# তারবার্তা জুড়ে দুর্নীতির খতিয়ান
# সব সেক্টরে ঘুষ নেওয়ার জন্য ‘কুখ্যাত’ বলা হয়
# বিচার ব্যবস্থা প্রভাবিত করে জামিন দেন তারেক
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীদের বক্তব্যে প্রায়ই তারেক জিয়া ও বিএনপি শাসনামলের দুর্নীতির নানা চিত্র ওঠে আসে। অন্যদিকে বিএনপি বরাবরই সেসব অস্বীকার করে সরকারী ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে আসছে। কিন্তু সত্যি কেমন ছিলেন তারেক রহমান? এ ব্যাপারে একটা সুষ্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে সাড়া জাগানো উইকিলিকসে প্রকাশিত গোপন নথিগুলোর দিকে চোখ বুলালেই।
সারা বিশ^ কাঁপিয়ে দেয়া সেইসব নথিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ সামান্য থাকলেও সেই সামান্য অংশের অনেকটা জুড়েই রয়েছেন তারেক রহমান। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে না দিতে ওয়াশিংটনে গোপন তারবার্তা পাঠিয়েছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান প্রভাবশালী নেতা তারেক রহমান ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণœ হয়েছে উল্লেখ করে ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর ওই তারবার্তা পাঠানো হয়েছিল। তারবার্তায় বলা হয়, দূতাবাস মনে করে, রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির জন্য তারেক রহমান দায়ী।
তারেকের ব্যাপারে ঢাকায় কাজ করা সবশেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি তার দেশকে লিখেছেন, ‘বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান জিয়াউর রহমানের কুখ্যাত বড় ছেলে এবং মায়ের উত্তরসূরি’, ‘ভয়ঙ্কর রাজনীতিক এবং দুর্নীতি ও চুরির মানসিকতাসম্পন্ন সরকারের প্রতীক’ উল্লেখ করে তাকে বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থের প্রতি হুমকি হিসেবেও দেখানো হয়।
মারিয়ার্টির রিপোর্টে তারেকের বিরুদ্ধে দূর্নীতির বিনিময়ে দেশের মন্ত্রিত্ব বিক্রির অভিযোগও করা হয়। এতে বলা হয়, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠন ও নির্বাচনে জয়লাভে কৌশলগত বুদ্ধি প্রয়োগের কৃতিত্ব তার। ৬০ জনের মন্ত্রিপরিষদের এক-তৃতীয়াংশই তিনি পূরণ করেছেন বা বিক্রি করেছেন। সমালোচকরা বলেন, তিনি খুবই নির্দয়, দুর্নীতিগ্রস্ত, একাডেমিক পড়াশোনার অবস্থাও খুব ভালো নয়, রাজনীতিতে অপরিপক্ক। দহাওয়া ভবনদ নামে একটি বাসা থেকে তিনিই মূলত সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওই ভবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল তার ছায়া সরকার। খালেদা জিয়ার ব্যাপারে মারিয়ার্টির রিপোর্টে বলা হয়, সমালোচকরা তাকে অলস, অশিক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে দলের মূল ক্ষমতা তার হাতেই।
উইকিলিকসের নথিতে তারেকের বিষয়গুলো ঢাকাস্থ তৎকালীন মার্কিন মারিয়ার্টি ছাড়াও ক‚টনীতিক হ্যারি কে টমাস বিউটেনিস, গীতা পাসি প্রমুখের বরাত দিয়ে এসেছে। নথির এসব তথ্য সমগ্রের অনেক কিছুই দেশের মিডিয়ার লোকজন জানতেন। এসবের ছিটেফোটা কিছুটা বিচ্ছিন্নভাবে কোন কোন মিডিয়াতেও ছাপা হয়েছে।
সাধারণত ক‚টনীতিকরা সংশ্লিষ্ট দেশের যেখানে যাকিছু খবর পান সেসব নিয়ে দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বৈঠকে পাওয়া বক্তব্য জুড়ে দিয়ে রিপোর্ট যার যার দেশে পাঠান। তারেকনামার নানা তথ্যে তৎকালীন প্রধানন্ত্রীর মূখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর নানা উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। এমন একটি রিপোর্টেই উঠে এসেছে ড সিদ্দিকী বলছেন, কী করে ছেলে তারেকের দুর্নীতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাঁর মা খালেদা জিয়া! ২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ ফুরোবার পর বিদেশ চলে যান ড কামাল সিদ্দিকী। এরপর আর দেশে ফিরেছেন এমনটা জানা যায়নি। আর কী তার নিজের দেশে ফেরা নিরাপদ হবে কোনদিন?
সরকারি ক্রয় এবং রাজনৈতিক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘুষ চাইতেন তারেক। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ ও কর ফাঁকি অনেক মামলার আসামি হওয়া সত্তে¡ও তিনি মুক্তি পেয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে গভীর আঁতাতের মাধ্যমে তারেক বিচার প্রক্রিয়ায় কারসাজি করতে এবং তত্ত¡াবধায়ক সরকার তার জামিন আটকানোর যে চেষ্টা করেছিল তাকে জয় করতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি ডলার অর্জনের দায়ে গুরুতর অভিযোগ এনেছে। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি চাঁদাবাজির মামলাও রয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে এক রিপোর্টে রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি মার্কিন কোম্পানি সিমেন্সের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণসহ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কয়েকটি মামলার সংক্ষিপ্ত সার তুলে ধরেন। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে সিমেন্স মামলার বিবরণে মরিয়ার্টি বলেন, ওই প্রত্যক্ষদর্শী তারেক ও তার ভাই কোকোর কাছে সিমেন্সের কাছ থেকে নেওয়া ঘুষ পৌঁছে দেন।
সিমেন্সের চুক্তির কাজের মোট অর্থ থেকে প্রায় ২ শতাংশ ঘুষ নেন তারেক। যা মার্কিন ডলারে পরিশোধ করা হয়। মামলাটি এখন মার্কিন বিচার বিভাগ এবং এফবিআইও দেখভাল করছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বরাত দিয়ে মরিয়ার্টির রিপোর্টে বলা হয়, এসব ঘুষ ও চাঁদাবাজির বাইরেও তারেক ব্যাপক অর্থ তছরুপে জড়িত ছিলেন। কয়েকজন সহচরের মাধ্যমে তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ফান্ডের ৩ লাখ ডলার আত্মসাৎ করেন। দুদকের বরাতে মরিয়ার্টি আরও বলেন, তারেক ছিলেন ওই তহবিলের সহ-স্বাক্ষরদাতা। ওই ফান্ডের অর্থ দিয়ে তিনি নিজ শহরে একটি জমি কিনেছেন। এছাড়া ওই তহবিলের অর্থ তিনি ২০০৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপির সদস্যদের মধ্যেও বিলি করেছেন।
আরও বলা হয়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মধ্যে ছিল আরেক ছায়া সরকার। হাওয়া ভবনে বসে এ সরকার চালাতেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন দল ও জোটের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েক নেতা। এমন আরো হাজার হাজার শব্দ উঠে এসেছে উইকিলিকসের সহি তারেকনামার ফর্দে ফর্দে!
জামিনে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে তারেকের যাত্রা করার কথাও জানায় দূতাবাস। ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাৎ, কর ফাঁকিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা চললেও তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় বলে বার্তায় উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বাধা কাটিয়ে বিচারিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে তিনি জামিন পেয়েছেন। দূতাবাস মনে করে, তারেকের বেশ কয়েকটি পাসপোর্ট আছে। গত সেপ্টেম্বরে সেগুলোর একটিতে যুক্তরাজ্য ভিসা দিয়েছে। ২০০৫ সালের ১১ মে ইস্যু করা অন্য একটি পাসপোর্টে পাঁচ বছর মেয়াদি (বি১/বি২) ভিসা লাগানো আছে। সরকার সেটি হয়তো জব্দ করেছে। তারেক কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলারের অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে খবর রয়েছে।