১০:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫

জীবন বাঁচানোর শঙ্কায় আত্মগোপনে ছিলাম: খোকন সেরনিয়াবাত

একটি সদ্য স্বাধীন দেশের অগ্রযাত্রাকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার সুদীর্ঘ চক্রান্তের অংশ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, দেশি-বিদেশি অপশক্তি এবং ঘাতকচক্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর বিশ্বস্ত মানুষদের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করেছিল। সেই নির্মম রাতে জাতির পিতার অতি আস্থাভাজন ও তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার ও ভূমি রাজস্ব ও বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সরকারি বাসভবনে আক্রমণ করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় সেনাবাহিনীর বিপথগামী কতিপয় সেনা অফিসার। ২৯ নম্বর মিন্টু রোডে (বর্তমানে পুলিশ কমিশনার অফিস) আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সরকারি বাসভবনে সেদিন ঘাতকদের গুলি শরীরে নিয়েও দৈবক্রমে বেঁচে যান তাঁর ছেলে এবং বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত।

বিজনেস বাংলাদেশ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী দিনটি কেমন ছিল?
খোকন সেরনিয়াবাত: অন্যান্য দিনের মতোই দিনটি খুবই স্বাভাবিক ছিল। ১৪ আগস্ট আমার দাদির মৃত্যু দিবস ছিল। সেদিন আমাদের বাড়িতে মিলাদ মাহফিল আয়োজন করা হয়। আমাদের সরকারি বাসায় আত্মীয়-স্বজনদের উপস্থিতি ছিল। আমার দাদির মৃত্যুবার্ষিকী হলেও নিকট আত্মীয়দের উপস্থিতিতে উৎসবমুখরই ছিল পরিবেশ। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, সুলতানা কামাল, শেখ রাসেল, শেখ মণি, আরজু মণি, শেখ পরশ, শেখ তাপস, শেখ জামাল, রোজি জামাল, শেখ আবু নাসেরসহ অনেকেই সন্ধ্যার মিলাদে উপস্থিত ছিলেন আমাদের বাসায়। আমরা পারিবারিক বন্ধনে দারুণ সময় উপভোগ করি। আমাদের আড্ডা-গল্প চলে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত। এরপর অতিথিরা তাদের বাসার উদ্দেশে চলে যান। খুবই স্বাভাবিক ছিল সময়টি।

বিজনেস বাংলাদেশ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে?
খোকন সেরনিয়াবাত: সবাই চলে যাওয়ার পর আমরা সেদিন একটু বেশি রাতেই ঘুমাতে যাই। আনুমানিক ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে হবে, তখন বাইরে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমরা ভাই-বোনেরা নিজেদের রুম থেকে বের হয়ে আমার বাবা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের রুমে যাই। তখন আমার বাবাকে দেখলাম খুবই বিচলিত এবং আমার মা (বঙ্গবন্ধুর বোন) বলেন, ভাইজানকে ফোন দাও। বাবা তখন মামাকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিয়ে পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তখন ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে মামা (বঙ্গবন্ধু) বলেন তিনি বিষয়টি দেখেতেছেন। আমিসহ আরও অনেকেই আমার বাবার রুমে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উপস্থিত ছিলাম। খানিক পরেই কয়েকজন সেনাসদস্য আমাদের বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা সশস্ত্র অবস্থায় আমার বাবাসহ সবাইকে নিচের তলায় নামার জন্য বলে। আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি এবং তাদের নির্দেশে আমরা নিচতলার ড্রয়িং রুমে জড়ো হই। আমার বাবা তখন তাদের কমান্ডিং অফিসারের বিষয়ে জানতে চান। তবে তারা অস্ত্র উঁচিয়ে সময়ক্ষেপণ না করে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে।

বিজনেস বাংলাদেশ: যখন গুলি শুরু হয়, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
খোকন সেরনিয়াবাত: আমিও অন্যদের সাথে নিচতলার ডাইনিংয়ে জড়ো হই। এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হলে আমার পায়ে এসে গুলি লাগে এবং আমি লুটিয়ে পড়ি। আমার দুপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায় আমার বোন বেবি সেরনিয়াবাত এবং ভাই আরিফ সেরনিয়াবাত। দুজনই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যখন আমার মনে হলো সেনাসদস্যরা আমাদের বাসা থেকে প্রস্থান করেছে; তখন আমি উঠে দেখি, আমার বাবা-মা, ছোট ভাই, বোনসহ আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে স্থানীয় থানার একটি পুলিশের গাড়ি আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে এবং আহতদের রুম থেকে বের করে নিয়ে যায়।

বিজনেস বাংলাদেশ: পুলিশ আসার পর আপনি কী করলেন?
খোকন সেরনিয়াবাত: আমি তখন বাইরে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার বড় ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর মেয়ে কান্তা এবং ছেলে সাদিককে (বসিক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ) নিয়ে একটি রিকশায় চড়ে পুরান ঢাকায় চলে আসি। সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় কান্তা এবং সাদিককে নিরাপদে রেখে আমি আমার বোনের শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়ের একটি প্রিন্টিং প্রেসে আশ্রয় নিই।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব

জনপ্রিয়

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি নাগরিকের উপর ছিনতাইকারীর বর্বর হামলা ,দুই ছিনতাইকারী আটক

জীবন বাঁচানোর শঙ্কায় আত্মগোপনে ছিলাম: খোকন সেরনিয়াবাত

প্রকাশিত : ১২:১২:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ অগাস্ট ২০২২

একটি সদ্য স্বাধীন দেশের অগ্রযাত্রাকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার সুদীর্ঘ চক্রান্তের অংশ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, দেশি-বিদেশি অপশক্তি এবং ঘাতকচক্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর বিশ্বস্ত মানুষদের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করেছিল। সেই নির্মম রাতে জাতির পিতার অতি আস্থাভাজন ও তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার ও ভূমি রাজস্ব ও বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সরকারি বাসভবনে আক্রমণ করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় সেনাবাহিনীর বিপথগামী কতিপয় সেনা অফিসার। ২৯ নম্বর মিন্টু রোডে (বর্তমানে পুলিশ কমিশনার অফিস) আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সরকারি বাসভবনে সেদিন ঘাতকদের গুলি শরীরে নিয়েও দৈবক্রমে বেঁচে যান তাঁর ছেলে এবং বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত।

বিজনেস বাংলাদেশ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী দিনটি কেমন ছিল?
খোকন সেরনিয়াবাত: অন্যান্য দিনের মতোই দিনটি খুবই স্বাভাবিক ছিল। ১৪ আগস্ট আমার দাদির মৃত্যু দিবস ছিল। সেদিন আমাদের বাড়িতে মিলাদ মাহফিল আয়োজন করা হয়। আমাদের সরকারি বাসায় আত্মীয়-স্বজনদের উপস্থিতি ছিল। আমার দাদির মৃত্যুবার্ষিকী হলেও নিকট আত্মীয়দের উপস্থিতিতে উৎসবমুখরই ছিল পরিবেশ। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, সুলতানা কামাল, শেখ রাসেল, শেখ মণি, আরজু মণি, শেখ পরশ, শেখ তাপস, শেখ জামাল, রোজি জামাল, শেখ আবু নাসেরসহ অনেকেই সন্ধ্যার মিলাদে উপস্থিত ছিলেন আমাদের বাসায়। আমরা পারিবারিক বন্ধনে দারুণ সময় উপভোগ করি। আমাদের আড্ডা-গল্প চলে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত। এরপর অতিথিরা তাদের বাসার উদ্দেশে চলে যান। খুবই স্বাভাবিক ছিল সময়টি।

বিজনেস বাংলাদেশ: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে?
খোকন সেরনিয়াবাত: সবাই চলে যাওয়ার পর আমরা সেদিন একটু বেশি রাতেই ঘুমাতে যাই। আনুমানিক ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে হবে, তখন বাইরে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমরা ভাই-বোনেরা নিজেদের রুম থেকে বের হয়ে আমার বাবা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের রুমে যাই। তখন আমার বাবাকে দেখলাম খুবই বিচলিত এবং আমার মা (বঙ্গবন্ধুর বোন) বলেন, ভাইজানকে ফোন দাও। বাবা তখন মামাকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিয়ে পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তখন ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে মামা (বঙ্গবন্ধু) বলেন তিনি বিষয়টি দেখেতেছেন। আমিসহ আরও অনেকেই আমার বাবার রুমে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উপস্থিত ছিলাম। খানিক পরেই কয়েকজন সেনাসদস্য আমাদের বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা সশস্ত্র অবস্থায় আমার বাবাসহ সবাইকে নিচের তলায় নামার জন্য বলে। আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি এবং তাদের নির্দেশে আমরা নিচতলার ড্রয়িং রুমে জড়ো হই। আমার বাবা তখন তাদের কমান্ডিং অফিসারের বিষয়ে জানতে চান। তবে তারা অস্ত্র উঁচিয়ে সময়ক্ষেপণ না করে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে।

বিজনেস বাংলাদেশ: যখন গুলি শুরু হয়, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
খোকন সেরনিয়াবাত: আমিও অন্যদের সাথে নিচতলার ডাইনিংয়ে জড়ো হই। এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হলে আমার পায়ে এসে গুলি লাগে এবং আমি লুটিয়ে পড়ি। আমার দুপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায় আমার বোন বেবি সেরনিয়াবাত এবং ভাই আরিফ সেরনিয়াবাত। দুজনই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যখন আমার মনে হলো সেনাসদস্যরা আমাদের বাসা থেকে প্রস্থান করেছে; তখন আমি উঠে দেখি, আমার বাবা-মা, ছোট ভাই, বোনসহ আরও কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে স্থানীয় থানার একটি পুলিশের গাড়ি আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে এবং আহতদের রুম থেকে বের করে নিয়ে যায়।

বিজনেস বাংলাদেশ: পুলিশ আসার পর আপনি কী করলেন?
খোকন সেরনিয়াবাত: আমি তখন বাইরে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার বড় ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর মেয়ে কান্তা এবং ছেলে সাদিককে (বসিক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ) নিয়ে একটি রিকশায় চড়ে পুরান ঢাকায় চলে আসি। সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় কান্তা এবং সাদিককে নিরাপদে রেখে আমি আমার বোনের শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়ের একটি প্রিন্টিং প্রেসে আশ্রয় নিই।

বিজনেস বাংলাদেশ/হাবিব