তিন তিনজন শিক্ষকের তত্বাবধানে,লেখাপড়ার চাপে অসহ্য হয়ে মা’কে বললাম,প্রনব বাবু স্যারের কাছে আমার পড়তেই হবে।
মা ‘তো খুশী,পড়তে চাও পড়!ভোর পাঁচটায় ‘দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটেই আমাদের পাড়া থেকে চৌমুহনী হয়ে তেমুহনী’প্রনব স্যারের বাসায় আমার যাওয়া শুরু হল।স্যার অনেক বুড়ো হলেও বিয়ে করেননি,উনার বাসায় থাকতো বোনের পরিবার।প্রতিদিন দেখতাম বোন মরিচ পিষছে।সারা ঘরের খড়ের চাল বেয়ে বৃষ্টির পানি পড়তো,তাই সারা ঘরে বিশ বাইশটা ডেকচি গামলা রাখা হতো জল ধারনের।খাটের নীচে হাস মুরগীর থাকবার ব্যবস্থা।
মুরগী মুরগীর ছানারা বিছানায় ঘুরে বেড়াতো,ডেকচি পাতিল থালা থেকেই সহাবস্হানে খাবার খেতো।বাড়ির কড়াকড়ি নিয়ম কানুনে আমি এই ভিন্ন পরিবেশখানা দারুন ভালবাসলাম।পান সুপারির বাটা থাকতো আমাদের হাতে।স্যার গালভর্তি পান খেতেন।ছিটকে আমাদের বইখাতা নস্ট। তবুও মনে হতো বেশ আছি,অন্তত অনীল স্যার,দয়াল স্যারের মতোতো ভয় পাইনা।
অনীল স্যারতো আমাদের কৈশোরের বাঘ।যিনি ঘন বর্ষা আক্রান্ত চার কিলো কাঁদা পথ হেঁটে শুক্রবারও আমাদের পড়াতেন।একদিন আমি ও আমার মেজো ভাই,দোয়া-দরুদ পরতে থাকলাম,যেন স্যার একটি পিছলা খান।কাচারি ঘর থেকে সোজা রাস্তাটি মসজিদ পর্যন্ত নজরে আসে,স্যার দেখি গপ গপ হেঁটে অগ্রসরমান, আমাদের দোয়া দরুদ উচ্চকিত।হঠাত স্যার পিছলা খেয়ে কা্দায় শোয়া!আমরাতো হাসতে হাসতে খেলায় মেতে গেলাম,কিযে মুক্তি মনে হচ্ছিল!পাঁচমিনিট পরেই দেখলাম স্যার পুকুরের জলে গলা পর্যন্ত ধুয়ে ভেজা কাপড়ে বেত নিয়ে চেয়ারে বসলেন বরাবরের তিন ঘন্টার মতো!
তো প্রনব স্যারের ঘরে আমার পড়ার জায়গা হলো রান্না ঘরের দাওয়ায়,বিছানায় পড়তো ছয়জন,স্যার আমাকে একটি মোরা দিয়ে বিছানার এক কোনে জায়গা করে দিলেন।তিন রুম জুড়ে পড়ার জায়গা,নিরীক্ষন সুবিধার জন্য প্রতি ঘরের ভাঙ্গা বেড়া আরও ভাঙ্গা হতো। আমাদের পাশের খিজারী স্কুলের মেধাবীরাও এখানে পরতো। সারাদিনই ব্যাচ।চাইলে সারাদিনও থাকা যেতো।পাশেই ছিল একটি ভাঙ্গা শোকেস।মেধাবী ছেলেরা দেখতাম শোকেসে বইখাতা রেখে দাড়িয়ে পরতো।মূলত আমরা যারা পড়ালেখায় এগিয়ে ছিলাম,আমাদের কাজ ছিল জুনিয়র দের পড়ানো।
একদিন খিজারীর মেধাবী একছেলে যে কিনা আমাদের এলাকায় দূরান্ত থেকে এসে লজিং থেকে পড়ালেখা চালাতো,আমাকে একটি ইংরেজি নোট দিল,তার লেখা এতো নিঁখুত ছিলযে আমি তার খাতায় লিখে দিলাম,”You are a good student……কাবেরী।”পরের দিনই ছোট্ট চিরকুট পেলাম,বইয়ের ফাঁকে।লিখেছে,”You said to me that i am a good student but i am not a good student,i am not hesitating to say that you are a good student. বাংলায় লিখল,নাম ছাড়া বুঝি আর কিছু লিখতে জানোনা,এবার দেখা যাবে কিছু লিখতে জানো কিনা।”বেশ কদিন চমতকার বোধ করছিলাম,তবে উত্তর দিতে শঙ্কিত ছিলাম।কদিন পরেই বুঝলাম,আমার ব্যাচমেট বান্ধবী যে প্রনব স্যারের কাছে আমার পড়তে আসায় আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল, মেয়েটি ‘ছেলেটাকে প্রচন্ড ভালবাসে।
অধ্যাপক আবুসাইয়িদ স্যার সেদিন এক টক শোতে বললেন,প্রেমের বয়স নাকি কমপক্ষে চারদিন আর বেশী হলে চার বছর। তবে আমি উনার কথাটাতে একমত নই।চার দিন চারবছর ‘যার সম্পর্ক তা শুধু ভালো লাগা,পদে পদেই ভালো লাগা তৈরি হয়,তবে ভালোবাসা কঠিন কুটচাল। একবার যে মন টিকে যায় সে মন স্খলিত হওয়া বড় কস্টের।একবার যে চোখ মিলে যায়,সে চোখ আর কখনো কোথাও দেখা যায়না।একবার যে হৃদয় ধরে যায়,তাকে বোঝানোই বড় ধৈর্যের।ভালো লাগায় বিশ্লেষায়িত হয়।
ভালোবাসায় দরদাম নেই,জাতকুল,অবস্হান,শঙ্কা কোনকিছুই সে মানতে নারাজ।
ঠুনকো কাঁচের গ্লাস ভাঙ্গারও তীর্যক শব্দ হয়।
তেজস্বী স্রোত ধারার ও গর্জন শোনা যায়।
প্রবহমান দুখিনী নদীর ও কান্নার গোঙ্গানি থাকে।
মেঘের ঘর্ষণ শব্দে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়।
মন ভাঙ্গার কোন শব্দ নেই।ভালোবাসাই শব্দহীন,অবিরল,অসীম।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেত্রী
বিবি/রেআ