কেউ রং করছে, কেউ বিক্রি করছে, অনেকে ঘুরে ঘুরে দেখছেন। পাশেই মুখোশের কাজ করছেন কয়েকজন, বাজছে গান। কিছু তরুণ-তরুণী বাদ্যযন্ত্র হাতে নিজেরাই গান গেয়ে চলেছেন। এ রকম আবহে মধ্য দুপুরের রোদ উঁকি দিলেও তেজ দেখাতে পারছে না চারপাশের আকাশচুম্বী বিচিত্র গাছগুলোর জন্য। গাছের ছায়াতলে বাঁশের তৈরি কঙ্কালসার জেলে-জাল, বক-মাছ, মহিষ, সাইকেল, শিশু, হাতি, পায়রা হাতে এক নারী, সূর্য প্রভৃতি দাঁড়িয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের দিনের চিত্র এটি।
কঙ্কালসার এই দেহগুলোর শরীরে ‘মাংস’ দিতে দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাদের পরিশ্রমে যেদিন প্রাণবন্ত হয়ে রাস্তায় চলতে শুরু করবে কঙ্কালসার দেহগুলো, সেই দিনটিই হবে ১৪২৫ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন বা পহেলা বৈশাখ। শোভাযাত্রার এবারের প্রতিপাদ্য ধরা হয়েছে, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’।
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর তালিকায় স্থান করে নেয় ২০১৬ সালে। একেবারে নিজেদের অর্থায়নে এত বড় মঙ্গল শোভাযাত্রার দীর্ঘ প্রেক্ষাপটেই এই সম্মান জোটে। সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে যেন নেই কোনো কার্পণ্য। তাই দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এসব শিল্পকর্ম বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, সেই টাকা দিয়েই হবে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। সঙ্গে থাকবে বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিভাগের বর্তমান, সাবেক শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা।
মঙ্গল শোভাযাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মাস্কটগুলো। আর এই মাস্কট তৈরিতেই খরচ হয় সবচেয়ে বেশি। এবারের মাস্কটে সামনে থাকবে ২৬ ফুট লম্বা একটি টেপা পুতুল। এই নারী পুতুলটি পায়রা উড়িয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে শোভাযাত্রায় স্থান পাবে পাখি, পাখির ছানা, হাতি, মহিষ, জেলে, মাছ-বক, সাইকেল, সূর্য। আত্মিক সম্পর্কে দৃশ্যমান করতে মা আর শিশু পাখি, জেলের সাথে জালের সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা থাকবে এবারের শোভাযাত্রায়।
এ ছাড়া বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে মহিষ ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত থাকলেও এতদিনে সেটা মঙ্গল শোভাযাত্রায় স্থান পায়নি। তাই এবার মহিষ থাকছে এই শোভাযাত্রায়।
বাঁশের কাজগুলো করছেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বাইরের কয়েকজন লোক। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন হলেও অনেকে দীর্ঘদিন ধরেই এই কাজ করেন। এদের মধ্যে জাহিদ বৈশাখে বাঁশের কাজ করছেন ১৬ থেকে ১৭ বছর ধরে। তিনি বলেন, ‘বৈশাখে কাজ করতে ভালো লাগে। বাঁশের সব ধরনের কাজ করি। এই যে, চটি বানাইতেছি। লোক-মিস্ত্রিগো দেখাইতেছি, তারা বানাইতাছে।’
সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করছেন। তবে প্রয়োজনের তাগিদে অনেককেই কাজ করতে হচ্ছে মধ্যরাত পর্যন্ত। শিফট অনুযায়ী চারুকলা বিভাগের প্রতিটি শিক্ষার্থীই কাজ করছেন এই আয়োজনে। যেসব শিক্ষার্থী এখান থেকে পাস করে চলে গেছেন, তারাও এসে এই কাজে যোগ দিচ্ছেন।
শিক্ষকরা নির্দেশনা দিলেও একটি ব্যাচকে দায়িত্ব নিতে হয় পুরো আয়োজন শেষ করার জন্য। এবারের দায়িত্ব পড়েছে ২০তম ব্যাচের ওপর। সেই ব্যাচের শিক্ষার্থী ফাহমিদা আক্তার সুমনা স্টলের দায়িত্বে পালন করছিলেন।
সুমনা জানান, এখনো পুরোদমে বিক্রি শুরু হয়নি। তবে এসব জিনিস কেনার জন্য অর্ডার আসতে শুরু করেছে। শেষের দিকে এটা বেড়ে যায়। এখন শুধু আমরা জিনিসগুলো তৈরি করে রাখছি, যেন অর্ডার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারি। অনেকে ঘর সাজানো, অফিস সাজানো, উপহার দেওয়া, বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা নিজেদের দোকানের জন্য এসব জিনিস নিয়ে থাকে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন অর্নিয়া হক। প্রতিষ্ঠানের কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসেন তিনি। পরে পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি দেখতে তিনি চারুকলা অনুষদ ঘুরে দেখেন। ঘুরতে ঘুরতে একটি মুখোশ পছন্দ হয় এবং তা ৫০০ টাকা দিয়ে কিনে নেন। বাসার দেয়ালে এই মুখোশটি লাগাবেন অর্নিয়া।
সুমনা জানান, বড় সরা ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা, ছোট সরা ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, কিছু পাখি ১০০ টাকা, বড় ডানার পাখি ১৫০ টাকা, মাছ ১৫০ টাকা, কাগজের তৈরি ঘণ্টা লাগানো ফুল ১৫০ টাকা, ঘণ্টা ছাড়া ১০০, প্রদীপ ১০০ থেকে ১৫০০ টাকা, রাজা-রানি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, কচ্ছপ ২০০ টাকা।
সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ছাড়াও বিভিন্ন দামে পাওয়া যাবে জল রঙের কাজ। জল রঙের কাজগুলোও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। চারুকলা বিভাগের যেসব শিক্ষকের কাজ অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়, সেসব শিক্ষকের কাজও অনেক অল্প দামে বিক্রি হচ্ছে এখানে। উদ্দেশ্য একটাই, কেউ যেন এসে ফিরে না যায়। আর যারা এসব পণ্য কিনছেন, তাদের ক্রেতা হিসেবে দেখছেন না, দেখছেন মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের সহযোগী হিসেবে।
পহেলা বৈশাখের আয়োজন বিষয়ে কথা বলতে চাইলে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসাইন জানান, সাক্ষাৎকার দিতে দিতে তার টেলিফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাই তিনি কথা বলতে পারবেন না। আর এই আয়োজনে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন অঙ্কন ও চিত্রায়ন বিভাগের অধ্যাপক শিশির কুমার ভট্টাচার্য্য। তিনি জানান, এসব বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেন না।
কথা হয় আয়োজক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আফি আজাদ বান্টির সঙ্গে। তিনি জানান, শোভাযাত্রার আয়োজনের কাজ করতে তাদের কোনোরকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থী, এমনকি পাস করে যাওয়া বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তারা এই আয়োজন করে থাকেন।
‘আমরা যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়ে এই আয়োজন করতাম, তাহলে ইউনেস্কো আমাদের এই স্বীকৃতি দিত না’, বলেন বান্টি।
বান্টি বলেন, ‘১৯৮৯ সাল থেকে আমরা এই চেতনা লালন-পালন করে আসছি। প্রথম বছর শিক্ষার্থীরা নিজেরা টাকা দিয়েছে। কাজ শেষে শিক্ষকের বাসায় খাবার খেয়েছে। এভাবে কাজ করেছে, কিন্তু কোনো সাহায্য নেয়নি। আমরা এখনো এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছি, কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এখনো সাহায্য নিই না।’
প্রতিটি মানুষ, প্রতিষ্ঠান চাইলেই যে অনেক কিছু করতে পারে, কারো কোনোরকম সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া, এটা যেন তারই বহিঃপ্রকাশ।