০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিশ্বায়নে মুক্তি নেই!

বিশ্বায়নের জাহাজে করে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ পৃথিবীর কোনায় কোনায় চারটি মৌলিক সংকট রফতানি করেছে। আর্থিক ব্যবস্থার ধস, অতি দারিদ্র্য, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কট্টরপন্থা।

বলা যায়, অন্যান্য সকল সমস্যা কমবেশি এই চার উৎস থেকেই মহামারীর মত ছড়িয়েছে। প্রথমেই খাদ্য সংকট নিয়ে দুটি কথা বলা যাক।

স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত বিশুদ্ধ দেশজ খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ এখন ‘আমদানি করা’ উচ্চ ক্যালরির ফাস্ট ফুডের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।

এছাড়াও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে জৈব-প্রকৌশল ব্যবহার করে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্ভর খাদ্য পণ্যের ছড়াছড়ি এখন বাজারে।

দেশি মুরগি আর কই মাছের মত কিছুদিন পর স্থানীয় কোনো কিছু আর সহজলভ্য থাকবে কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

আধুনিক শহরে রাসায়নিক নির্ভর ‘একমাত্রিক খাদ্য’ গ্রহণের প্রভাব, দুশ্চিন্তা ইত্যাদির কারণে কোনো এক নির্দিষ্ট পরিবেশের উপযোগী মানবস্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ছে।

উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, শ্বাস কষ্ট, ক্যান্সার ইত্যাদির মত অসুখ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে।

মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে নজিরবিহীনভাবে। অন্যদিকে, মুনাফা বাড়ছে শুধু ম্যাকডোনাল্ড, মনস্যান্টো, কেএফসি গংদের।

জেনে বিস্মিত হবেন, করোনা মহামারীর মধ্যেও আমাজন ২৮২ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে, অথচ কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

কর্মসংস্থান সংকট নিয়ে বলতে গেলে আবার সেই বিশ্বায়নের কথা আসে। মুক্ত বাণিজ্যের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের দাম পান না। গ্রামীণ বাজার শহুরে ভোগ্য-পণ্যে সয়লাভ। বৃহৎ কোম্পানির দাপটে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পাততারি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।

বড় বড় শিল্প কারখানার জন্য সস্তা শ্রমিকের যোগান নিশ্চিত করতে আর্থিক ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকরা উদ্ভট সব পরিকল্পণা বাস্তবায়ন করছেন।

ফলে গ্রাম কার্যত এখন শ্রমিকশূন্য। ‘উন্নয়নের’ কারণে যারা নির্বাসিত হয়েছেন তাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কৃষকের ফসল তোলার জন্য লোক পাওয়া যায় না।

কাজের অন্বেষণে সবাই ভিড় করছেন শহরে। বলা যায়, শহরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এর কারণ, অধিকাংশ কাজ নগরেই কুক্ষিগত হয়েছে।

একটু জীবিকার খোঁজে পিঁপড়ার মত শহরপানে আসা জনতার বেশিরভাগেরই ঠাঁই হচ্ছে ঘিনঘিনে সব বস্তিতে।

অথচ, আজকের বস্তিবাসী বা শহুরে শ্রমিক কিছুদিন আগেও যখন গ্রামে ছিলেন তার একটু ভিটে ছিল, দুটো মুরগি, একটি গবাদি পশু ছিল, একটি যৌথ সমাজ ছিল।

সেখানেই সংসারের দৈনন্দিন চাহিদার অনেকটাই অনায়াসে মেটাতে পারতেন। কিন্তু সব ছেড়ে নগরে এসে এখন টাকা ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না।

আর তাই অর্থ উপার্জনের জন্য এরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। নানান সমাজবিরুদ্ধ কাজে যুক্ত হন অনেকে। অথবা সামান্য পারিশ্রমিকেই মাস খাটেন।

শিক্ষার প্রসঙ্গে আলাপ তোলা যায়। বাণিজ্য চালিত অর্থনীতির সাথে খাপ খাওয়াতে ‘প্রকৃত’ শিক্ষার পাঠক্রম আমূল বদলে দেয়া হয়েছে।

কলকারখানা ও কর্পোরেশনের জন্য শ্রমিক তৈরি করাই এখন সর্বস্তরের শিক্ষার প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

সে জন্য বিশেষায়িত শিক্ষা ও সনদ নির্ভর পঠণ-পাঠনের এতটা জয়জয়কার। চিন্তা ও মননের বিকাশ মোটেই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

অন্তঃলোকের ঐশ্বর্য তৈরি করে সংবেদনশীল মুক্ত মানুষ বিনির্মাণের কোনো মহৎ আকাক্সক্ষা প্রচলিত শিক্ষা দর্শনে একেবারেই আর অবশিষ্ট নাই।

বৈষম্যের কথা যদি বলি, পৃথিবীব্যাপী সর্ব প্রকার বৈষম্য এখন তীব্রতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয় মোটেই।

সামান্য কয়েকজনের সিন্দুকে জমা হয়েছে সর্বজনের সম্পদ। আর সেটা হয়েছে এই ‘উন্নয়ন’ ও ‘বাণিজ্যে’র কাঁধে ভর দিয়েই।

ব্যাংক লুটেরাদের লুণ্ঠিত টাকার খেসারত দেয়া হচ্ছে জনগণের করের অর্থ দিয়ে। উন্নয়নের চমক দেখিয়ে বড় প্রকল্পগুলোর মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে কয়েকগুণ।

করোনার চিকিৎসা-বাণিজ্যের দিকেই তাকিয়ে দেখুন না। এদেশে ছয় বৃহৎ কোম্পানির সদ্য অনুমোদনপ্রাপ্ত ওষুধটির পেছনে একজন সাধারণ রোগীর প্রায় ৬০ হাজার টাকারও বেশি খরচ করতে হবে!

এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক দুর্নীতির কথা ভুলে যাই কি করে! অথবা ৬০ শতাংশ বাস ভাড়া বৃদ্ধি! শুধু তাই নয়, বড় ব্যবসার জন্য রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্রকল্প।

করোনা সংকট কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র ২ ট্রিলিয়ন ডলার, ভারত ২৬০ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার মত প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর সিংহভাগ সুবিধা নেবেন কিন্তু বৃহৎ পুঁজি লগ্নিকারীরা।

আমাদের ক্ষেত্রে ঋণ খেলাপিরাও ‘প্রাপ্য অংশ’ পাবেন! এছাড়াও অবকাঠামো নির্মাণ, জ্বালানি তেলে ভর্তুকি এবং পরিবেশ দূষণের দায় নিতে গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পরোক্ষ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে কোম্পানিকে।

ওদের জন্য এতটা বিনিয়োগ করতে হয় বলে সর্বজনের জন্য পরিসেবা খাতে ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমে যায়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও বিনিয়োগ হ্রাস পায়। এভাবেই রাষ্ট্রের বুনিয়াদি সেবা খাত রুগ্ন হয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকে।

নানা অনিশ্চয়তায় নগরের মানুষ এখন বিষণ্নতা ও নৈঃসঙ্গের ঘেরাটোপে বন্দি। বিজ্ঞাপনের চাকচিক্য মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছে। সম্প্রচার মাধ্যম ব্যক্তিকে দেখাচ্ছে- তুমি স্মার্ট, সুন্দর ও যোগ্য নও।

এজন্য পয়সা খরচ করে অত্যাধুনিক শিক্ষা কিনতে হবে, পণ্য কিনতে হবে, সম্পর্ক কিনতে হবে। কেনা ছাড়া জীবনের কোনো মানে নেই।

নেই কোনো গন্তব্য। আর কেনার জন্য লাগবে অর্থ। তাই মানুষ মরিয়া হয়ে যে কোনো উপায়ে পয়সা কামানোর ধান্ধা করছে।

রাজনীতিবিদ, আমলা, শিক্ষক থেকে গ্রামীণ উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীও উন্নতির এই দর্শন নিয়ে বীর দর্পে এগিয়ে যাচ্ছেন।

বৈধ পথে স্বল্প সময়ে তো ধনী হওয়া যায় না। তাই দিগবিদিক ছুটছে মানুষ। কেউ ট্রলারে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে, কেউ ব্যাংক লুটের প্রচেষ্টায়, কেউ রাজনৈতিক সন্ত্রাসে, কেউ জীবন-রক্ষাকারী ওষুধ বাণিজ্যে, কেউ লেজুরবৃত্তির পেশাদারী সংগঠনে সক্রিয় হয়ে।

চলছে এরকম আরও কত পন্থা! এভাবেই একটি সমন্বিত অন্যায্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দোর্ডণ্ড প্রতাপে দাঁড়িয়ে গেছে। রেন্ট সিকিং-ই সে অর্থনীতির প্রধান ধর্ম।

বিশ্বায়নের ফলে প্রান্তিক সমাজ ও পরিবার থেকে ‘ক্ষমতা’ ছিনতাই হয়ে গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে রাজধানীতে। অনেক দেশেই দেখতে পাচ্ছি- দুথএকজন ব্যক্তির গদি ও গাড়িতেই সব ক্ষমতা পুঞ্জিভূত এখন।

আর এদিকে, ক্ষমতাহীনতার বোধ মানুষকে আগ্রাসী, বেপরোয়া ও অস্তিত্ব-ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। তাই অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য কোনো বড় পদে আসীন ব্যক্তির সাথে সেলফি তুলে ব্যক্তি সে ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজের ‘ফাটকা-ক্ষমতা’ জানান দিচ্ছেন।

সম্পদ ও ক্ষমতার অভাবের কারণে মানুষ স্বজাতি-বিনাশী হয়ে উঠছে। অন্যের বিনাশের মাধ্যমে নিজের বিকাশ নিশ্চিত করতে চায়। সমাজ হয়ে ওঠে তুমুল অর্থে প্রতিযোগী।

সহযোগী নয় মোটেই। এর মধ্যে আটকা পড়ে শ্বাসরুদ্ধকর হতাশায় কাতরাতে থাকে সাধারণ মানুষ। যৌথ-সমাজ ভেঙ্গে গেছে বলে এই কাতর-মজলুমের পাশে দাঁড়ানোর মত কাউকে খুব একটা তালাশে পাওয়া যায় না আর।

হতাশ ও দমবন্ধকর পরিস্থিতে মানুষ নানা কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করে। দিনে দিনে ভয়ানক প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।

পুরনো প্রেমের স্মৃতির মত সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদ টিকে থাকে মগজের গভীর প্রকোষ্ঠে। সুযোগ পেলেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েডের খুন থেকে বাংলাদেশে বাউল হত্যা, কিংবা ভিন্ন ধর্মালম্বীর জমি দখল থেকে দেশে দেশে স্বৈরতন্ত্র বা কট্টরপন্থার জাগরণ ওই একই সূত্রে গাঁথা।

যাইহোক, এই ফিরিস্তি শেষ হবার নয়। চলমান সমস্ত অনাচারের সাথে নিঃসন্দেহে বিশ্বায়নের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। বৈশ্বিক বাণিজ্য প্ররোচিত বিশ্বায়নের কদর্যতা উপলব্ধি করে তাই এই গ্রহের নানান প্রান্তে ‘স্থানিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা’ গড়ে উঠছে।

এর নাম ‘স্থানীয়করণথ। এরকম অগণিত প্রকল্পের মধ্যে ভারতের নব-দৈন্য, থাইল্যান্ডের পান পান, বেলজিয়ামের লা ভিয়া ক্যাম্পেসিনা, যুক্তরাষ্ট্রের পাইন আইল্যাণ্ড খামার, ফ্রান্সের মোজা সার্তু, মেক্সিকোর টোজপ্যান, নাইজেরিয়ার প্যাক্স হার্বাল ইত্যাদির কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

এগুলোকে ‘সুখের অর্থনীতির’ নিদর্শনও বলা চলে। এরকম আঞ্চলিক উদ্যোগগুলোকে বৈশ্বিক যোগাযোগের মধ্যে এনে একটি সমন্বিত আন্দোলন সংঘটিত করার যে প্রয়াশ তার অংশ হিসেবে বিশ্ব স্থানীয়করণ দিবস ২০২০ পালন করা হচ্ছে ২১ জুন।

এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত আছেন লেখক, সংগঠক, চলচ্চিত্র নির্মাতা হেলেনা নরবার্গ হজ, খ্যাতিমান পরিবেশ কর্মী বন্দনা শিভা, অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি, কানাডার প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা ডেভিড সুজুকি, মার্কিন কবি ভেনডেল বেরি এবং বহু অর্থনীতিবিদ, তাত্ত্বিক, সংস্কৃতিকর্মী, অভিনেতা, লেখক ও কর্মী। স্থানীয়করণ স্বার্থক হোক। সেইসাথে মুক্ত হোক জীবন।

 

লেখক: শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ-৮১০০।

শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ আসলামের মামলা প্রত্যাহারের দাবি

বিশ্বায়নে মুক্তি নেই!

প্রকাশিত : ০২:৫৪:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ জুন ২০২০

বিশ্বায়নের জাহাজে করে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ পৃথিবীর কোনায় কোনায় চারটি মৌলিক সংকট রফতানি করেছে। আর্থিক ব্যবস্থার ধস, অতি দারিদ্র্য, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কট্টরপন্থা।

বলা যায়, অন্যান্য সকল সমস্যা কমবেশি এই চার উৎস থেকেই মহামারীর মত ছড়িয়েছে। প্রথমেই খাদ্য সংকট নিয়ে দুটি কথা বলা যাক।

স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত বিশুদ্ধ দেশজ খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ এখন ‘আমদানি করা’ উচ্চ ক্যালরির ফাস্ট ফুডের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।

এছাড়াও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দোহাই দিয়ে জৈব-প্রকৌশল ব্যবহার করে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্ভর খাদ্য পণ্যের ছড়াছড়ি এখন বাজারে।

দেশি মুরগি আর কই মাছের মত কিছুদিন পর স্থানীয় কোনো কিছু আর সহজলভ্য থাকবে কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

আধুনিক শহরে রাসায়নিক নির্ভর ‘একমাত্রিক খাদ্য’ গ্রহণের প্রভাব, দুশ্চিন্তা ইত্যাদির কারণে কোনো এক নির্দিষ্ট পরিবেশের উপযোগী মানবস্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ছে।

উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, শ্বাস কষ্ট, ক্যান্সার ইত্যাদির মত অসুখ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে।

মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে নজিরবিহীনভাবে। অন্যদিকে, মুনাফা বাড়ছে শুধু ম্যাকডোনাল্ড, মনস্যান্টো, কেএফসি গংদের।

জেনে বিস্মিত হবেন, করোনা মহামারীর মধ্যেও আমাজন ২৮২ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে, অথচ কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

কর্মসংস্থান সংকট নিয়ে বলতে গেলে আবার সেই বিশ্বায়নের কথা আসে। মুক্ত বাণিজ্যের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের দাম পান না। গ্রামীণ বাজার শহুরে ভোগ্য-পণ্যে সয়লাভ। বৃহৎ কোম্পানির দাপটে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পাততারি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।

বড় বড় শিল্প কারখানার জন্য সস্তা শ্রমিকের যোগান নিশ্চিত করতে আর্থিক ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকরা উদ্ভট সব পরিকল্পণা বাস্তবায়ন করছেন।

ফলে গ্রাম কার্যত এখন শ্রমিকশূন্য। ‘উন্নয়নের’ কারণে যারা নির্বাসিত হয়েছেন তাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কৃষকের ফসল তোলার জন্য লোক পাওয়া যায় না।

কাজের অন্বেষণে সবাই ভিড় করছেন শহরে। বলা যায়, শহরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এর কারণ, অধিকাংশ কাজ নগরেই কুক্ষিগত হয়েছে।

একটু জীবিকার খোঁজে পিঁপড়ার মত শহরপানে আসা জনতার বেশিরভাগেরই ঠাঁই হচ্ছে ঘিনঘিনে সব বস্তিতে।

অথচ, আজকের বস্তিবাসী বা শহুরে শ্রমিক কিছুদিন আগেও যখন গ্রামে ছিলেন তার একটু ভিটে ছিল, দুটো মুরগি, একটি গবাদি পশু ছিল, একটি যৌথ সমাজ ছিল।

সেখানেই সংসারের দৈনন্দিন চাহিদার অনেকটাই অনায়াসে মেটাতে পারতেন। কিন্তু সব ছেড়ে নগরে এসে এখন টাকা ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না।

আর তাই অর্থ উপার্জনের জন্য এরা মরিয়া হয়ে ওঠেন। নানান সমাজবিরুদ্ধ কাজে যুক্ত হন অনেকে। অথবা সামান্য পারিশ্রমিকেই মাস খাটেন।

শিক্ষার প্রসঙ্গে আলাপ তোলা যায়। বাণিজ্য চালিত অর্থনীতির সাথে খাপ খাওয়াতে ‘প্রকৃত’ শিক্ষার পাঠক্রম আমূল বদলে দেয়া হয়েছে।

কলকারখানা ও কর্পোরেশনের জন্য শ্রমিক তৈরি করাই এখন সর্বস্তরের শিক্ষার প্রধান ও একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

সে জন্য বিশেষায়িত শিক্ষা ও সনদ নির্ভর পঠণ-পাঠনের এতটা জয়জয়কার। চিন্তা ও মননের বিকাশ মোটেই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

অন্তঃলোকের ঐশ্বর্য তৈরি করে সংবেদনশীল মুক্ত মানুষ বিনির্মাণের কোনো মহৎ আকাক্সক্ষা প্রচলিত শিক্ষা দর্শনে একেবারেই আর অবশিষ্ট নাই।

বৈষম্যের কথা যদি বলি, পৃথিবীব্যাপী সর্ব প্রকার বৈষম্য এখন তীব্রতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয় মোটেই।

সামান্য কয়েকজনের সিন্দুকে জমা হয়েছে সর্বজনের সম্পদ। আর সেটা হয়েছে এই ‘উন্নয়ন’ ও ‘বাণিজ্যে’র কাঁধে ভর দিয়েই।

ব্যাংক লুটেরাদের লুণ্ঠিত টাকার খেসারত দেয়া হচ্ছে জনগণের করের অর্থ দিয়ে। উন্নয়নের চমক দেখিয়ে বড় প্রকল্পগুলোর মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে কয়েকগুণ।

করোনার চিকিৎসা-বাণিজ্যের দিকেই তাকিয়ে দেখুন না। এদেশে ছয় বৃহৎ কোম্পানির সদ্য অনুমোদনপ্রাপ্ত ওষুধটির পেছনে একজন সাধারণ রোগীর প্রায় ৬০ হাজার টাকারও বেশি খরচ করতে হবে!

এন নাইন্টি ফাইভ মাস্ক দুর্নীতির কথা ভুলে যাই কি করে! অথবা ৬০ শতাংশ বাস ভাড়া বৃদ্ধি! শুধু তাই নয়, বড় ব্যবসার জন্য রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্রকল্প।

করোনা সংকট কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র ২ ট্রিলিয়ন ডলার, ভারত ২৬০ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার মত প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর সিংহভাগ সুবিধা নেবেন কিন্তু বৃহৎ পুঁজি লগ্নিকারীরা।

আমাদের ক্ষেত্রে ঋণ খেলাপিরাও ‘প্রাপ্য অংশ’ পাবেন! এছাড়াও অবকাঠামো নির্মাণ, জ্বালানি তেলে ভর্তুকি এবং পরিবেশ দূষণের দায় নিতে গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পরোক্ষ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে কোম্পানিকে।

ওদের জন্য এতটা বিনিয়োগ করতে হয় বলে সর্বজনের জন্য পরিসেবা খাতে ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কমে যায়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও বিনিয়োগ হ্রাস পায়। এভাবেই রাষ্ট্রের বুনিয়াদি সেবা খাত রুগ্ন হয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকে।

নানা অনিশ্চয়তায় নগরের মানুষ এখন বিষণ্নতা ও নৈঃসঙ্গের ঘেরাটোপে বন্দি। বিজ্ঞাপনের চাকচিক্য মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছে। সম্প্রচার মাধ্যম ব্যক্তিকে দেখাচ্ছে- তুমি স্মার্ট, সুন্দর ও যোগ্য নও।

এজন্য পয়সা খরচ করে অত্যাধুনিক শিক্ষা কিনতে হবে, পণ্য কিনতে হবে, সম্পর্ক কিনতে হবে। কেনা ছাড়া জীবনের কোনো মানে নেই।

নেই কোনো গন্তব্য। আর কেনার জন্য লাগবে অর্থ। তাই মানুষ মরিয়া হয়ে যে কোনো উপায়ে পয়সা কামানোর ধান্ধা করছে।

রাজনীতিবিদ, আমলা, শিক্ষক থেকে গ্রামীণ উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীও উন্নতির এই দর্শন নিয়ে বীর দর্পে এগিয়ে যাচ্ছেন।

বৈধ পথে স্বল্প সময়ে তো ধনী হওয়া যায় না। তাই দিগবিদিক ছুটছে মানুষ। কেউ ট্রলারে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে, কেউ ব্যাংক লুটের প্রচেষ্টায়, কেউ রাজনৈতিক সন্ত্রাসে, কেউ জীবন-রক্ষাকারী ওষুধ বাণিজ্যে, কেউ লেজুরবৃত্তির পেশাদারী সংগঠনে সক্রিয় হয়ে।

চলছে এরকম আরও কত পন্থা! এভাবেই একটি সমন্বিত অন্যায্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দোর্ডণ্ড প্রতাপে দাঁড়িয়ে গেছে। রেন্ট সিকিং-ই সে অর্থনীতির প্রধান ধর্ম।

বিশ্বায়নের ফলে প্রান্তিক সমাজ ও পরিবার থেকে ‘ক্ষমতা’ ছিনতাই হয়ে গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে রাজধানীতে। অনেক দেশেই দেখতে পাচ্ছি- দুথএকজন ব্যক্তির গদি ও গাড়িতেই সব ক্ষমতা পুঞ্জিভূত এখন।

আর এদিকে, ক্ষমতাহীনতার বোধ মানুষকে আগ্রাসী, বেপরোয়া ও অস্তিত্ব-ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। তাই অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য কোনো বড় পদে আসীন ব্যক্তির সাথে সেলফি তুলে ব্যক্তি সে ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজের ‘ফাটকা-ক্ষমতা’ জানান দিচ্ছেন।

সম্পদ ও ক্ষমতার অভাবের কারণে মানুষ স্বজাতি-বিনাশী হয়ে উঠছে। অন্যের বিনাশের মাধ্যমে নিজের বিকাশ নিশ্চিত করতে চায়। সমাজ হয়ে ওঠে তুমুল অর্থে প্রতিযোগী।

সহযোগী নয় মোটেই। এর মধ্যে আটকা পড়ে শ্বাসরুদ্ধকর হতাশায় কাতরাতে থাকে সাধারণ মানুষ। যৌথ-সমাজ ভেঙ্গে গেছে বলে এই কাতর-মজলুমের পাশে দাঁড়ানোর মত কাউকে খুব একটা তালাশে পাওয়া যায় না আর।

হতাশ ও দমবন্ধকর পরিস্থিতে মানুষ নানা কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করে। দিনে দিনে ভয়ানক প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।

পুরনো প্রেমের স্মৃতির মত সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদ টিকে থাকে মগজের গভীর প্রকোষ্ঠে। সুযোগ পেলেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েডের খুন থেকে বাংলাদেশে বাউল হত্যা, কিংবা ভিন্ন ধর্মালম্বীর জমি দখল থেকে দেশে দেশে স্বৈরতন্ত্র বা কট্টরপন্থার জাগরণ ওই একই সূত্রে গাঁথা।

যাইহোক, এই ফিরিস্তি শেষ হবার নয়। চলমান সমস্ত অনাচারের সাথে নিঃসন্দেহে বিশ্বায়নের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। বৈশ্বিক বাণিজ্য প্ররোচিত বিশ্বায়নের কদর্যতা উপলব্ধি করে তাই এই গ্রহের নানান প্রান্তে ‘স্থানিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা’ গড়ে উঠছে।

এর নাম ‘স্থানীয়করণথ। এরকম অগণিত প্রকল্পের মধ্যে ভারতের নব-দৈন্য, থাইল্যান্ডের পান পান, বেলজিয়ামের লা ভিয়া ক্যাম্পেসিনা, যুক্তরাষ্ট্রের পাইন আইল্যাণ্ড খামার, ফ্রান্সের মোজা সার্তু, মেক্সিকোর টোজপ্যান, নাইজেরিয়ার প্যাক্স হার্বাল ইত্যাদির কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

এগুলোকে ‘সুখের অর্থনীতির’ নিদর্শনও বলা চলে। এরকম আঞ্চলিক উদ্যোগগুলোকে বৈশ্বিক যোগাযোগের মধ্যে এনে একটি সমন্বিত আন্দোলন সংঘটিত করার যে প্রয়াশ তার অংশ হিসেবে বিশ্ব স্থানীয়করণ দিবস ২০২০ পালন করা হচ্ছে ২১ জুন।

এই আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত আছেন লেখক, সংগঠক, চলচ্চিত্র নির্মাতা হেলেনা নরবার্গ হজ, খ্যাতিমান পরিবেশ কর্মী বন্দনা শিভা, অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি, কানাডার প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা ডেভিড সুজুকি, মার্কিন কবি ভেনডেল বেরি এবং বহু অর্থনীতিবিদ, তাত্ত্বিক, সংস্কৃতিকর্মী, অভিনেতা, লেখক ও কর্মী। স্থানীয়করণ স্বার্থক হোক। সেইসাথে মুক্ত হোক জীবন।

 

লেখক: শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ-৮১০০।