বাঁধ নির্মাণ।
গত বছর মেঘনার ভাঙন থেকে কমলনগরের নাছিরগঞ্জ বাজার এলাকায় স্থানীয়দের অর্থায়নে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ও স্থানীয়দের স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মাণ করা হয় তিন কিলোমিটার জংলা বাঁধ। সরেজমিনে দেখ যায়, তীব্র স্রোতে নাছিরগঞ্জ এলাকার সেই জংলা বাঁধটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অন্যদিকে লুধুয়া বাজার এলাকায় ভাঙন তীব্র হয়ে উঠছে। জোয়ারের স্রোতে ভাঙনের পাশাপাশি নদীপাড়ে একেকটি গোল চক্র সৃষ্টি হয়ে ২০-২৫ শতাংশ পরিমাণ ভূমি তথা একেকজনের ভিটেমাটি ও ফসলের জমি তলিয়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, কমলনগর উপজেলার ছয় ইউনিয়নের ১৬টি ওয়ার্ডে বর্তমানে প্রতিনিয়তই ভাঙছে। কমলনগর উপজেলার চর ফলকন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ বলেন, মেঘনার ভাঙনে তার ইউনিয়নের ৩, ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ড বিলীন হয়ে গেছে। রামগতির চর আবদুল্লাহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন জানান, তার ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ বলেন, ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। অতি ভাঙনকবলিত এলাকায় সাময়িক সময়ের জন্য বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হবে। কাজের অগ্রগতির বিষয়ে তিনি জানান, একনেক সভায় অনুমোদন হলেও এখনো ফাইল প্রসেসিং শেষ হয়নি। প্রক্রিয়া শেষে প্রকল্প অনুযায়ী অর্থছাড় পেলে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরেই তীর রক্ষা বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু করা যাবে। তবে প্রথম ধাপে ১০ কিলোমিটার করে মোট তিন ধাপে রক্ষা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে রয়েছে। মেঘনা নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ঠিকাদার নাকি রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে, সেটি সরকারের সিদ্ধান্ত।