০৬:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা

  • রণেশ মৈত্র
  • প্রকাশিত : ১২:০০:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১
  • 34

করোনা যেহেতু মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে রোগ তাই করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগযোগ্য কোনো ব্যক্তিই তা তিনি বা তারা যে দেশেরই মানুষ হন না কেন যেন ভ্যাকসিন বঞ্চিত না থাকেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। এক দেশ মুক্ত হলো- অন্যদেশ হলো না এমনটিও চলবে না করোনার ক্ষেত্রে। সামান্য ত্রুটি, সামান্য অবহেলা (আমেরিকার ক্ষেত্রে আমরা যা প্রত্যক্ষ করলাম) ভয়াবহ বৈশ্বিক বিপর্যয় দফায় দফায় ডেকে আনতে পারে। আমরা যেন ভুলে না যাই- বৈষম্য এ ধরনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য করোনামুক্ত বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে।
করোনা সারা বিশ্বে এক ভয়াবহ মহামারির সৃষ্টি করেছে। গোটা বিশ্বের মানুষ আজ গভীর সংকটে। কয়েক কোটি মানুষ সংক্রমিত বিগত একটি বছরে। নতুন বছরকে তবুও মানুষ স্বাগত জানিয়েছে গভীর প্রত্যাশায়। প্রত্যাশা করোনামুক্তির, প্রত্যাশা রোগমুক্ত নিরাপদ ও নিরুদ্বেগ জীবনের। নতুন বছরটির দ্বিতীয় মাস পড়লেও মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণের সামান্যতম লক্ষণও আজ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। এখনো মৃত্যুর হিমশীতল মিছিল দেশে দেশে চলছেই। মৃত্যুর ও আক্রান্তের সংখ্যাও দিনে দিনে বাড়ছেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করা বিশ্বের জন্য কঠিন হলেও আমাদের দেশের পরিস্থিতি অনেক ভালো। বিগত কয়েকদিনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। বিজ্ঞানীরা সারা বিশ্বে কাজ করে চলেছেন মানুষ বাঁচানোর লক্ষ্যে। তাদের অভিবাদন তারা করোনার প্রতিরোধক হিসেবে ভ্যাকসিন বহু গবেষণা, পরীক্ষ-নিরীক্ষা প্রভৃতি প্রাণীদেহে, মানবদেহে ঘটিয়ে নানা দেশে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে বিশ্বে মানুষ বাঁচানোর অভিযান চালাচ্ছেন। শতভাগ সাফল্যের নিশ্চয়তা তবুও আজও পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন এবং সেগুলোর কার্যকারিতাও ভিন্ন ভিন্ন বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। কোনো ব্র্যান্ডের ভ্যাকসিন কমবেশি শতকরা ৮০ ভাগ সাফল্য দাবি করেছে-কোনোটা আবার ৭০ ভাগের মতো। কোনোটা ৫০ ভাগের মতো বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোই শুধু নয়- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সেগুলোর অনুমোদন দিয়েছে।
অনুমোদন পাওয়ার পর কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বাজারজাত করার জন্য ব্যাপকভাবে উৎপাদন শুরু করতে না করতেই বহুদেশ বিভিন্ন কোম্পানিকে অগ্রিম টাকা দিয়ে দ্রুত যাতে তাদের প্রয়োজনমতো পেয়ে যায় তা নিশ্চিত করেছে। অনেক দেশ ইতিমধ্যে হাজারে হাজারে নানাস্তরে মানুষের মধ্যে প্রয়োগও করতে শুরু করেছে। বাঁচার জন্য পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের এমন লড়াই একযোগে ঘটতে অতীতে কোনো দিন পৃথিবীর কোনো দেশেই দেখা যায়নি।
আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনগুলোর পরিবহণ সংরক্ষণও যথেষ্ট কঠিন। কোনো কোম্পানির ভ্যাকসিন-৭০ ডিগ্রির নিচে অত্যধিক ঠান্ডায় রেখে পরিবহণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ওই তাপমাত্রা মানবদেহে প্রয়োগের মুহূর্ত পর্যন্ত বজায় রাখতে হবে। পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশেও এমন সংরক্ষণ পরিবহণ ব্যবস্থা নেই, ছিলও না। ফলে তাদের তেমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হচ্ছে।
আবার ভ্যাকসিনের দামের ভিন্নতা দেশভেদে-কোম্পানিভেদে যথেষ্ট কম-বেশি। এটিও কম সংকট নয়। এতে সংশয়ের সৃষ্টিও হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সাধারণ ভাবনা হলো যে ভ্যাকসিনের দাম যত বেশি সে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাও তত বেশি। অনুরূপভাবে যে কোম্পানির ভ্যাকসিনের দাম যত কম সে ভ্যাকসিনের উপকারিতাও নাকি কম। এমন ধারণা হতেই পারে দামের ব্যাপক পার্থক্যের কারণে। এ ব্যাপারে একমাত্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই পারে মানুষকে সঠিক ধারণা দিয়ে সংশয় মুক্ত করতে।
দামের এই ভিন্নতা আবার অস্বাভাবিকও নয়। কারণ বিভিন্ন দেশে উৎপাদন ব্যয় বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে এবং উৎপাদন ব্যয়ই শেষবিচারে পণ্যের মূল্য নির্বাচনে সর্বোচ্চ বা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে থাকে। তদুপরি, নানা দেশে বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্যাকসিন পাঠাতে পরিবহণ খরচ, সংরক্ষণ খরচ প্রভৃতি বিভিন্ন রকমের। পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে আসা পর্যন্ত মূল্যের ব্যাপক তারতম্য ঘটার আশঙ্কা। আর এ আশঙ্কা সত্য হলে ভ্যাকসিনটি ধনীর দুলালরা ছাড়া সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন মানুষ ক্রয়শক্তির অভাবে বঞ্চিত হবেন কিনা সে শঙ্কাকে এই মুহূর্তে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতগুলো সংশয় ধারণ করার পর আরো একটি সংশয়ের সৃষ্টি হলো আরো একটি খবর দেখে। খবরটি হলো ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এ খবর সত্য হলে দ্রুত অনুসন্ধান করা দরকার ওই মৃত ব্যক্তিরা আগে থেকে করোনায় আক্রান্ত বা লক্ষণযুক্ত ছিলেন কিনা, তারা কোন ব্রান্ডের ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয়াদি। তবে একথা ঠিক, পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ওষুধের কার্যকারিতা কখনোই সমান হয় না। কিছু মৃত্যু ঘটতেই পারে। তবে দেখার বিষয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর মানুষ করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকছেন কিনা।
সংশয় আরো একটি। আমরা কলেরার টিকা, বসন্তের টিকা, শিশুদের ভিন্ন ধরনের টিকা আরো নানা রোগের নানাজাতীয় টিকা নিয়ে শতভাগ সাফল্য অর্জনের অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছি। আজ আর ওই রোগগুলোর অস্তিত্বও চোখে পড়ে না। কিন্তু কোনো কোনো ব্র্যান্ডের করোনা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মেয়াদ না কি দুই বছর মাত্র। এ তথ্য সঠিক হলে প্রশ্ন থেকেই যায় একটি মানুষ তার জীবদ্দশায় করোনামুক্ত থাকতে হলে তাকে কতবার ভ্যাকসিনটি নিতে হবে? অথবা আর্থিক সাধ্যশক্তি কমে এলে যখন ক্রয়ক্ষমতা শূন্যের কোটায় নেমে আসে তখন তারা, দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাকসিন ব্যবহার করে করোনামুক্ত থাকার পর আবার ব্যবহারের আর্থিক শক্তিহীনতার কারণেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়বেন।
তাই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যাতে প্রতিটি দেশের সব নাগরিকই ভ্যাকসিন সুবিধা নিশ্চিতভাবে পেতে পারেন তা নিশ্চিত করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
করোনা যেহেতু মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে রোগ তাই করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগযোগ্য কোনো ব্যক্তিই তা তিনি বা তারা যে দেশেরই মানুষ হন না কেন যেন ভ্যাকসিন বঞ্চিত না থাকেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। এক দেশ মুক্ত হলো- অন্যদেশ হলো না এমনটিও চলবে না করোনার ক্ষেত্রে। সামান্য ত্রুটি, সামান্য অবহেলা (আমেরিকার ক্ষেত্রে আমরা যা প্রত্যক্ষ করলাম) ভয়াবহ বৈশ্বিক বিপর্যয় দফায় দফায় ডেকে আনতে পারে। আমরা যেন ভুলে না যাই- বৈষম্য এ ধরনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য করোনামুক্ত বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে।
তাই একদিকে ভ্যাকসিন উৎপাদন কোম্পানিগুলোর উচিত হবে বিশ্বের সবার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা সৃষ্টির স্বার্থে মান অক্ষুণ্ণ রেখে ভ্যাকসিনের দাম যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা; অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের মানের বা কার্যকারিতার ক্ষেত্রে বিরাজমান বিভিন্নতা দূর করা এবং ভ্যাকসিনের পরিবহণ-সংরক্ষণ প্রভৃতির ক্ষেত্রে তাপমাত্রা এমন মাত্রায় নিয়ে আসা যাতে সাধারণের ব্যবহৃত ফ্রিজে তা সংরক্ষণ করলেও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হ্রাস না পায়।
সর্বাপেক্ষা বড় কথা হলো- মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন দেশের সব নাগরিকের জন্যই (যাদের ভ্যাকসিন দেওয়া মেডিকেল কারণে অনুচিত তাদের বাদ দিয়ে) বিনামূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা অতি অবশ্য করা প্রয়োজন। আবার যেহেতু রোগটি মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে তাই সবাইকে করোনামুক্ত করতে না পারলে সংক্রমণ পুনর্সংক্রমণ ঘটতেই থাকবে। এ বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। আমাদের প্রতিদিনের করোনাক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তির সংখ্যা হ্রাসের সুখবর শোনানো হচ্ছে। আমরাও খুশি হচ্ছি কিন্তু গভীরভাবে সংশয়াচ্ছন্নচিত্তে। প্রতিদিন পরীক্ষার সংখ্যা কমানো হচ্ছে ফলে মৃতের সংখ্যা তো স্বাভাবিকভাবেই কম আসবে। যেখানে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটিরও অধিক সেখানে মাত্র আট লাখ মানুষের করোনা টেস্ট সম্পন্ন হওয়ার খবর যে কোনো বিচারেই অগ্রহণযোগ্য ও হতাশা ব্যঞ্জক। টেস্ট যেন সরকারের বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় অবাঞ্ছিত তাই কিছুদিন বিনা পয়সায় টেস্ট করার পর তার ওপর মূল্য ধার্য করা হলো। ফলে টেস্টের সংখ্যা কমে গেল। দিন দিন প্রচারের কল্যাণে আরও কমছে। ফলে টেস্ট না করার কারণে জানাও যাচ্ছে না বাংলাদেশে কতজন প্রতিদিন প্রকৃত প্রস্তাবে করোনা সংক্রামিত হচ্ছেন কতজন মারা যাচ্ছেন। পৃথিবীর সব দেশে করোনা টেস্ট বিনা পয়সায় করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অনুরূপভাবে ভ্যাকসিনও বেশির ভাগ দেশে বিনামূল্যে নাগরিকদের দিচ্ছে। তাদের তুলনায় আমরা আদৌ ধনী রাষ্ট্র নই বরং বহুলাংশ গরিব। তবে আমাদের দেশেও বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। তদুপরি, অন্যান্য দেশে যেভাবে কঠোরভাবে মানুষজনকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করেছে, আমাদের দেশে কার্যত তা করা হয়নি। ফলে ছোঁয়াচে এই রোগটির ব্যাপক সংক্রমণ ঘটাই স্বাভাবিক। সেদিন ভারতে গেল কুম্ভস্নান। স্বাস্থ্য বিধি মানানো হলো স্নানার্থী-পুণ্যার্থীদের। আমরা গণপরিবহণেও স্বাভাবিকভাবে মানুষ চলাচল করতে দিচ্ছি। এসব বিবেচনায় নিতে হবে উপেক্ষণীয় নয় আদৌ।
লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

সীতাকুণ্ডে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৭

ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা

প্রকাশিত : ১২:০০:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১

করোনা যেহেতু মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে রোগ তাই করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগযোগ্য কোনো ব্যক্তিই তা তিনি বা তারা যে দেশেরই মানুষ হন না কেন যেন ভ্যাকসিন বঞ্চিত না থাকেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। এক দেশ মুক্ত হলো- অন্যদেশ হলো না এমনটিও চলবে না করোনার ক্ষেত্রে। সামান্য ত্রুটি, সামান্য অবহেলা (আমেরিকার ক্ষেত্রে আমরা যা প্রত্যক্ষ করলাম) ভয়াবহ বৈশ্বিক বিপর্যয় দফায় দফায় ডেকে আনতে পারে। আমরা যেন ভুলে না যাই- বৈষম্য এ ধরনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য করোনামুক্ত বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে।
করোনা সারা বিশ্বে এক ভয়াবহ মহামারির সৃষ্টি করেছে। গোটা বিশ্বের মানুষ আজ গভীর সংকটে। কয়েক কোটি মানুষ সংক্রমিত বিগত একটি বছরে। নতুন বছরকে তবুও মানুষ স্বাগত জানিয়েছে গভীর প্রত্যাশায়। প্রত্যাশা করোনামুক্তির, প্রত্যাশা রোগমুক্ত নিরাপদ ও নিরুদ্বেগ জীবনের। নতুন বছরটির দ্বিতীয় মাস পড়লেও মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণের সামান্যতম লক্ষণও আজ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। এখনো মৃত্যুর হিমশীতল মিছিল দেশে দেশে চলছেই। মৃত্যুর ও আক্রান্তের সংখ্যাও দিনে দিনে বাড়ছেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করা বিশ্বের জন্য কঠিন হলেও আমাদের দেশের পরিস্থিতি অনেক ভালো। বিগত কয়েকদিনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। বিজ্ঞানীরা সারা বিশ্বে কাজ করে চলেছেন মানুষ বাঁচানোর লক্ষ্যে। তাদের অভিবাদন তারা করোনার প্রতিরোধক হিসেবে ভ্যাকসিন বহু গবেষণা, পরীক্ষ-নিরীক্ষা প্রভৃতি প্রাণীদেহে, মানবদেহে ঘটিয়ে নানা দেশে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে বিশ্বে মানুষ বাঁচানোর অভিযান চালাচ্ছেন। শতভাগ সাফল্যের নিশ্চয়তা তবুও আজও পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন এবং সেগুলোর কার্যকারিতাও ভিন্ন ভিন্ন বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। কোনো ব্র্যান্ডের ভ্যাকসিন কমবেশি শতকরা ৮০ ভাগ সাফল্য দাবি করেছে-কোনোটা আবার ৭০ ভাগের মতো। কোনোটা ৫০ ভাগের মতো বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোই শুধু নয়- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সেগুলোর অনুমোদন দিয়েছে।
অনুমোদন পাওয়ার পর কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য বাজারজাত করার জন্য ব্যাপকভাবে উৎপাদন শুরু করতে না করতেই বহুদেশ বিভিন্ন কোম্পানিকে অগ্রিম টাকা দিয়ে দ্রুত যাতে তাদের প্রয়োজনমতো পেয়ে যায় তা নিশ্চিত করেছে। অনেক দেশ ইতিমধ্যে হাজারে হাজারে নানাস্তরে মানুষের মধ্যে প্রয়োগও করতে শুরু করেছে। বাঁচার জন্য পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের এমন লড়াই একযোগে ঘটতে অতীতে কোনো দিন পৃথিবীর কোনো দেশেই দেখা যায়নি।
আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনগুলোর পরিবহণ সংরক্ষণও যথেষ্ট কঠিন। কোনো কোম্পানির ভ্যাকসিন-৭০ ডিগ্রির নিচে অত্যধিক ঠান্ডায় রেখে পরিবহণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ওই তাপমাত্রা মানবদেহে প্রয়োগের মুহূর্ত পর্যন্ত বজায় রাখতে হবে। পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশেও এমন সংরক্ষণ পরিবহণ ব্যবস্থা নেই, ছিলও না। ফলে তাদের তেমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হচ্ছে।
আবার ভ্যাকসিনের দামের ভিন্নতা দেশভেদে-কোম্পানিভেদে যথেষ্ট কম-বেশি। এটিও কম সংকট নয়। এতে সংশয়ের সৃষ্টিও হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সাধারণ ভাবনা হলো যে ভ্যাকসিনের দাম যত বেশি সে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাও তত বেশি। অনুরূপভাবে যে কোম্পানির ভ্যাকসিনের দাম যত কম সে ভ্যাকসিনের উপকারিতাও নাকি কম। এমন ধারণা হতেই পারে দামের ব্যাপক পার্থক্যের কারণে। এ ব্যাপারে একমাত্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই পারে মানুষকে সঠিক ধারণা দিয়ে সংশয় মুক্ত করতে।
দামের এই ভিন্নতা আবার অস্বাভাবিকও নয়। কারণ বিভিন্ন দেশে উৎপাদন ব্যয় বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে এবং উৎপাদন ব্যয়ই শেষবিচারে পণ্যের মূল্য নির্বাচনে সর্বোচ্চ বা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে থাকে। তদুপরি, নানা দেশে বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্যাকসিন পাঠাতে পরিবহণ খরচ, সংরক্ষণ খরচ প্রভৃতি বিভিন্ন রকমের। পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে আসা পর্যন্ত মূল্যের ব্যাপক তারতম্য ঘটার আশঙ্কা। আর এ আশঙ্কা সত্য হলে ভ্যাকসিনটি ধনীর দুলালরা ছাড়া সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন মানুষ ক্রয়শক্তির অভাবে বঞ্চিত হবেন কিনা সে শঙ্কাকে এই মুহূর্তে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতগুলো সংশয় ধারণ করার পর আরো একটি সংশয়ের সৃষ্টি হলো আরো একটি খবর দেখে। খবরটি হলো ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এ খবর সত্য হলে দ্রুত অনুসন্ধান করা দরকার ওই মৃত ব্যক্তিরা আগে থেকে করোনায় আক্রান্ত বা লক্ষণযুক্ত ছিলেন কিনা, তারা কোন ব্রান্ডের ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয়াদি। তবে একথা ঠিক, পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ওষুধের কার্যকারিতা কখনোই সমান হয় না। কিছু মৃত্যু ঘটতেই পারে। তবে দেখার বিষয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর মানুষ করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকছেন কিনা।
সংশয় আরো একটি। আমরা কলেরার টিকা, বসন্তের টিকা, শিশুদের ভিন্ন ধরনের টিকা আরো নানা রোগের নানাজাতীয় টিকা নিয়ে শতভাগ সাফল্য অর্জনের অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছি। আজ আর ওই রোগগুলোর অস্তিত্বও চোখে পড়ে না। কিন্তু কোনো কোনো ব্র্যান্ডের করোনা ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার মেয়াদ না কি দুই বছর মাত্র। এ তথ্য সঠিক হলে প্রশ্ন থেকেই যায় একটি মানুষ তার জীবদ্দশায় করোনামুক্ত থাকতে হলে তাকে কতবার ভ্যাকসিনটি নিতে হবে? অথবা আর্থিক সাধ্যশক্তি কমে এলে যখন ক্রয়ক্ষমতা শূন্যের কোটায় নেমে আসে তখন তারা, দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাকসিন ব্যবহার করে করোনামুক্ত থাকার পর আবার ব্যবহারের আর্থিক শক্তিহীনতার কারণেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়বেন।
তাই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে যাতে প্রতিটি দেশের সব নাগরিকই ভ্যাকসিন সুবিধা নিশ্চিতভাবে পেতে পারেন তা নিশ্চিত করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
করোনা যেহেতু মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে রোগ তাই করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগযোগ্য কোনো ব্যক্তিই তা তিনি বা তারা যে দেশেরই মানুষ হন না কেন যেন ভ্যাকসিন বঞ্চিত না থাকেন তার ব্যবস্থা করতে হবে। এক দেশ মুক্ত হলো- অন্যদেশ হলো না এমনটিও চলবে না করোনার ক্ষেত্রে। সামান্য ত্রুটি, সামান্য অবহেলা (আমেরিকার ক্ষেত্রে আমরা যা প্রত্যক্ষ করলাম) ভয়াবহ বৈশ্বিক বিপর্যয় দফায় দফায় ডেকে আনতে পারে। আমরা যেন ভুলে না যাই- বৈষম্য এ ধরনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য করোনামুক্ত বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে।
তাই একদিকে ভ্যাকসিন উৎপাদন কোম্পানিগুলোর উচিত হবে বিশ্বের সবার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা সৃষ্টির স্বার্থে মান অক্ষুণ্ণ রেখে ভ্যাকসিনের দাম যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা; অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের মানের বা কার্যকারিতার ক্ষেত্রে বিরাজমান বিভিন্নতা দূর করা এবং ভ্যাকসিনের পরিবহণ-সংরক্ষণ প্রভৃতির ক্ষেত্রে তাপমাত্রা এমন মাত্রায় নিয়ে আসা যাতে সাধারণের ব্যবহৃত ফ্রিজে তা সংরক্ষণ করলেও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হ্রাস না পায়।
সর্বাপেক্ষা বড় কথা হলো- মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন দেশের সব নাগরিকের জন্যই (যাদের ভ্যাকসিন দেওয়া মেডিকেল কারণে অনুচিত তাদের বাদ দিয়ে) বিনামূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা অতি অবশ্য করা প্রয়োজন। আবার যেহেতু রোগটি মারাত্মক রকমের ছোঁয়াচে তাই সবাইকে করোনামুক্ত করতে না পারলে সংক্রমণ পুনর্সংক্রমণ ঘটতেই থাকবে। এ বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। আমাদের প্রতিদিনের করোনাক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তির সংখ্যা হ্রাসের সুখবর শোনানো হচ্ছে। আমরাও খুশি হচ্ছি কিন্তু গভীরভাবে সংশয়াচ্ছন্নচিত্তে। প্রতিদিন পরীক্ষার সংখ্যা কমানো হচ্ছে ফলে মৃতের সংখ্যা তো স্বাভাবিকভাবেই কম আসবে। যেখানে আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটিরও অধিক সেখানে মাত্র আট লাখ মানুষের করোনা টেস্ট সম্পন্ন হওয়ার খবর যে কোনো বিচারেই অগ্রহণযোগ্য ও হতাশা ব্যঞ্জক। টেস্ট যেন সরকারের বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় অবাঞ্ছিত তাই কিছুদিন বিনা পয়সায় টেস্ট করার পর তার ওপর মূল্য ধার্য করা হলো। ফলে টেস্টের সংখ্যা কমে গেল। দিন দিন প্রচারের কল্যাণে আরও কমছে। ফলে টেস্ট না করার কারণে জানাও যাচ্ছে না বাংলাদেশে কতজন প্রতিদিন প্রকৃত প্রস্তাবে করোনা সংক্রামিত হচ্ছেন কতজন মারা যাচ্ছেন। পৃথিবীর সব দেশে করোনা টেস্ট বিনা পয়সায় করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অনুরূপভাবে ভ্যাকসিনও বেশির ভাগ দেশে বিনামূল্যে নাগরিকদের দিচ্ছে। তাদের তুলনায় আমরা আদৌ ধনী রাষ্ট্র নই বরং বহুলাংশ গরিব। তবে আমাদের দেশেও বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। তদুপরি, অন্যান্য দেশে যেভাবে কঠোরভাবে মানুষজনকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করেছে, আমাদের দেশে কার্যত তা করা হয়নি। ফলে ছোঁয়াচে এই রোগটির ব্যাপক সংক্রমণ ঘটাই স্বাভাবিক। সেদিন ভারতে গেল কুম্ভস্নান। স্বাস্থ্য বিধি মানানো হলো স্নানার্থী-পুণ্যার্থীদের। আমরা গণপরিবহণেও স্বাভাবিকভাবে মানুষ চলাচল করতে দিচ্ছি। এসব বিবেচনায় নিতে হবে উপেক্ষণীয় নয় আদৌ।
লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত