০৩:২২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাইডেন কি লিংকনের ভূমিকা পালন করতে পারবেন?

বিল ক্লিনটন তিন দশক আগে যেদিন শপথ নিয়েছিলেন, সেদিন ওয়াশিংটনের আকাশ মেঘমুক্ত ছিল। তিন দশক পর জো বাইডেনের শপথের দিনও ওয়াশিংটনের আকাশে রোদ হেসেছিল। রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণ করেছেন, প্রকৃতির দিক থেকে এর কি ভিন্ন কোনো বার্তা বা তাৎপর্য ছিল? ঘন কালো মেঘের আড়াল থেকে অনেক দিন পর রোদ হেসে উঠলে মানুষের মন যেমন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মন কি তেমন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল সেদিন। ঘটনাপরম্পরায় তো আমাদের তা-ই মনে হয়। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণে বাধা সৃষ্টির জন্য সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি না করেছেন। আব্রাহাম লিংকনের যুক্তরাষ্ট্রে এর থেকে বেশি কালিমা লেপন যে আর কেউ করেননি এ বিষয়টি দল-মত-নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করছেন। মিথ্যা বলাকে ট্রাম্প রীতিমতো একটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মিথ্যা দিয়ে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি শুরু করার প্রমাণ সিএনএন হাজির করেছে। তারা জানায়, অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় হওয়া বৃষ্টি নিয়ে শুরুর মিথ্যাটা বলেছিলেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে পা রাখার পর থেকে ক্ষমতার চার বছরে ট্রাম্প মিথ্যার বন্যা বইয়ে দেন। ট্রাম্পের মিথ্যার একটা হিসাব ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার ‘ফ্যাক্ট চেক’ থেকে পাওয়া যায়। পত্রিকাটি জানায়, ২০২০ সালের ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প ২০ হাজার মিথ্যার ‘মাইলফলক’ স্পর্শ করেন। আর ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ট্রাম্প ২৯ হাজার ৫০৮টি মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর কথা বলেন। এই মিথ্যা দিয়ে তিনি তাঁর সমর্থকদের উসকে ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে রক্তক্ষয়ী হামলার কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন। এ রকম হামলা সারা বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র চর্চা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভাবমূর্তি কতটুকু ম্লান করল, তা আগামী বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব পর্যায়ের মানুষরা কিছুটা টের পাবেন।
করোনা প্রতিরোধে নেতৃত্ব পর্যায়ে উদাসীনতা, নিছক শিশুসুলভ আচরণের মূল্য দিতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের। করোনা প্রতিরোধে যেখানে গবেষক, চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্য বিভাগ মাস্ক পরাটাকে সবচেয়ে গুরুত্ব প্রদান করেছে, সেখানে করোনা ও মাস্ক পরিধান না করাকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উৎসাহিত করেছেন। রিপাবলিকান সরকার এবং তাঁর নেতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাণ্ডজ্ঞানহীন এ রকম একগুঁয়েপনার কারণে মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে চার লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে করোনা মহামারিতে মৃতের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে হাল ধরতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ইতিহাসকে ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্রে কমলা হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের চলমান সহিংসতার কারণে সৃষ্ট অস্থিরতার ভেতরে বসেও নাগরিকদের শান্তির বাণী শুনিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গণতন্ত্র উতরে গেছে, সহনশীলতা আর মানবিকতা ফিরে আসছে এমন প্রত্যাশার কথা শুধু তিনি উচ্চারণ করেননি, কাজেও দেখিয়েছেন। শুরুর দিনেই তাই কাজে নেমে পড়েছেন। অনেকটা বিপ্লবী সরকারের মতো মানুষের কাছে পরিবর্তনের প্রত্যাশা দমে যাওয়ার আগে একটা ইতিবাচক চেতনায় মার্কিন নাগরিকদের জাগিয়ে তোলার এমন প্রচেষ্টাও নজিরবিহীন। জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজে বিভক্তি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রই এক বড় সংকটে উপনীত হয়েছে। তাই জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম ভাষণে যখন বলেন যে গণতন্ত্র মূল্যবান, গণতন্ত্র ভঙ্গুরÑএই মুহূর্তে গণতন্ত্রই বিজয়ী হয়েছে, তখন তা পরোক্ষভাবে মার্কিনদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে গণতন্ত্র রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁদের। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আব্রাহাম লিংকনের ভূমিকায় নামতে হচ্ছে। বিশ্বসভ্যতার বাঁক পরিবর্তনের একজন মহানায়ক আব্রাহাম লিংকন। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার চরম দুঃসময়ে পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে তিনি শুধু আমেরিকানদেরই নন, সারা বিশ্বের মানুষকে মানবতার বাণী, মানবাধিকারের বাণী শুনিয়েছিলেন। জাতি হিসেবে আমেরিকানরা সেদিন পেয়েছিল এক অসাধারণ দিকনির্দেশনা।
আব্রাহাম লিংকন তাঁর ভাষণের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে মানবিকভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। নাগরিকদের শাসন, গণমানুষের শাসনের নিখুঁত ছবি তিনি তুলে ধরেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে। লিংকন তাঁর বিখ্যাত সেই ভাষণে মানুষের ন্যায্যতার সনদ, গণতন্ত্রের মৌলবাণী উপস্থাপন করে বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’ যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের মানুষ এক অনিন্দ্যসুন্দর কল্যাণমুখী শাসনব্যবস্থার সন্ধান পেল, যে ব্যবস্থার বিকল্প এখনো পৃথিবী খুঁজে পায়নি। আব্রাহাম লিংকনের দেখানো পথ ধরে যুক্তরাষ্ট্র সেই যে পথচলা শুরু করে, সেই পথ তাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এক উদাহরণসম দেশ হিসেবে পরিণত করতে সহায়তা করে। যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী সময়ের রাষ্ট্রনায়কদের তাই আর কোনোভাবেই অগণতান্ত্রিক, অমানবিকভাবে দেশ শাসনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে প্রতিফলিত করার জন্য বাইডেনের আন্তরিকতা যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর সব মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আশার কথা, জো বাইডেন শুরু থেকেই ‘আমি’ না বলে ‘আমরা’ বলছেন, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। বিভক্তি হ্রাসের কথা বলছেন, যে কথাগুলো গত চার বছরে অনুপস্থিত ছিল। বাইডেন সর্বনাশা আমিত্ব অর্থাৎ কর্তৃত্বপরায়ণতার অবসান চাচ্ছেন, এ কথাটি খোলাখুলিভাবে বলছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পৃথিবীর ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে জো বাইডেনের আচরণ ও কর্মে রাষ্ট্রনায়কের ছাপ দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ বিভক্তি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সে অবস্থা থেকে যদিও ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন, তার পরও সময়ের দাবি হিসেবে তিনি আন্তরিকভাবে ঐক্য কামনা করেছেন।
বাইডেন কি পারবেন আব্রাহাম লিংকনের মতো ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে যুক্তরাষ্ট্রে সৃষ্ট বিভক্তিকে হ্রাস করতে? অনেকেই মনে করছেন, ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। গণতন্ত্রের গায়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সে ক্ষতকে সারিয়ে তোলা সাধারণ কাজ নয়। জো বাইডেন হয়তো আব্রাহাম লিংকন হতে পারবেন না; কিন্তু তাঁকে সেই ধারার দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজটা যে সহজ নয়, এ কথাটি মনে হয় পৃথিবীর সব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রনায়করা স্বীকার করবেন। জো বাইডেনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিপুল প্রত্যাশা, সেই প্রত্যাশার পাহাড় মাথায় নিয়ে তাঁকে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে যেতে হবে, প্রতিশ্রুত কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনমনে তাঁকে বিশ্বাস জন্মাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র আবার সহিষ্ণু, মানবিক ও উদার দেশ হিসেবে সবার কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠবেÑএই হলো বিশ্বের সব মানুষের আন্তরিক প্রত্যাশা।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

বাইডেন কি লিংকনের ভূমিকা পালন করতে পারবেন?

প্রকাশিত : ১২:০০:২৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১

বিল ক্লিনটন তিন দশক আগে যেদিন শপথ নিয়েছিলেন, সেদিন ওয়াশিংটনের আকাশ মেঘমুক্ত ছিল। তিন দশক পর জো বাইডেনের শপথের দিনও ওয়াশিংটনের আকাশে রোদ হেসেছিল। রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণ করেছেন, প্রকৃতির দিক থেকে এর কি ভিন্ন কোনো বার্তা বা তাৎপর্য ছিল? ঘন কালো মেঘের আড়াল থেকে অনেক দিন পর রোদ হেসে উঠলে মানুষের মন যেমন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মন কি তেমন উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল সেদিন। ঘটনাপরম্পরায় তো আমাদের তা-ই মনে হয়। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত একজন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণে বাধা সৃষ্টির জন্য সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি না করেছেন। আব্রাহাম লিংকনের যুক্তরাষ্ট্রে এর থেকে বেশি কালিমা লেপন যে আর কেউ করেননি এ বিষয়টি দল-মত-নির্বিশেষে সবাই স্বীকার করছেন। মিথ্যা বলাকে ট্রাম্প রীতিমতো একটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মিথ্যা দিয়ে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি শুরু করার প্রমাণ সিএনএন হাজির করেছে। তারা জানায়, অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় হওয়া বৃষ্টি নিয়ে শুরুর মিথ্যাটা বলেছিলেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে পা রাখার পর থেকে ক্ষমতার চার বছরে ট্রাম্প মিথ্যার বন্যা বইয়ে দেন। ট্রাম্পের মিথ্যার একটা হিসাব ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার ‘ফ্যাক্ট চেক’ থেকে পাওয়া যায়। পত্রিকাটি জানায়, ২০২০ সালের ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প ২০ হাজার মিথ্যার ‘মাইলফলক’ স্পর্শ করেন। আর ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ট্রাম্প ২৯ হাজার ৫০৮টি মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর কথা বলেন। এই মিথ্যা দিয়ে তিনি তাঁর সমর্থকদের উসকে ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল ভবনে রক্তক্ষয়ী হামলার কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন। এ রকম হামলা সারা বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র চর্চা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভাবমূর্তি কতটুকু ম্লান করল, তা আগামী বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব পর্যায়ের মানুষরা কিছুটা টের পাবেন।
করোনা প্রতিরোধে নেতৃত্ব পর্যায়ে উদাসীনতা, নিছক শিশুসুলভ আচরণের মূল্য দিতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের। করোনা প্রতিরোধে যেখানে গবেষক, চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্য বিভাগ মাস্ক পরাটাকে সবচেয়ে গুরুত্ব প্রদান করেছে, সেখানে করোনা ও মাস্ক পরিধান না করাকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উৎসাহিত করেছেন। রিপাবলিকান সরকার এবং তাঁর নেতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাণ্ডজ্ঞানহীন এ রকম একগুঁয়েপনার কারণে মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে চার লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে করোনা মহামারিতে মৃতের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে হাল ধরতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ইতিহাসকে ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্রে কমলা হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের চলমান সহিংসতার কারণে সৃষ্ট অস্থিরতার ভেতরে বসেও নাগরিকদের শান্তির বাণী শুনিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গণতন্ত্র উতরে গেছে, সহনশীলতা আর মানবিকতা ফিরে আসছে এমন প্রত্যাশার কথা শুধু তিনি উচ্চারণ করেননি, কাজেও দেখিয়েছেন। শুরুর দিনেই তাই কাজে নেমে পড়েছেন। অনেকটা বিপ্লবী সরকারের মতো মানুষের কাছে পরিবর্তনের প্রত্যাশা দমে যাওয়ার আগে একটা ইতিবাচক চেতনায় মার্কিন নাগরিকদের জাগিয়ে তোলার এমন প্রচেষ্টাও নজিরবিহীন। জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজে বিভক্তি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রই এক বড় সংকটে উপনীত হয়েছে। তাই জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম ভাষণে যখন বলেন যে গণতন্ত্র মূল্যবান, গণতন্ত্র ভঙ্গুরÑএই মুহূর্তে গণতন্ত্রই বিজয়ী হয়েছে, তখন তা পরোক্ষভাবে মার্কিনদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে গণতন্ত্র রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁদের। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আব্রাহাম লিংকনের ভূমিকায় নামতে হচ্ছে। বিশ্বসভ্যতার বাঁক পরিবর্তনের একজন মহানায়ক আব্রাহাম লিংকন। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার চরম দুঃসময়ে পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে তিনি শুধু আমেরিকানদেরই নন, সারা বিশ্বের মানুষকে মানবতার বাণী, মানবাধিকারের বাণী শুনিয়েছিলেন। জাতি হিসেবে আমেরিকানরা সেদিন পেয়েছিল এক অসাধারণ দিকনির্দেশনা।
আব্রাহাম লিংকন তাঁর ভাষণের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে মানবিকভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। নাগরিকদের শাসন, গণমানুষের শাসনের নিখুঁত ছবি তিনি তুলে ধরেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে। লিংকন তাঁর বিখ্যাত সেই ভাষণে মানুষের ন্যায্যতার সনদ, গণতন্ত্রের মৌলবাণী উপস্থাপন করে বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র হলো জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’ যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের মানুষ এক অনিন্দ্যসুন্দর কল্যাণমুখী শাসনব্যবস্থার সন্ধান পেল, যে ব্যবস্থার বিকল্প এখনো পৃথিবী খুঁজে পায়নি। আব্রাহাম লিংকনের দেখানো পথ ধরে যুক্তরাষ্ট্র সেই যে পথচলা শুরু করে, সেই পথ তাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এক উদাহরণসম দেশ হিসেবে পরিণত করতে সহায়তা করে। যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী সময়ের রাষ্ট্রনায়কদের তাই আর কোনোভাবেই অগণতান্ত্রিক, অমানবিকভাবে দেশ শাসনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে প্রতিফলিত করার জন্য বাইডেনের আন্তরিকতা যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর সব মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আশার কথা, জো বাইডেন শুরু থেকেই ‘আমি’ না বলে ‘আমরা’ বলছেন, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। বিভক্তি হ্রাসের কথা বলছেন, যে কথাগুলো গত চার বছরে অনুপস্থিত ছিল। বাইডেন সর্বনাশা আমিত্ব অর্থাৎ কর্তৃত্বপরায়ণতার অবসান চাচ্ছেন, এ কথাটি খোলাখুলিভাবে বলছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পৃথিবীর ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে জো বাইডেনের আচরণ ও কর্মে রাষ্ট্রনায়কের ছাপ দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ বিভক্তি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সে অবস্থা থেকে যদিও ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন, তার পরও সময়ের দাবি হিসেবে তিনি আন্তরিকভাবে ঐক্য কামনা করেছেন।
বাইডেন কি পারবেন আব্রাহাম লিংকনের মতো ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে যুক্তরাষ্ট্রে সৃষ্ট বিভক্তিকে হ্রাস করতে? অনেকেই মনে করছেন, ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। গণতন্ত্রের গায়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সে ক্ষতকে সারিয়ে তোলা সাধারণ কাজ নয়। জো বাইডেন হয়তো আব্রাহাম লিংকন হতে পারবেন না; কিন্তু তাঁকে সেই ধারার দৃঢ়তা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজটা যে সহজ নয়, এ কথাটি মনে হয় পৃথিবীর সব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রনায়করা স্বীকার করবেন। জো বাইডেনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিপুল প্রত্যাশা, সেই প্রত্যাশার পাহাড় মাথায় নিয়ে তাঁকে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে যেতে হবে, প্রতিশ্রুত কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনমনে তাঁকে বিশ্বাস জন্মাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র আবার সহিষ্ণু, মানবিক ও উদার দেশ হিসেবে সবার কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠবেÑএই হলো বিশ্বের সব মানুষের আন্তরিক প্রত্যাশা।