শুরু থেকেই একের পর এক করোনায় মৃত ব্যাক্তিদের লাশ দাফন কাফন করে চলেছেন আলেম সমাজের একদল মানবতার প্রেমিক। পেশায় ওদের কেউবা মসজিদের খতিব, কেউ আবার মাদ্রাসা শিক্ষক। তাদের ৭ জনে মিলেই করেছেন মহামারি করোনায় মৃতদেহের দাফন কাফন কমিটি।
এ পর্ষন্ত তারা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলাতে ২২ জন করোনা মৃতদেহের লাশ দাফন কাফন সম্পন্ন করেছেন। কোন সরকারী সহায়তা ছাড়াই নিজেরদের অর্থায়নে এমন মহৎ কাজে এগিয়ে আসা ওই কমিটির সদস্যগন আতœমানবতার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
করোনার শুরুর পর এমনও দেখা গেছে, মৃত মা বাবাকে ফেলেও পালিয়েছে অনেক সন্তানেরা। আর আত্বীয় স্বজননেরা তো অনেকেই লাশই দেখতে আসেননি। এমন অবস্থায় যখন মানবতার পচন ধরেছিল, ঠিক সেই কঠিন মুহুর্ত্বেই এগিয়ে আসেন আলেম সমাজের একদল সেচ্ছাসেবী মানুষ। সে সময়ে তাদের ৮ জন মিলে করেছিলেন করোনায় মৃত্যুদেহ দাফন কাফন কমিটি। সে থেকেই নিজেরা ও কিছু রৃদয়বান মানুষের আর্থিক সহায়তায় দিনে রাতে করে চলেছেন মৃত ব্যাক্তিদের দাফন কাফন।
এক প্রকার কোন সরকারী সহায়তা ছাড়াই সেচ্ছাশ্রমে এগিয়ে আসা ওই গ্রæপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদের খতিব, গনমাধ্যমকর্মী মাওঃ রুহুল আমিন সৌরভ। গ্রæপের অন্যান্য সদস্যরা হলেন, আড়পাড়া নতুন বাজার জামে মসজিদের খতিব হাফেজ হেদায়েত উল্লাহ, বলিদাপাড়া কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ফারুক নোমানী, সিংদহ জামে মসজিদের খতিব মাওঃ আতাউর রহমান, বারবাজার কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওঃ ইয়াসিন, সাওতুলহেরা হাফেজি মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আসাদ ও সেচ্ছাসেবক যুবক হাবিবুর রহমান ময়না।
বর্তমানে মহামারি করোনার সন্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়া স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে অন্যতম দাফন কাফন সম্পন্নকারী কমিটির সদস্যগন। করোনাতে মৃত ব্যাক্তিদের লাশ যখন কেউই ছুয়েই দেখেনা, তখন তারাই মৃত্যু ভয়কে এড়িয়ে মৃতদেহের গোসল, কাফন পরিধান ও জানাজা নামাজ পড়ানো সহ কবর খননের পর দাফন করে থাকেন।
সরকারীভাবে সন্মুখযোদ্ধা হিসাবে খ্যাত স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের জন্য সরকারী বরাদ্ধের লক্ষ কোটি টাকা সহায়তা, উপকরন ও প্রনোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় জীবনের ঝুকি নিয়ে করোনার মৃতদেহের দাফনকারী ওই মানবপ্রেমিক কমিটিকে কোন সরকারী বরাদ্ধ দেওয়া হয় না।
করোনায় মৃত্যু দাফন কাফন কমিটির প্রধান কালীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সদস্য মাওঃ রুহুল আমিন সৌরভ জানান, ২০২০ সালের এপ্রিলে তারা এ কমিটি গঠন করেন। এরপর ইসলামী ফাউন্ডেশন এর সহায়তায় জেলা সির্ভিল সার্জন অফিস থেকে মৃতদেহ দাফন কাফনে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তিনি জানান, একটি মৃতদেহের দাফন কাফনে পিপিই, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হ্যান্ড গেøাভস সহ নানান উপকরন ক্রয়ে প্রায় ১৫ শত টাকা খরচ হয়।
সেচ্ছাশ্রমে কাজ করা তাদের গ্রæপের ৭ জন সদস্য এ খরচ বহন করে আসছেন। তবে, মাঝে মধ্যে কিছু দানশীল ব্যাক্তিগনও সহায়তাও করে থাকেন। তিনি জানান, করোনা শুরুর পর কিছুদিন স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্র থেকে কিছু পিপিই ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়া হত। কিন্তু এ বছরে তারা কোন কিছুই সহযোগিতা পাননি। এ উপজেলার ২০ টি ও অন্য উপজেলার আরো ২ টি সহ এ পর্সন্ত মোট ২২ জন মৃতদেহের সৎকার করেছেন। এরমধ্যে একজন সনাতন ধর্মের মৃতদেহও ছিল ।
দাফন কাফন কমিটির সদস্যগন আক্ষেপের সুরে বলেন, শুনেছি করোনা সন্মুখ যোদ্ধাদের জন্য সরকারীভাবে কোটি কোটি টাকা প্রনোদনা ছাড়াও করোনা সুরক্ষা উপকরন সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদেরকে কোন সরকারী সহায়তা দেওয়া হচ্ছেনা। তারা জানান, এ কাজের ট্রেনিং দেবারকালে বলা হয়েছিল দাফন কাফনের সময়ে স্থানীয় ইউএনও ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তাদের সাথে থাকবেন। কিন্তু অদ্যাবধি কোন মৃতদেহের দাফনে তাদেরকে পাননি তারা। অন্যদিকে, স্থানীয় সাংসদ কালীগঞ্জ উপজেলা আ’লীগের সাধারন সম্পাদক আনোয়ারুল আজিম আনার এ বছরে বেশ কয়েকটি করোনা মৃতদেহের জানাজা দাফনে অংশ নিয়েছেন। তবে ইসলামী ফাউন্ডেশনের ফিল্ড সুপারভাইজার মনিরুজ্জামান মাঝে মাঝে তাদের সাথে থেকেছেন। এছাড়াও এ কাজে প্রথমদিকে কয়েকটি দাফনে পুলিশ ফোর্স সাথে থাকলেও এখন আর তারাও থাকেন না বলে জানান।
করোনা মৃতদেহের দাফনে করতে গিয়ে কিছু সমস্যাদির কথা তুলে ধরে কমিটির প্রধান সৌরভ জানান, ২০২০ সালে প্রথম দিকে গ্রামের কিছু মানুষেরা খাটিয়া ও কবর খননের কোদাল দিতেও অসহযোগিতা করত। বর্তমানে এমন আচরন আর কেউ করেননা। বরং কিছু মানুষ এগিয়ে এসেও তাদের কাজে সহযোগিতা করে থাকেন।
তিনি তাদের নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে জানান, এ কমিটির সদস্যরা কেউই বিত্তশালী নন। সবাই সামান্য বেতনের মসজিদের খতিব ও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। এরমধ্যেই নিজেদের অর্থেই যানবাহন তেল ও উপকরন সামগ্রী কিনে খরচ করে আসছেন। বর্তমানে মাঝে মাঝে কিছু জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের থেকে পিপিইস মাকস পেয়ে থাকেন। তিনি জানান, এসব খরচ বহন করতে গিয়ে ইতিমধ্যে বাজারের একটি দোকানে প্রায় ৩ হাজার টাকা দেনাও হয়েছেন। এছাড়াও দাফনে বের হয়ে অনেক সময়ে তাদেরকে খাবারের কষ্ট পোহাতে হয়। এমনকি পর পর মৃতদেহ দাফন কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লে অনেক সময় নিজেদের পরিবারের বাজার পর্ষন্তও করতে পারেন না। তবুও কোন ক্ষোভ নেই তাদের।
তিনি আরো বলেন, ২/৩ দিন আগে তাদের কমিটির কিছু সদস্যই করোনা টিকা গ্রহন করেছেন। এর আগে নিজেদের জীবনের কথা না ভেবেই করোন শুরু থেকে এ পর্ষন্ত দাফন কাজ অব্যাহত রেখেছেন। তাদের কমিটিতে প্রথম দিকে হাফেজ শাহজালাল, মেহেদি হাসান ও মাহফুজুর রহমান নামে আরো তিনজন হাফেজ কাজ করত। কিন্তু আর্থিক অনটনে পড়ে ওই তিনজন এখন আর এ কাজে আসেননা। এত সমস্যাদির পরেও তারা সমাজের এমন মহৎ কাজে অংশ নিতে পারায় নিজেরা ভাগ্যবান বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
দাফন কাফন কমিটিকে সরকারী সহায়তার বিষয়ে জানতে ইসলামী ফাউন্ডেশনের কালীগঞ্জ ফিল্ড সুপারভাইজার মনিরুজ্জামান জানান ওই কমিটির জন্য তাদের ফাউন্ডেশন থেকে কোন বরাদ্ধ দেওয়া হয়না। তবে প্রথম দিকে সরকারী হাসপাতাল থেকে কিছু উপকরন পেত তারা।
করোনা সন্মুখ যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম দাফন কমিটিকে সরকারী বরাদ্ধ বা কোন সহায়তা পায় না এমন বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া জেরিন জানান, তিনি এ উপজেলাতে সদ্য যোগদান করেছেন। সরকারী বরাদ্ধ সহায়তার তালিকায় করোনা দাফন কাফন কমিটির নাম আছে কিনা তা তার জানা নেই। তিনি জানান, করোনা মৃতদেহ দাফনকারীরা সেচ্ছাশ্রমে একটি মহৎ করছেন। তাদের কাজের খরচে অবশ্যই সহায়তা পাওয়া উচিত। সরকারের সেন্ট্রাল পর্ষায়ে তাদেরকে সহায়তা দেবার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না তার খোজ খবর নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান।
বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ