- উন্মুক্ত নালা-নর্দমায় জন্মাচ্ছে প্রচুর মশা
- ফগিং কার্যক্রম অকার্যকর এলাকাবাসীর অভিযোগ
- কয়েল ও স্প্রে ব্যবহারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
- পুরান ঢাকা ডেঙ্গুর হটস্পট
সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গুর ভয় সর্বজনীন নগর আতঙ্ক হয়ে সামনে এসেছে। প্রায় প্রতিটি মহল্লায় নগরবাসীর জন্য এখন মশাবাহিত রোগ বড় ধরনের ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় ডেঙ্গু সংক্রমণকে আরও তীব্র করছে কামরাঙ্গীরচরের ‘জনঘনত্ব’ ও ‘অপরিচ্ছন্নতা’। রাজধানী ঢাকার পশ্চিম প্রান্তে কামরাঙ্গীরচর এখন যেন ‘মশার রাজ্য’। সিটি কর্পোরেশনের ফগিং কার্যক্রম অনিয়মিত, আবার যেটুকু হয় তা শুধু চোখে ধোঁয়া দেওয়ার মতো। ড্রেন পরিষ্কারের কাজও হয় খণ্ডকালীন। ফলে যে মশা মরার কথা, সেই মশাই নতুন করে জন্ম নিচ্ছে। কামরাঙ্গীরচরের জনঘনত্ব এত বেশি যে একবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী এলাকায় এলে মশার মাধ্যমে সংক্রমণ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘জলাবদ্ধতার সঙ্গে কিউলেক্স মশার বিস্তারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। জলাবদ্ধ স্থানগুলোতেই এ মশার জন্ম হয়। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় জরুরি।তাই একে-অপরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করলেই কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।’পারস্পরিক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না হলে কিউলেক্স মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
’প্রায় পাঁচ বর্গমাইল আয়তনের এ এলাকায় ১৬ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। দিনরাত রক্তপিপাসু মশার কামড়ে অতিষ্ঠ এখানকার বাসিন্দারা। শুধু রাত নয়, দিনের বেলাতেও মশার আক্রমণ থেকে রেহাই নেই কারও। চলন্ত যানবাহনেও মশা তাড়া করে যাত্রীদের।এলাকার বিভিন্ন স্থানে ময়লার ভাগাড়, নোংরা নালা ও অপরিষ্কার পরিবেশে মশার বংশবিস্তার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। মাত্র ১৫ দিনের আয়ু নিয়ে জন্ম নেওয়া এসব মশা এখন এ.সি. রুম থেকে সাধারণ ঘর, সব জায়গায় প্রবেশ করছে নির্বিঘ্নে। সন্ধ্যা না হতেই কানের পাশে গুঞ্জন তুলে মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলছে।
চকবাজার থানাধীন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের বিপরীতে অবস্থিত মশক নিবারণী অধিদপ্তরের অধীনে প্রায় ২০০ কর্মী থাকলেও তাদের কার্যক্রম দৃশ্যমান নয় বলে অভিযোগ। মাঝে মাঝে ফগার মেশিনে ধোঁয়া ছাড়লেও তাতে তেমন ফল পাওয়া যায় না। এলাকাবাসীর ভাষায়, “স্প্রে ম্যানরা মশা মারতে নয়, মশাকে চুলকাতে আসে।আলীনগর এলাকার বাসিন্দা বোরকা ব্যবসায়ী হাজী তারেক আহমেদ, প্লাস্টিক ব্যবসায়ী সেলিম, গৃহবধূ ইয়াসমিন জানান, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কয়েল জ্বালিয়েও মশার কামড় থেকে নিস্তার মিলছে না। কয়েলের ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তবুও বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হচ্ছে।
সেলিম-ইয়াসমিন দম্পতির সন্তান হাফেজ ইয়ামিন সম্প্রতি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মুমূর্ষ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় মৃত্যুুপ্রাণের লড়াই শেষে সে বর্তমানে সুস্থ হয়ে উঠছে।কামরাঙ্গীরচরের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি। মাদবরবাজার এলাকার পোশাক নির্মাতা দিদার হোসেন বলেন, সন্ধ্যায় বুড়িগঙ্গার তীরে হাওয়া খেতে গেলেও মশার কামড়ে বসে থাকা দায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, মশা নিধনে মশক নিবারণী অধিদপ্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কার্যত নীরব ভূমিকা পালন করছে। দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ফগিং বা লার্ভিসাইড স্প্রে করা হচ্ছে না। ফলে কামরাঙ্গীরচরবাসী এখন প্রাকৃতিক ঝড়-বৃষ্টির ওপরই ভরসা রাখছে মশার উপদ্রব থেকে মুক্তির আশায়।
জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করুন, দেরিতে হাসপাতালে এলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি: দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের মৃত্যুহার বাড়ছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, আজ একদিনেই ডেঙ্গুতে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দিনই প্রাণ হারান।চিকিৎসকরা বলছেন, সময়মতো পরীক্ষা ও চিকিৎসা শুরু না করলে ডেঙ্গু দ্রুত জটিল আকার নেয়, ফলে রোগীকে বাঁচানোর সুযোগ কমে যায়। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় এসব তথ্য জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. মঈনুল আহসান।
তিনি জানান, বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ হচ্ছে হাসপাতালে আসতে দেরি করা। ‘আজ যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে সাতজন ভর্তি হওয়ার দিনই মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন পরদিন মারা গেছেন। এটা স্পষ্ট যে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন অনেক দেরিতে,’ বলেন তিনি।
ডা. মঈনুল আহসান বলেন, ডেঙ্গু জ্বরকে সাধারণ জ্বর ভেবে অবহেলা না করে, জ্বর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাছের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো জরুরি। পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশের সব হাসপাতালেই বর্তমানে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট, স্যালাইন ও ওষুধ মজুত রয়েছে। তবে মৃত্যুহার কমাতে শুধু চিকিৎসা নয়, একইসঙ্গে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ, গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা এবং কার্যকর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও সমান গুরুত্বপূর্ণ।ডা. মঈনুল আহসান বলেন, ‘ডেঙ্গু চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত সতর্ক ও তৎপর। কিন্তু জনগণের সহযোগিতা ছাড়া মৃত্যুহার কমানো কঠিন। সবাইকে অনুরোধ করছি জ্বর হলে অবহেলা করবেন না, সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করান।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুর গুরুতর পর্যায় সাধারণত জ্বরের ৩-৫ দিনের মধ্যে শুরু হয়। তাই এ সময়ের মধ্যেই রোগ শনাক্ত করা এবং চিকিৎসা শুরু করাই রোগীর জীবন বাঁচানোর মূল চাবিকাঠি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সর্বস্তরের নাগরিক, স্থানীয় প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও জোরদার করতে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে একযোগে কাজ করতে।
ডিএস./