০৮:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫

ভোজ্যতেল ও খাদ্যের তীব্র সংকটের মুখে বিশ্ব

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কেবল ওই অঞ্চলের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য খাদ্যভাণ্ডারে পরিণত হয় ইউক্রেন। পাশাপাশি দেশটি কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে কৃষিপণ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুটে পরিণত হয়েছে। চলমান যুদ্ধ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে শস্য এবং অন্যান্য খাদ্য রপ্তানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল দেশগুলোতে খাদ্য ও ভোজ্যতেলের জোগানে হুমকি তৈরি করেছে। মাত্র কয়েক দিনের সংঘাতেই পণ্যের বাজারে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। সূর্যমুখী তেল এফওবি ব্ল্যাক সি ইউক্রেনের দাম টন প্রতি ১৪৮০ ডলার থেকে ৪৭০.৫০ ডলার বেড়ে পৌঁছেছে ১৯৫০.৫০ ডলারে। ২০১৮ সালের পর এটাই সর্বোচ্চ দাম। একইভাবে শিকাগো বোর্ড অফ ট্রেডে গমজাত পণ্যের দাম ১২ শতাংশ বেড়েছে।

এই বৃদ্ধি আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আগের মৌসুমের বেশিরভাগ ভোজ্যতেল, ভুট্টা ও গম রপ্তানি হয়ে গেলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ সামনে আরও বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ রাশিয়া ইউক্রেনের প্রধান বন্দর, শস্যগুদাম এবং কৃষিজমিতে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এটি আসন্ন ফসল কাটার মৌসুমকে প্রভাবিত করতে যাচ্ছে। রাশিয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং আজভ ও কৃষ্ণ সাগরের বাণিজ্য রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে ভোজ্যতেল এবং গম সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রুশ অভিযানের কারণে বসন্তে সয়াবিন ও সূর্যমুখীর রোপণ বিলম্বিত হবে এবং হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন কমবে। ইউক্রেন সংকটের প্রভাবে নিত্যপণ্যের জোগানে যে বিপুল ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলায় অবশ্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলো।

তবে এরপরেও আগামীতে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। সূর্যমুখী তেল সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ধস: রাশিয়ান অভিযানে বহুমুখী সংকটে পড়েছেন ইউক্রেনের কৃষকরা। ডিনিপ্রোপেট্রোভস্ক, খারকভ, নিকোলিয়েভ, লুহানস্ক, ওডেসা ও পোলতাভা ইউক্রেনের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। দেশের মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্যের উল্লেখযোগ্য অংশের আবাদ হয় এসব অঞ্চলে। ইউক্রেনের প্রধান শহরগুলো দখলের চেষ্টা হিসেবে রুশ বাহিনী ওই অঞ্চলগুলোকে ভারী আক্রমণের আওতায় নিয়ে এসেছে। বোমাবর্ষণের তীব্রতায় সেখানে সূর্যমুখী বীজের বহু সংরক্ষণাগার বিধ্বস্ত হয়েছে, ফলে হুমকিতে পড়েছে তেল রপ্তানি। এছাড়া যুদ্ধের কারণে সারের জোগান থমকে যাওয়ায় নতুন মৌসুমের আবাদ নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।

ইউক্রেনে এপ্রিল ও মে মাসে সূর্যমুখী বীজ বপন করা হয়, আর ফসল তোলা শুরু হয় সাধারণ সেপ্টেম্বরে। চলমান অস্থিরতা এবং সামরিক অভিযানে কৃষিপণ্য উৎপাদন এলাকায় পরবর্তী আবাদ ও ফসল তোলা অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছে বিপুল ঘাটতির ঝুঁকি। বাণিজ্য রুট বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানি সুবিধাও বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষকরা বীজ বপনের সুযোগ না পাওয়ায় আগামী মৌসুমে সূর্যমুখী বীজের প্রতি হেক্টর গড় ফলনে বড় ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউক্রেনের ভোজ্যতেল উৎপাদন সক্ষমতা সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে সালে ইউক্রেনে সব ধরনের তেলবীজ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ টন, এর মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ টন ছিল সূর্যমুখী বীজ।

রপ্তানির ওপর গুরুত্ব দেয়ায় ইউক্রেনে তেলবীজ ভাঙানোর বেশিরভাগ কারখানা কৃষ্ণ সাগর তীরবর্তী বন্দরগুলোর কাছে গড়ে উঠেছে। এগুলোর সঙ্গে দেশের মধ্য ও পূর্ব অংশের বীজ উৎপাদনকারী এলাকার দূরত্ব অনেক। রুশ আক্রমণে ইউক্রেনের এসব কারখানা অচল হয়ে গেছে। লেনদেন স্থগিত এবং সূর্যমুখী বীজের সরবরাহ ঘাটতিতে বেশিরভাগ তেল উৎপাদন কেন্দ্র সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে বন্দরগুলো বন্ধ থাকায় সূর্যমুখী তেল আমদানিকারকরা চিন্তিত। ইউক্রেন থেকে আনুমানিক তিন লাখ টন সূর্যমুখী তেল ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এবং মার্চে রপ্তানির কথা ছিল, তবে চলমান সংকটের কারণে আমদানিকারকদের এখন অন্য কোনো উৎস থেকে এই তেলের জোগান পেতে হবে।

সূর্যমুখী তেল উৎপাদন ও শিপিং সুবিধা বন্ধের বিষয়টি ইউক্রেনের ভোজ্যতেল প্যাকেজিং শিল্পকেও প্রভাবিত করেছে। ফিউচার মার্কেট ইনসাইটসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে ভোজ্যতেলের প্যাকেজিং ড্রাম বিক্রি ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। তবে, যে পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে তাতে আগামী মাসগুলোতে এই বিক্রি ব্যাপকভাবে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গম সরবরাহ ব্যাহত: করোনা মহামারির কারণে সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটায় এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অনেক নিম্ন আয়ের খাদ্য আমদানিকারক দেশে বাড়ছে অপুষ্টির হার। এর মাঝে ইউক্রেন যুদ্ধ আরও বাড়িয়েছে অস্থিরতা। রপ্তানি সুবিধা বন্ধ হওয়ার ফলে তৈরি হয়েছে সারের অভাব, যা সরাসরি বিশ্বব্যাপী গম উৎপাদনকে হুমকিতে ফেলছে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সরবরাহ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা না গেলে ইউক্রেন থেকে বিশ্বব্যাপী গম রপ্তানির প্রায় ১২ শতাংশ কমতে পারে। রুশ অভিযানে বিশ্বব্যাপী গম ও গমজাত খাদ্যপণ্যের ব্যাপক ঘাটতির প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতে, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে মানবিক ত্রাণ সংস্থাগুলো সমস্যাগ্রস্ত দেশে খাদ্যের জোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে বিপর্যয়কর ক্ষুধার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব। পৃথিবীর অনেক দেশই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের গমের উপর নির্ভরশীল। তাই চলমান সংঘাত লাখ লাখ মানুষকে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ফেলেছে।

সামনের দিনে কী ঘটতে যাচ্ছে: বিশ্বব্যাপী গম ও সূর্যমুখী তেলের বাজারে স্বাভাবিকতা কবে ফিরবে এখনই তা বলা খুব কঠিন। এখন পর্যন্ত বিষয়টি নির্ভর করছে যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই চেইনের ক্ষতির পরিমাণ এবং লড়াই কতদিন চলে তার ওপর। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক শস্য ও ভোজ্যতেলের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। একইসঙ্গে পরিষ্কারভাবে বিশ্ব খাদ্য বাজার একটি মন্দায় প্রবেশ করছে এবং বিশ্বের দুর্বল অর্থনীতিগুলো বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার গম, ভোজ্যতেলের উপর নির্ভরশীল দেশগুলো রাশিয়া অঞ্চলের বাইরের শস্য এবং তেল উত্পাদনকারী দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

এটি ভারত ও চীনের মতো উদীয়মান জোগানদাতাদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে। চলমান সংকটে খাদ্য নিরাপত্তার ইস্যুটি এখন সবার সামনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এজন্য শস্য সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখার উদ্যোগের পাশাপাশি খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্রে পরিণত করার সম্ভাবনা এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ন্যাটো এবং এর মিত্রদের অবশ্যই সরবরাহ ব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে হবে। এর সঙ্গে ইউক্রেন ও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তার দিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আগামী মাসগুলোতে সংঘাত আরও খারাপ অবস্থায় গেলে বিভিন্ন দেশকে আরও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।

ট্যাগ :

বীরগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের ৪৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

ভোজ্যতেল ও খাদ্যের তীব্র সংকটের মুখে বিশ্ব

প্রকাশিত : ১২:০০:০১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ মার্চ ২০২২

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কেবল ওই অঞ্চলের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য খাদ্যভাণ্ডারে পরিণত হয় ইউক্রেন। পাশাপাশি দেশটি কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে কৃষিপণ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুটে পরিণত হয়েছে। চলমান যুদ্ধ ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে শস্য এবং অন্যান্য খাদ্য রপ্তানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল দেশগুলোতে খাদ্য ও ভোজ্যতেলের জোগানে হুমকি তৈরি করেছে। মাত্র কয়েক দিনের সংঘাতেই পণ্যের বাজারে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। সূর্যমুখী তেল এফওবি ব্ল্যাক সি ইউক্রেনের দাম টন প্রতি ১৪৮০ ডলার থেকে ৪৭০.৫০ ডলার বেড়ে পৌঁছেছে ১৯৫০.৫০ ডলারে। ২০১৮ সালের পর এটাই সর্বোচ্চ দাম। একইভাবে শিকাগো বোর্ড অফ ট্রেডে গমজাত পণ্যের দাম ১২ শতাংশ বেড়েছে।

এই বৃদ্ধি আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আগের মৌসুমের বেশিরভাগ ভোজ্যতেল, ভুট্টা ও গম রপ্তানি হয়ে গেলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ সামনে আরও বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ রাশিয়া ইউক্রেনের প্রধান বন্দর, শস্যগুদাম এবং কৃষিজমিতে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এটি আসন্ন ফসল কাটার মৌসুমকে প্রভাবিত করতে যাচ্ছে। রাশিয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং আজভ ও কৃষ্ণ সাগরের বাণিজ্য রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়ে ভোজ্যতেল এবং গম সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রুশ অভিযানের কারণে বসন্তে সয়াবিন ও সূর্যমুখীর রোপণ বিলম্বিত হবে এবং হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন কমবে। ইউক্রেন সংকটের প্রভাবে নিত্যপণ্যের জোগানে যে বিপুল ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলায় অবশ্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলো।

তবে এরপরেও আগামীতে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। সূর্যমুখী তেল সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ধস: রাশিয়ান অভিযানে বহুমুখী সংকটে পড়েছেন ইউক্রেনের কৃষকরা। ডিনিপ্রোপেট্রোভস্ক, খারকভ, নিকোলিয়েভ, লুহানস্ক, ওডেসা ও পোলতাভা ইউক্রেনের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। দেশের মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্যের উল্লেখযোগ্য অংশের আবাদ হয় এসব অঞ্চলে। ইউক্রেনের প্রধান শহরগুলো দখলের চেষ্টা হিসেবে রুশ বাহিনী ওই অঞ্চলগুলোকে ভারী আক্রমণের আওতায় নিয়ে এসেছে। বোমাবর্ষণের তীব্রতায় সেখানে সূর্যমুখী বীজের বহু সংরক্ষণাগার বিধ্বস্ত হয়েছে, ফলে হুমকিতে পড়েছে তেল রপ্তানি। এছাড়া যুদ্ধের কারণে সারের জোগান থমকে যাওয়ায় নতুন মৌসুমের আবাদ নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।

ইউক্রেনে এপ্রিল ও মে মাসে সূর্যমুখী বীজ বপন করা হয়, আর ফসল তোলা শুরু হয় সাধারণ সেপ্টেম্বরে। চলমান অস্থিরতা এবং সামরিক অভিযানে কৃষিপণ্য উৎপাদন এলাকায় পরবর্তী আবাদ ও ফসল তোলা অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছে বিপুল ঘাটতির ঝুঁকি। বাণিজ্য রুট বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানি সুবিধাও বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষকরা বীজ বপনের সুযোগ না পাওয়ায় আগামী মৌসুমে সূর্যমুখী বীজের প্রতি হেক্টর গড় ফলনে বড় ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউক্রেনের ভোজ্যতেল উৎপাদন সক্ষমতা সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে সালে ইউক্রেনে সব ধরনের তেলবীজ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ টন, এর মধ্যে ১ কোটি ৯০ লাখ টন ছিল সূর্যমুখী বীজ।

রপ্তানির ওপর গুরুত্ব দেয়ায় ইউক্রেনে তেলবীজ ভাঙানোর বেশিরভাগ কারখানা কৃষ্ণ সাগর তীরবর্তী বন্দরগুলোর কাছে গড়ে উঠেছে। এগুলোর সঙ্গে দেশের মধ্য ও পূর্ব অংশের বীজ উৎপাদনকারী এলাকার দূরত্ব অনেক। রুশ আক্রমণে ইউক্রেনের এসব কারখানা অচল হয়ে গেছে। লেনদেন স্থগিত এবং সূর্যমুখী বীজের সরবরাহ ঘাটতিতে বেশিরভাগ তেল উৎপাদন কেন্দ্র সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে বন্দরগুলো বন্ধ থাকায় সূর্যমুখী তেল আমদানিকারকরা চিন্তিত। ইউক্রেন থেকে আনুমানিক তিন লাখ টন সূর্যমুখী তেল ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এবং মার্চে রপ্তানির কথা ছিল, তবে চলমান সংকটের কারণে আমদানিকারকদের এখন অন্য কোনো উৎস থেকে এই তেলের জোগান পেতে হবে।

সূর্যমুখী তেল উৎপাদন ও শিপিং সুবিধা বন্ধের বিষয়টি ইউক্রেনের ভোজ্যতেল প্যাকেজিং শিল্পকেও প্রভাবিত করেছে। ফিউচার মার্কেট ইনসাইটসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে ভোজ্যতেলের প্যাকেজিং ড্রাম বিক্রি ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। তবে, যে পরিস্থিতি এখন তৈরি হয়েছে তাতে আগামী মাসগুলোতে এই বিক্রি ব্যাপকভাবে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গম সরবরাহ ব্যাহত: করোনা মহামারির কারণে সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত ঘটায় এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অনেক নিম্ন আয়ের খাদ্য আমদানিকারক দেশে বাড়ছে অপুষ্টির হার। এর মাঝে ইউক্রেন যুদ্ধ আরও বাড়িয়েছে অস্থিরতা। রপ্তানি সুবিধা বন্ধ হওয়ার ফলে তৈরি হয়েছে সারের অভাব, যা সরাসরি বিশ্বব্যাপী গম উৎপাদনকে হুমকিতে ফেলছে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সরবরাহ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করা না গেলে ইউক্রেন থেকে বিশ্বব্যাপী গম রপ্তানির প্রায় ১২ শতাংশ কমতে পারে। রুশ অভিযানে বিশ্বব্যাপী গম ও গমজাত খাদ্যপণ্যের ব্যাপক ঘাটতির প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মতে, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে মানবিক ত্রাণ সংস্থাগুলো সমস্যাগ্রস্ত দেশে খাদ্যের জোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে বিপর্যয়কর ক্ষুধার মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব। পৃথিবীর অনেক দেশই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের গমের উপর নির্ভরশীল। তাই চলমান সংঘাত লাখ লাখ মানুষকে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ফেলেছে।

সামনের দিনে কী ঘটতে যাচ্ছে: বিশ্বব্যাপী গম ও সূর্যমুখী তেলের বাজারে স্বাভাবিকতা কবে ফিরবে এখনই তা বলা খুব কঠিন। এখন পর্যন্ত বিষয়টি নির্ভর করছে যুদ্ধের কারণে সাপ্লাই চেইনের ক্ষতির পরিমাণ এবং লড়াই কতদিন চলে তার ওপর। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক শস্য ও ভোজ্যতেলের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। একইসঙ্গে পরিষ্কারভাবে বিশ্ব খাদ্য বাজার একটি মন্দায় প্রবেশ করছে এবং বিশ্বের দুর্বল অর্থনীতিগুলো বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার গম, ভোজ্যতেলের উপর নির্ভরশীল দেশগুলো রাশিয়া অঞ্চলের বাইরের শস্য এবং তেল উত্পাদনকারী দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

এটি ভারত ও চীনের মতো উদীয়মান জোগানদাতাদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে। চলমান সংকটে খাদ্য নিরাপত্তার ইস্যুটি এখন সবার সামনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এজন্য শস্য সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখার উদ্যোগের পাশাপাশি খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্রে পরিণত করার সম্ভাবনা এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ন্যাটো এবং এর মিত্রদের অবশ্যই সরবরাহ ব্যবস্থা স্থিতিশীল করতে হবে। এর সঙ্গে ইউক্রেন ও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তার দিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আগামী মাসগুলোতে সংঘাত আরও খারাপ অবস্থায় গেলে বিভিন্ন দেশকে আরও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।