০৬:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

১০ বছরে আলো নিভেছে ৩১ রুপালি পর্দার

২০০৭-০৮ সালের দিকেও বগুড়ার ধুনট উপজেলার গ্রামে গ্রামে সিনেমার প্রচার মাইকিং হতো। হলে মুক্তি পাওয়া নতুন সিনেমার পোস্টার রিকশার দুই পাশে টানিয়ে আসনে বসে প্রচার করতেন ভয়েস আর্টিস্টরা। গ্রামের পথ ধরে যাওয়া রিকশার পেছন পেছন ছুটতেন তরুণ-কিশোরেরা। মাইকে প্রচার হতো, ‘বিপুল সমারোহে চলিতেছে…’।
সিনেমার প্রচারণায় হলের নামের জায়গায় কখনো থাকত ক্লিওপেট্রা, ঝংকার অথবা সিকতা। সেই প্রচারণা এখন নেই। সিনেমা হলগুলোও বন্ধ। সবশেষ করোনাভাইরাসের প্রভাবে লোকসানের মুখে ভেঙে ফেলা হচ্ছে উপজেলা সদরের ‘সিকতা সিনেমা হল প্রাইভেট লিমিটেড’ও।
সিকতাসহ গত ১০ বছরে বগুড়া জেলায় আলো নিভে গেছে ৩১টি হলের রুপালি পর্দার। গত মঙ্গলবার থেকে ২৮ বছরের পুরোনো সিকতা হল ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে বিপণিবিতান গড়ে তোলা হবে। সিকতাসহ জেলায় আগে মোট সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৩৮। শুধু বগুড়া শহরেই ছিল ১০টি। এখন জেলায় সিনেমা হলের সংখ্যা ৭। তবে এগুলো বন্ধ। জেলা শহরে আছে দুটি সিনেমা হল। তা-ও চালু নেই। সংস্কারের জন্য একটি সিনেমা হল তিন বছর ধরে বন্ধ। অন্যটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর তালা ঝুলছে। সিকতার রুপালি পর্দায় আলো জ্বলেছিল ১৯৯৩ সালে। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য এস এম শাহাদৎ হোসেন ধুনট শহরের অফিসারপাড়া এলাকায় ১০ শতক জায়গার ওপর সিকতা সিনেমা চালু করেন। এই হলে প্রথম প্রদর্শিত হয় সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত স্বপ্নের ঠিকানা চলচ্চিত্র। প্রথম দিনেই হাউসফুল। ৬৫০ আসন কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত জমজমাট ছিল সিকতা। বেশ ভালো ব্যবসা হওয়া ছবির মধ্যে সালমান শাহ-শাহানাজ অভিনীত সত্যের মৃত্যু নাই; সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত তোমাকে চাই; মান্না অভিনীত লুটতরাজ, আম্মাজান, ধর, দাঙ্গা; শাকিব খান-অপু বিশ্বাস অভিনীত মনের জ্বালা উল্লেখযোগ্য। সিকতা সিনেমা হলের বর্তমান মালিক জাকির হোসেন বলেন, সিনেমা হল ব্যবসায় দর্শক-খরার শুরু ২০০৮ সালে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাধ্য হয়ে হল ভেঙে বিপণিবিতান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ভালো গল্পের ছায়াছবি নেই, ছবিতে নেই ভালো সংলাপ, নেই ভালো গান ও অভিনয়। এই অবস্থায় অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলছিল সিনেমা হলের ব্যবসা। ২০১৮ সাল থেকে শুধু ঈদ উৎসবে চালু রাখা সম্ভব হয় সিনেমা হলটি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের পবিত্র ঈদুল ফিতরে প্রদর্শিত হয় বেপরোয়া ছায়াছবি। এতে তাঁকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। হলের পুরোনো মাল নিলামে বিক্রির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। মাত্র চার লাখ টাকায় তা বিক্রি করতে পেরেছেন।
স্থানীয় দর্শক ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যমুনা নদীর পারের জনপদ ধুনট উপজেলায় একসময় বিনোদনে ভরসা ছিল সিনেমা হল। দর্শক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছিল চারটি সিনেমা হল। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো প্রেক্ষাগৃহ ক্লিওপেট্রা। এরপর একে একে গড়ে ওঠে ঝংকার ও সিকতা সিনেমা হল। উপজেলা সদরের বাইরে গোসাইবাড়ি বাজারে চালু হয় কাজল সিনেমা হল। তবে সবার আগে বন্ধ হয় কাজলই। এরপর ভাঙা পড়ছে সিকতা। আর অনেক আগে থেকেই বন্ধ ক্লিওপেট্রা ও ঝংকার।
ঝংকার সিনেমা হলের মালিক মো. ঈসা খান বলেন, ১৯৮৪ সালে উজ্জ্বল-শাবানা অভিনীত নসীব ছায়াছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে ঝংকারের রুপালি পর্দা জ্বলে ওঠে। ৬৫০ আসনের এই সিনেমা হলে হাউসফুল ব্যবসা হয়েছে ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু অভিনীত সাড়াজাগানো ছায়াছবি বেদের মেয়ে জোসনা ও সোহেল রানা-সুচরিতা অভিনীত অস্বীকার। ২০১২ সালের পর টানা দর্শক-খরা চলে। এই অবস্থায় কয়েক বছর ধরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সিনেমা হলের ব্যবসা। শুধু ঈদ উৎসবকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে ছায়াছবি প্রদর্শন। করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের মার্চ থেকে পুরোপুরি বন্ধ সিনেমা হলটি।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

সীতাকুণ্ডে বাস-ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৭

১০ বছরে আলো নিভেছে ৩১ রুপালি পর্দার

প্রকাশিত : ১২:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১

২০০৭-০৮ সালের দিকেও বগুড়ার ধুনট উপজেলার গ্রামে গ্রামে সিনেমার প্রচার মাইকিং হতো। হলে মুক্তি পাওয়া নতুন সিনেমার পোস্টার রিকশার দুই পাশে টানিয়ে আসনে বসে প্রচার করতেন ভয়েস আর্টিস্টরা। গ্রামের পথ ধরে যাওয়া রিকশার পেছন পেছন ছুটতেন তরুণ-কিশোরেরা। মাইকে প্রচার হতো, ‘বিপুল সমারোহে চলিতেছে…’।
সিনেমার প্রচারণায় হলের নামের জায়গায় কখনো থাকত ক্লিওপেট্রা, ঝংকার অথবা সিকতা। সেই প্রচারণা এখন নেই। সিনেমা হলগুলোও বন্ধ। সবশেষ করোনাভাইরাসের প্রভাবে লোকসানের মুখে ভেঙে ফেলা হচ্ছে উপজেলা সদরের ‘সিকতা সিনেমা হল প্রাইভেট লিমিটেড’ও।
সিকতাসহ গত ১০ বছরে বগুড়া জেলায় আলো নিভে গেছে ৩১টি হলের রুপালি পর্দার। গত মঙ্গলবার থেকে ২৮ বছরের পুরোনো সিকতা হল ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে বিপণিবিতান গড়ে তোলা হবে। সিকতাসহ জেলায় আগে মোট সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৩৮। শুধু বগুড়া শহরেই ছিল ১০টি। এখন জেলায় সিনেমা হলের সংখ্যা ৭। তবে এগুলো বন্ধ। জেলা শহরে আছে দুটি সিনেমা হল। তা-ও চালু নেই। সংস্কারের জন্য একটি সিনেমা হল তিন বছর ধরে বন্ধ। অন্যটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর তালা ঝুলছে। সিকতার রুপালি পর্দায় আলো জ্বলেছিল ১৯৯৩ সালে। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য এস এম শাহাদৎ হোসেন ধুনট শহরের অফিসারপাড়া এলাকায় ১০ শতক জায়গার ওপর সিকতা সিনেমা চালু করেন। এই হলে প্রথম প্রদর্শিত হয় সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত স্বপ্নের ঠিকানা চলচ্চিত্র। প্রথম দিনেই হাউসফুল। ৬৫০ আসন কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত জমজমাট ছিল সিকতা। বেশ ভালো ব্যবসা হওয়া ছবির মধ্যে সালমান শাহ-শাহানাজ অভিনীত সত্যের মৃত্যু নাই; সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত তোমাকে চাই; মান্না অভিনীত লুটতরাজ, আম্মাজান, ধর, দাঙ্গা; শাকিব খান-অপু বিশ্বাস অভিনীত মনের জ্বালা উল্লেখযোগ্য। সিকতা সিনেমা হলের বর্তমান মালিক জাকির হোসেন বলেন, সিনেমা হল ব্যবসায় দর্শক-খরার শুরু ২০০৮ সালে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাধ্য হয়ে হল ভেঙে বিপণিবিতান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ভালো গল্পের ছায়াছবি নেই, ছবিতে নেই ভালো সংলাপ, নেই ভালো গান ও অভিনয়। এই অবস্থায় অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলছিল সিনেমা হলের ব্যবসা। ২০১৮ সাল থেকে শুধু ঈদ উৎসবে চালু রাখা সম্ভব হয় সিনেমা হলটি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের পবিত্র ঈদুল ফিতরে প্রদর্শিত হয় বেপরোয়া ছায়াছবি। এতে তাঁকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। হলের পুরোনো মাল নিলামে বিক্রির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। মাত্র চার লাখ টাকায় তা বিক্রি করতে পেরেছেন।
স্থানীয় দর্শক ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যমুনা নদীর পারের জনপদ ধুনট উপজেলায় একসময় বিনোদনে ভরসা ছিল সিনেমা হল। দর্শক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছিল চারটি সিনেমা হল। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো প্রেক্ষাগৃহ ক্লিওপেট্রা। এরপর একে একে গড়ে ওঠে ঝংকার ও সিকতা সিনেমা হল। উপজেলা সদরের বাইরে গোসাইবাড়ি বাজারে চালু হয় কাজল সিনেমা হল। তবে সবার আগে বন্ধ হয় কাজলই। এরপর ভাঙা পড়ছে সিকতা। আর অনেক আগে থেকেই বন্ধ ক্লিওপেট্রা ও ঝংকার।
ঝংকার সিনেমা হলের মালিক মো. ঈসা খান বলেন, ১৯৮৪ সালে উজ্জ্বল-শাবানা অভিনীত নসীব ছায়াছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে ঝংকারের রুপালি পর্দা জ্বলে ওঠে। ৬৫০ আসনের এই সিনেমা হলে হাউসফুল ব্যবসা হয়েছে ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু অভিনীত সাড়াজাগানো ছায়াছবি বেদের মেয়ে জোসনা ও সোহেল রানা-সুচরিতা অভিনীত অস্বীকার। ২০১২ সালের পর টানা দর্শক-খরা চলে। এই অবস্থায় কয়েক বছর ধরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সিনেমা হলের ব্যবসা। শুধু ঈদ উৎসবকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে ছায়াছবি প্রদর্শন। করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের মার্চ থেকে পুরোপুরি বন্ধ সিনেমা হলটি।