০১:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশ

ঐতিহাসিক কালব্যাপী সর্বত্রই দেখা যায়- মানুষের জীবনের সঙ্গে তার ভাষার কিংবা নিজের ভাষার সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ভাষা ছাড়া জীবনযাপন চলে না। মানুষের আত্মবিকাশের এক পর্যায়ে তার জীবনের বিমূর্ত অঙ্গরূপে দেখা দিয়েছে ভাষা। সৃষ্টির ধারায় জীবন আগে, না ভাষা আগে- এ প্রশ্নে অবশ্যই জীবনকে আগে পাওয়া যায়।
বাস্তবে দেখা যায়, জীবন যেখানে উন্নত, ভাষাও সেখানে উন্নত এবং ভাষা যেখানে উন্নত, জীবনও সেখানে উন্নত। ভাষার উন্নতি সাধিত হয় ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য সৃষ্টির এবং জাতীয় উন্নতির মধ্য দিয়ে। নিজের ভাষাকে উন্নত না করে কোনো ব্যক্তি কিংবা জাতি উন্নতি করতে পারে না। যে ব্যক্তি ভাষায় নিপুণ, সমাজে তার সাফল্য ও মর্যাদা বেশি।
আরও দেখা যায়, ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য। সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা ইত্যাদি সৃষ্টির পেছনেও কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। চিন্তা আগে না ভাষা আগে- এ নিয়ে বিতর্ক আছে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে। আমার ধারণা, এ বিতর্ক অমীমাংসায়; কারণ চিন্তা ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য, একটিকে আগে অন্যটিকে পরে বলার উপায় নেই। মানুষের সব কর্মকান্ডেরই মর্মে কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। কাজের বেলায় শ্রমশক্তি পরিচালিত হয় চিন্তাশক্তি দ্বারা। চিন্তা ও ভাষা অভিন্ন, অবিভাজ্য।
জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে ভাষার উন্নতি কিংবা ভাষার উন্নতির সঙ্গে জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। কোনো জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি আর ভাষার উন্নতিও অবিচ্ছেদ্য। ভাষাকে উন্নত না করে আত্মনির্ভর স্বাধীন আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতি সম্ভব হয় না। মানুষের জীবন ও পরিবেশ বিকাশশীল, ভাষাও বিকাশশীল। উন্নত জাতিগুলো তাদের ভাষার উন্নতির জন্য পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কাজ করে। সাম্রাজ্যবাদীরা তৎপর থাকে নিজেদের ভাষার উন্নতি সাধনে এবং দুর্বল জাতিগুলোকে ভাষার দিক দিয়েও নির্ভরশীল রাখতে।
ভাষা ও মানুষের জীবন এবং মানুষের জীবন ও ভাষা নিয়ে যতই চিন্তা করা যায়, তথ্য সন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়, ততই দুয়ের অবিচ্ছেদ্যতা ও উন্নতি সম্পর্কে ধারণা গভীর থেকে গভীরতর হয়। বলা যায়, ভাষাকে নতুনভাবে জানা এবং ভাষায় আমরা যতটা গুরুত্ব দিই তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
মানুষ ভাষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, জন্মের পর ভাষা আয়ত্ত করে। ভাষা আয়ত্ত এবং ভাষাকে বিকশিত করার সামর্থ্য মানুষের আছে। ইতিহাসব্যাপী মানুষকে এক অবস্থায় দেখা যায় না। মানুষ হয়ে ওঠা প্রাণী। এই হয়ে ওঠা বা উন্নতির প্রক্রিয়া চলমান। পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার, সেই সঙ্গে সমাজের অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্য দিয়ে মানুষ বর্তমান অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে। মানুষের এই হয়ে ওঠা বা উন্নতির মূলে আছে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি। চিন্তাই ভাষা, ভাষাই চিন্তা। চিন্তা ছাড়া ভাষা হয় না, ভাষা ছাড়া চিন্তা হয় না।
আদিতে মানুষের ভাষা ছিল না। আদিম মানুষরা যৌথ জীবনযাত্রা ও প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের জৈবিক সামর্থ্যরে বলে নিজেদের ভাষা সৃষ্টি করেছে এবং প্রয়োজনের তাগিদেই তারা তাদের ভাষাকে বিকশিত ও উন্নত করে চলছে। কেবল বাকযন্ত্রের ক্রিয়া দিয়ে ভাষার মর্ম বোঝা যায় না। ভাষার সঙ্গে মানুষের গোটা অস্তিত্ব ও পরিবেশ জড়িত থাকে। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই ভাষা সৃষ্টি করার মতো জৈবিক সামর্থ্য নেই। মানুষের মতো ক্রমাগত নিজেকে এবং নিজের পরিবেশকে উন্নত করার সামর্থ্যও আর কোনো প্রাণীর নেই।
দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় এমন মাত্র দুইশ ভাষা দুনিয়ায় আছে। এসব ভাষা বিকাশমান। এগুলোর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলা ভাষার স্থান এখনো ওপরের দিকেই আছে। এগুলো ছাড়া বিভিন্ন মহাদেশে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আছে; তাদেরও আলাদা ভাষা আছে; তাদের ভাষা বিলীয়মান। বাংলাদেশে পঁয়তাল্লিশটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পঁয়তাল্লিশটি বিলীয়মান মাতৃভাষা আছে। এই পঁয়তাল্লিশটি জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। এরা জন্মের পর থেকেই নিজেদের ভাষার মতো বাংলা ভাষাও শেখে। এদের বলা যায় দ্বিভাষিক।
বাংলা ভাষাকেই তারা তাদের উন্নতির অবলম্বন মনে করে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের ও বাংলাদেশেরও বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা বাস্তবসম্মত নয়। এ ক্ষেত্রে ইউনেস্কোর প্রচার ও কাজ বাস্তবতাবিরোধী। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর লোকরা জীবনযাত্রার ও উন্নতির প্রয়োজনে নিজেদের ভাষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রভাষা শিখছে। এর মধ্যেই রয়েছে তাদের উন্নতির সম্ভাবনা। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির ও মানবজাতির মূল ধারায় আসার সুযোগ সর্বত্র বাড়াতে হবে। তাদের চিরকাল আদিবাসী করে রাখার সাম্রাজ্যবাদী নীতি বর্জনীয়।
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ও উদ্দেশ্য থেকে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এর দ্বারা রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে এবং রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও নষ্ট হচ্ছে। বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোর উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার উন্নতিকে স্থগিত রাখা ঠিক হবে না। নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টিতে আমাদের এগোতে হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারা ধরে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, এনজিও ও ইউনেস্কো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির জন্য যে পথ প্রদর্শন করে, যেসব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম চালায়, অনেক সময় সেগুলো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির অন্তরায় হয়। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর নিজেদের উন্নতির জন্য পার্শ্ববর্তী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে রাষ্ট্র গঠন করতে হয় এবং রাষ্ট্রভাষা শিখতে হয়। তারা যদি বাইরে থেকে কিছুই গ্রহণ না করে এবং কেবল নিজেদের বিলীয়মান মাতৃভাষা ও নিজেদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রা নিয়ে চলে, তা হলে তারা কোনোদিনই উন্নতি করতে পারবে না। নিজেদের উন্নতির প্রয়োজনে রাষ্ট্রভাষাকে নিজেদের মাতৃভাষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তাদের জীবনব্যাপী আয়ত্ত করা ও বিকশিত করে চলা সমীচীন।
কোনো ভাষার অর্থনৈতিক ভিত্তি বিকাশশীল থাকলে সে ভাষা বিকাশশীল থাকে। কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই তার বিলীয়মান মাতৃভাষা নিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারে না।
সাম্রাজ্যবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশে বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার প্রচার চালিয়ে বাংলা ভাষার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক ভিত্তিকে দুর্বল রাখার চেষ্টা করছে।
আমাদের উপলব্ধি করা দরকার যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ও উন্নতি অপরিহার্য। চলমান বহু ঘটনা আছে যেগুলো দেখে বলা যায়, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা না টিকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টিকবে না। দেশ থাকবে, মাটি-মানুষ-গাছপালা-পশু-পাখি, নদীনালা ও আকাশ-বাতাস থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্র থাকবে না। যারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার বদলে ইংরেজি চান, তারা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন?
দেশ এবং রাষ্ট্র এক নয়। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি, রাষ্ট্র মানুষের। আমাদের রাষ্ট্র না থাকলেও কেবল দেশ থাকলে আমরা কি ভালো থাকব?
১৯৭১ সালে কেন আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিলাম? রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে, ছয় দফা আন্দোলনে ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে কেন আমরা ফেটে পড়েছিলাম? কেন আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম; বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার লক্ষ্য বাদ দিয়ে চললে এসব আন্দোলন ও সংগ্রাম অর্থহীন হয়ে যায়।
ভৌগোলিক বাস্তবতা ও বাঙালি-চরিত্র লক্ষ করে ১৯৭৩ সাল থেকেই কোনো কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি বলে আসছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মতো (ঠরধনষব) নয়। তারা জোর দিয়েছেন বাঙালি চরিত্রের নিকৃষ্টতায়। তাদের যুক্তি ও মত কখনো আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তারা অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্ব নিয়েছেন এবং প্রায় সবাই তাদের সন্তানদের ওইসব রাষ্ট্রের নাগরিক করেছেন। আমি সব সময় বাঙালি-চরিত্রের উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেছি। আমি সব সময় মনে করেছি এবং এখনো মনে করি, বাংলাদেশকে অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলা যাবে।
জাতীয় হীনতাবোধ বাংলাদেশের ধনী-গরিব, শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাবঞ্চিত সব মানুষকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জনসাধারণ ঘুমন্ত। জাতীয় হীনতাবোধ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। চিন্তায়-কাজে আমাদের অবলম্বন করতে হবে বাংলা ভাষা। বাইরের জগৎ থেকে ভালো জিনিস গ্রহণ করে আমরা আমাদের বাঙালিত্ব ও বাংলা ভাষাকে উন্নত করে চলব।
বাংলাদেশে একদিকে আছে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ কাউন্সিল ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত ও-লেভেল, এ-লেভেল এবং অপরদিকে আছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নবপ্রবর্তিত ইংলিশ ভার্সন। এসবই বাংলাদেশের ভূভাগে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বাংলাদেশে চলমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রতিকূল। পরিবর্তন দরকার।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় চলে যাচ্ছে। সময় থাকতে চিন্তা ও কাজ করতে হয়, সময় চলে গেলে সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। আজকের মূল প্রশ্ন- বাংলাদেশকে আমরা রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলব কী তুলব না। যদি সিদ্ধান্ত হয় গড়ে তুলব, তা হলে সময় নষ্ট না করে কাজ আরম্ভ করতে হবে। রাষ্ট্র গঠনের জন্য চেষ্টা লাগবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্র গড়ে উঠবে না। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের মহান লক্ষ্য দরকার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে উদযাপন করতে হবে রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে। রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নবচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। ১৯৭২ সালে বিলুপ্ত করা বাংলা উন্নয়ন বোর্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লেখক : আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

চট্টগ্রামে সংঘর্ষের ঘটনায় বহিস্কৃত যুবদলের দুই নেতা, নিহত জুবায়ের যুবলীগের কর্মী

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত : ১২:০০:৩৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১

ঐতিহাসিক কালব্যাপী সর্বত্রই দেখা যায়- মানুষের জীবনের সঙ্গে তার ভাষার কিংবা নিজের ভাষার সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ভাষা ছাড়া জীবনযাপন চলে না। মানুষের আত্মবিকাশের এক পর্যায়ে তার জীবনের বিমূর্ত অঙ্গরূপে দেখা দিয়েছে ভাষা। সৃষ্টির ধারায় জীবন আগে, না ভাষা আগে- এ প্রশ্নে অবশ্যই জীবনকে আগে পাওয়া যায়।
বাস্তবে দেখা যায়, জীবন যেখানে উন্নত, ভাষাও সেখানে উন্নত এবং ভাষা যেখানে উন্নত, জীবনও সেখানে উন্নত। ভাষার উন্নতি সাধিত হয় ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য সৃষ্টির এবং জাতীয় উন্নতির মধ্য দিয়ে। নিজের ভাষাকে উন্নত না করে কোনো ব্যক্তি কিংবা জাতি উন্নতি করতে পারে না। যে ব্যক্তি ভাষায় নিপুণ, সমাজে তার সাফল্য ও মর্যাদা বেশি।
আরও দেখা যায়, ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য। সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা ইত্যাদি সৃষ্টির পেছনেও কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। চিন্তা আগে না ভাষা আগে- এ নিয়ে বিতর্ক আছে ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে। আমার ধারণা, এ বিতর্ক অমীমাংসায়; কারণ চিন্তা ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য, একটিকে আগে অন্যটিকে পরে বলার উপায় নেই। মানুষের সব কর্মকান্ডেরই মর্মে কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। কাজের বেলায় শ্রমশক্তি পরিচালিত হয় চিন্তাশক্তি দ্বারা। চিন্তা ও ভাষা অভিন্ন, অবিভাজ্য।
জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে ভাষার উন্নতি কিংবা ভাষার উন্নতির সঙ্গে জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। কোনো জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি আর ভাষার উন্নতিও অবিচ্ছেদ্য। ভাষাকে উন্নত না করে আত্মনির্ভর স্বাধীন আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতি সম্ভব হয় না। মানুষের জীবন ও পরিবেশ বিকাশশীল, ভাষাও বিকাশশীল। উন্নত জাতিগুলো তাদের ভাষার উন্নতির জন্য পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কাজ করে। সাম্রাজ্যবাদীরা তৎপর থাকে নিজেদের ভাষার উন্নতি সাধনে এবং দুর্বল জাতিগুলোকে ভাষার দিক দিয়েও নির্ভরশীল রাখতে।
ভাষা ও মানুষের জীবন এবং মানুষের জীবন ও ভাষা নিয়ে যতই চিন্তা করা যায়, তথ্য সন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়, ততই দুয়ের অবিচ্ছেদ্যতা ও উন্নতি সম্পর্কে ধারণা গভীর থেকে গভীরতর হয়। বলা যায়, ভাষাকে নতুনভাবে জানা এবং ভাষায় আমরা যতটা গুরুত্ব দিই তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
মানুষ ভাষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, জন্মের পর ভাষা আয়ত্ত করে। ভাষা আয়ত্ত এবং ভাষাকে বিকশিত করার সামর্থ্য মানুষের আছে। ইতিহাসব্যাপী মানুষকে এক অবস্থায় দেখা যায় না। মানুষ হয়ে ওঠা প্রাণী। এই হয়ে ওঠা বা উন্নতির প্রক্রিয়া চলমান। পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার, সেই সঙ্গে সমাজের অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্য দিয়ে মানুষ বর্তমান অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে। মানুষের এই হয়ে ওঠা বা উন্নতির মূলে আছে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি। চিন্তাই ভাষা, ভাষাই চিন্তা। চিন্তা ছাড়া ভাষা হয় না, ভাষা ছাড়া চিন্তা হয় না।
আদিতে মানুষের ভাষা ছিল না। আদিম মানুষরা যৌথ জীবনযাত্রা ও প্রকৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের জৈবিক সামর্থ্যরে বলে নিজেদের ভাষা সৃষ্টি করেছে এবং প্রয়োজনের তাগিদেই তারা তাদের ভাষাকে বিকশিত ও উন্নত করে চলছে। কেবল বাকযন্ত্রের ক্রিয়া দিয়ে ভাষার মর্ম বোঝা যায় না। ভাষার সঙ্গে মানুষের গোটা অস্তিত্ব ও পরিবেশ জড়িত থাকে। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই ভাষা সৃষ্টি করার মতো জৈবিক সামর্থ্য নেই। মানুষের মতো ক্রমাগত নিজেকে এবং নিজের পরিবেশকে উন্নত করার সামর্থ্যও আর কোনো প্রাণীর নেই।
দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় এমন মাত্র দুইশ ভাষা দুনিয়ায় আছে। এসব ভাষা বিকাশমান। এগুলোর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলা ভাষার স্থান এখনো ওপরের দিকেই আছে। এগুলো ছাড়া বিভিন্ন মহাদেশে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আছে; তাদেরও আলাদা ভাষা আছে; তাদের ভাষা বিলীয়মান। বাংলাদেশে পঁয়তাল্লিশটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পঁয়তাল্লিশটি বিলীয়মান মাতৃভাষা আছে। এই পঁয়তাল্লিশটি জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশের সামান্য বেশি। এরা জন্মের পর থেকেই নিজেদের ভাষার মতো বাংলা ভাষাও শেখে। এদের বলা যায় দ্বিভাষিক।
বাংলা ভাষাকেই তারা তাদের উন্নতির অবলম্বন মনে করে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের ও বাংলাদেশেরও বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা বাস্তবসম্মত নয়। এ ক্ষেত্রে ইউনেস্কোর প্রচার ও কাজ বাস্তবতাবিরোধী। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর লোকরা জীবনযাত্রার ও উন্নতির প্রয়োজনে নিজেদের ভাষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রভাষা শিখছে। এর মধ্যেই রয়েছে তাদের উন্নতির সম্ভাবনা। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির ও মানবজাতির মূল ধারায় আসার সুযোগ সর্বত্র বাড়াতে হবে। তাদের চিরকাল আদিবাসী করে রাখার সাম্রাজ্যবাদী নীতি বর্জনীয়।
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ও উদ্দেশ্য থেকে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এর দ্বারা রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে এবং রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও নষ্ট হচ্ছে। বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোর উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার উন্নতিকে স্থগিত রাখা ঠিক হবে না। নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টিতে আমাদের এগোতে হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারা ধরে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, এনজিও ও ইউনেস্কো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির জন্য যে পথ প্রদর্শন করে, যেসব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম চালায়, অনেক সময় সেগুলো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর উন্নতির অন্তরায় হয়। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর নিজেদের উন্নতির জন্য পার্শ্ববর্তী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে রাষ্ট্র গঠন করতে হয় এবং রাষ্ট্রভাষা শিখতে হয়। তারা যদি বাইরে থেকে কিছুই গ্রহণ না করে এবং কেবল নিজেদের বিলীয়মান মাতৃভাষা ও নিজেদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রা নিয়ে চলে, তা হলে তারা কোনোদিনই উন্নতি করতে পারবে না। নিজেদের উন্নতির প্রয়োজনে রাষ্ট্রভাষাকে নিজেদের মাতৃভাষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তাদের জীবনব্যাপী আয়ত্ত করা ও বিকশিত করে চলা সমীচীন।
কোনো ভাষার অর্থনৈতিক ভিত্তি বিকাশশীল থাকলে সে ভাষা বিকাশশীল থাকে। কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই তার বিলীয়মান মাতৃভাষা নিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারে না।
সাম্রাজ্যবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশে বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার প্রচার চালিয়ে বাংলা ভাষার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক ভিত্তিকে দুর্বল রাখার চেষ্টা করছে।
আমাদের উপলব্ধি করা দরকার যে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ও উন্নতি অপরিহার্য। চলমান বহু ঘটনা আছে যেগুলো দেখে বলা যায়, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা না টিকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টিকবে না। দেশ থাকবে, মাটি-মানুষ-গাছপালা-পশু-পাখি, নদীনালা ও আকাশ-বাতাস থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্র থাকবে না। যারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার বদলে ইংরেজি চান, তারা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন?
দেশ এবং রাষ্ট্র এক নয়। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি, রাষ্ট্র মানুষের। আমাদের রাষ্ট্র না থাকলেও কেবল দেশ থাকলে আমরা কি ভালো থাকব?
১৯৭১ সালে কেন আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিলাম? রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে, ছয় দফা আন্দোলনে ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে কেন আমরা ফেটে পড়েছিলাম? কেন আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম; বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার লক্ষ্য বাদ দিয়ে চললে এসব আন্দোলন ও সংগ্রাম অর্থহীন হয়ে যায়।
ভৌগোলিক বাস্তবতা ও বাঙালি-চরিত্র লক্ষ করে ১৯৭৩ সাল থেকেই কোনো কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি বলে আসছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মতো (ঠরধনষব) নয়। তারা জোর দিয়েছেন বাঙালি চরিত্রের নিকৃষ্টতায়। তাদের যুক্তি ও মত কখনো আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তারা অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্ব নিয়েছেন এবং প্রায় সবাই তাদের সন্তানদের ওইসব রাষ্ট্রের নাগরিক করেছেন। আমি সব সময় বাঙালি-চরিত্রের উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেছি। আমি সব সময় মনে করেছি এবং এখনো মনে করি, বাংলাদেশকে অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলা যাবে।
জাতীয় হীনতাবোধ বাংলাদেশের ধনী-গরিব, শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাবঞ্চিত সব মানুষকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জনসাধারণ ঘুমন্ত। জাতীয় হীনতাবোধ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। চিন্তায়-কাজে আমাদের অবলম্বন করতে হবে বাংলা ভাষা। বাইরের জগৎ থেকে ভালো জিনিস গ্রহণ করে আমরা আমাদের বাঙালিত্ব ও বাংলা ভাষাকে উন্নত করে চলব।
বাংলাদেশে একদিকে আছে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ কাউন্সিল ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত ও-লেভেল, এ-লেভেল এবং অপরদিকে আছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নবপ্রবর্তিত ইংলিশ ভার্সন। এসবই বাংলাদেশের ভূভাগে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বাংলাদেশে চলমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রতিকূল। পরিবর্তন দরকার।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় চলে যাচ্ছে। সময় থাকতে চিন্তা ও কাজ করতে হয়, সময় চলে গেলে সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। আজকের মূল প্রশ্ন- বাংলাদেশকে আমরা রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলব কী তুলব না। যদি সিদ্ধান্ত হয় গড়ে তুলব, তা হলে সময় নষ্ট না করে কাজ আরম্ভ করতে হবে। রাষ্ট্র গঠনের জন্য চেষ্টা লাগবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্র গড়ে উঠবে না। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে নিজেদের রাষ্ট্র গঠনের মহান লক্ষ্য দরকার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে উদযাপন করতে হবে রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে। রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নবচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। ১৯৭২ সালে বিলুপ্ত করা বাংলা উন্নয়ন বোর্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লেখক : আবুল কাসেম ফজলুল হক, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়