০৮:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

লাউয়াছড়ার জঙ্গল কাব্য

  • সুমন্ত গুপ্ত
  • প্রকাশিত : ১২:০১:২৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১
  • 32

পথে পাখিদের কিচিরমিচির অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি করল। উঁচু-নিচু টিলাজুড়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গঠন। পাহাড়ি টিলার মধ্য দিয়ে এ বনে চলার পথ।

ঘড়ির কাঁটায় সকাল আটটা। রওনা দিয়েছি সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র বন্দর বাজার থেকে। স্নিগ্ধ সকালে মহাসড়ক পেরিয়ে চলছি এগিয়ে। গন্তব্য মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থান হলেও উদ্যানটি শ্রীমঙ্গল থেকে কাছে। আমার ভ্রমণসঙ্গী আনন্দ, পৃথু, পিকু, অনিক, সপ্তক। আর গন্তব্যে পৌঁছানোর দায়িত্বে আছে ফরহাদ। দয়ামির বাজার, গোয়ালা বাজার পেরিয়ে এগিয়ে চলছি। ঘণ্টা দু-একের মধ্যে আমরা এসে পৌঁছালাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বারে। টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম ভেতর পানে পদব্রজে। প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দেখা পেলাম আকাশছোঁয়া সব গাছের সারি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে চলছে সূর্য দেবের লুকোচুরি খেলা। আমরা চলছি এগিয়ে, পথে পাখিদের কিচিরমিচির অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি করল। উঁচু-নিচু টিলাজুড়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গঠন। পাহাড়ি টিলার মধ্য দিয়ে এ বনে চলার পথ। উদ্যানের ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি ছড়া। আমরা দেখা পেলাম তেমনি একটি ছড়ার। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম, কিছু দূর চলার পরে দেখা পেলাম ঢাকা-সিলেট রেলপথ। এরপরই মূলত জঙ্গলের শুরু। আমরা রেলপথের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। দেখা পেলাম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজসহ কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্রের শুটিং স্পট। আমরা মূল সড়ক ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করলাম। সাইরেনের মতো এক ধরনের শব্দ কানে আসছিল। আমাদের কনিষ্ঠ ভ্রমণসঙ্গী সপ্তক জানতে চাইল, এটি কিসের শব্দ। আমি বললাম, এটি এ বনে থাকা ঝিঁঝি পোকার ডাক। উদ্যানে বেড়ানোর তিনটি পথ দেখতে পেলাম আমরা। উদ্যানের ভেতরে একটি খাসিয়াপল্লি আছে। প্রথম পথটির শুরু রেললাইন পেরিয়ে হাতের বাঁ দিক থেকে। পথের শুরুতে উঁচু গাছগুলোতে দেখা মিলতে পারে কুলু বানরের। নানা রকম গাছগাছালির ভেতর দিয়ে তৈরি করা এ পথে চলতে চলতে জঙ্গলের নির্জনতায় শিহরিত হবেন যে কেউ। নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে চলতে এই পথ শেষ হবে ঠিক শুরুর স্থানে। আর এক ঘণ্টার পথ হেঁটে একটু ভেতরে গেলে শুরুতেই চোখে পড়বে বিশাল গন্ধ রুই, ঝাওয়া, জগডুমুর, কাঁঠালিচাঁপা, লেহা প্রভৃতি গাছ।


পথের পাশে থাকা ডুমুরগাছের ফল খেতে আসে উল্লুক, বানর ও হনুমান ছাড়াও বনের বাসিন্দা আরও অনেক বন্য প্রাণী। ঘুরতে ঘুরতে আমরা একসময় পৌঁছে গেলাম খাসিয়াদের বসতি মাগুরছড়া পুঞ্জি। এ পুঞ্জির বাসিন্দারা মূলত পান চাষ করে থাকে। ১৯৫০ সালের দিকে বন বিভাগ এ পুঞ্জি তৈরি করে। এসব আমরা জানতে পারলাম পার্কের মধ্যে থাকা তথ্যকেন্দ্র থেকে। পথেই দেখা মিলল বিশাল বাঁশবাগান। এখানে নানা ধরনের বানরের খেলা দেখে মজা পাবে যেকোনো পর্যটক। পথের শেষে দেখতে পেলাম বনের অন্যতম আকর্ষণ উল্লুক পরিবারের। এরা বনের সবচেয়ে উঁচু গাছগুলোতে দলবদ্ধভাবে বাস করে।
এই বন এতই ঘন যে মাটিতে সূর্যের আলো পড়ে না বললেই চলে। প্রকৃতির সব সৌন্দর্য উপভোগ করে আমরা ফিরলাম আগের পথেই।

কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যেতে ট্রেন হচ্ছে সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। ঢাকা থেকে ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল যেতে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন হতে উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত অথবা কালনী এক্সপ্রেসকে বেছে নিতে পারেন। শ্রেণিভেদে জনপ্রতি ট্রেন ভাড়া ২৬৫ থেকে ১০০০ টাকা। ট্রেনে যেতে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। বাসে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে ফকিরাপুল অথবা সায়েদাবাদ থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ভাড়ায় নন-এসি বাস পাওয়া যায়। বাসে যেতে সময় লাগে চার ঘণ্টার মতো। শ্রীমঙ্গল পৌঁছে সেখান থেকে আপনার চাহিদা অনুযায়ী কোনো গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন লাউয়াছড়া উদ্যানে। ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, জিপ, মাইক্রোবাস যেকোনো কিছুতেই যাওয়া যায়। যাওয়া-আসা ও সেখানে ঘুরে বেড়ানোর সময়সহ রিজার্ভ নিলে সিএনজি ৪০০-৫০০ টাকা নেবে। আর আপনি চাইলে দিনে এসে দিনেই ফিরে যেতে পারবেন লাউয়াছড়া উদ্যানে থেকে। আর থাকতে চাইলে শ্রীমঙ্গল শহরে গিয়ে থাকতে হবে।

 

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

লোহাগাড়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দিনমজুরের মৃত্যু, গাছেই ঝুলছিল ম’র’দে’হ

লাউয়াছড়ার জঙ্গল কাব্য

প্রকাশিত : ১২:০১:২৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী ২০২১

পথে পাখিদের কিচিরমিচির অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি করল। উঁচু-নিচু টিলাজুড়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গঠন। পাহাড়ি টিলার মধ্য দিয়ে এ বনে চলার পথ।

ঘড়ির কাঁটায় সকাল আটটা। রওনা দিয়েছি সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র বন্দর বাজার থেকে। স্নিগ্ধ সকালে মহাসড়ক পেরিয়ে চলছি এগিয়ে। গন্তব্য মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থান হলেও উদ্যানটি শ্রীমঙ্গল থেকে কাছে। আমার ভ্রমণসঙ্গী আনন্দ, পৃথু, পিকু, অনিক, সপ্তক। আর গন্তব্যে পৌঁছানোর দায়িত্বে আছে ফরহাদ। দয়ামির বাজার, গোয়ালা বাজার পেরিয়ে এগিয়ে চলছি। ঘণ্টা দু-একের মধ্যে আমরা এসে পৌঁছালাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বারে। টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম ভেতর পানে পদব্রজে। প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দেখা পেলাম আকাশছোঁয়া সব গাছের সারি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে চলছে সূর্য দেবের লুকোচুরি খেলা। আমরা চলছি এগিয়ে, পথে পাখিদের কিচিরমিচির অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি করল। উঁচু-নিচু টিলাজুড়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গঠন। পাহাড়ি টিলার মধ্য দিয়ে এ বনে চলার পথ। উদ্যানের ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি ছড়া। আমরা দেখা পেলাম তেমনি একটি ছড়ার। আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম, কিছু দূর চলার পরে দেখা পেলাম ঢাকা-সিলেট রেলপথ। এরপরই মূলত জঙ্গলের শুরু। আমরা রেলপথের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। দেখা পেলাম অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজসহ কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্রের শুটিং স্পট। আমরা মূল সড়ক ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করলাম। সাইরেনের মতো এক ধরনের শব্দ কানে আসছিল। আমাদের কনিষ্ঠ ভ্রমণসঙ্গী সপ্তক জানতে চাইল, এটি কিসের শব্দ। আমি বললাম, এটি এ বনে থাকা ঝিঁঝি পোকার ডাক। উদ্যানে বেড়ানোর তিনটি পথ দেখতে পেলাম আমরা। উদ্যানের ভেতরে একটি খাসিয়াপল্লি আছে। প্রথম পথটির শুরু রেললাইন পেরিয়ে হাতের বাঁ দিক থেকে। পথের শুরুতে উঁচু গাছগুলোতে দেখা মিলতে পারে কুলু বানরের। নানা রকম গাছগাছালির ভেতর দিয়ে তৈরি করা এ পথে চলতে চলতে জঙ্গলের নির্জনতায় শিহরিত হবেন যে কেউ। নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে চলতে এই পথ শেষ হবে ঠিক শুরুর স্থানে। আর এক ঘণ্টার পথ হেঁটে একটু ভেতরে গেলে শুরুতেই চোখে পড়বে বিশাল গন্ধ রুই, ঝাওয়া, জগডুমুর, কাঁঠালিচাঁপা, লেহা প্রভৃতি গাছ।


পথের পাশে থাকা ডুমুরগাছের ফল খেতে আসে উল্লুক, বানর ও হনুমান ছাড়াও বনের বাসিন্দা আরও অনেক বন্য প্রাণী। ঘুরতে ঘুরতে আমরা একসময় পৌঁছে গেলাম খাসিয়াদের বসতি মাগুরছড়া পুঞ্জি। এ পুঞ্জির বাসিন্দারা মূলত পান চাষ করে থাকে। ১৯৫০ সালের দিকে বন বিভাগ এ পুঞ্জি তৈরি করে। এসব আমরা জানতে পারলাম পার্কের মধ্যে থাকা তথ্যকেন্দ্র থেকে। পথেই দেখা মিলল বিশাল বাঁশবাগান। এখানে নানা ধরনের বানরের খেলা দেখে মজা পাবে যেকোনো পর্যটক। পথের শেষে দেখতে পেলাম বনের অন্যতম আকর্ষণ উল্লুক পরিবারের। এরা বনের সবচেয়ে উঁচু গাছগুলোতে দলবদ্ধভাবে বাস করে।
এই বন এতই ঘন যে মাটিতে সূর্যের আলো পড়ে না বললেই চলে। প্রকৃতির সব সৌন্দর্য উপভোগ করে আমরা ফিরলাম আগের পথেই।

কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যেতে ট্রেন হচ্ছে সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। ঢাকা থেকে ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল যেতে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন হতে উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত অথবা কালনী এক্সপ্রেসকে বেছে নিতে পারেন। শ্রেণিভেদে জনপ্রতি ট্রেন ভাড়া ২৬৫ থেকে ১০০০ টাকা। ট্রেনে যেতে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। বাসে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে ফকিরাপুল অথবা সায়েদাবাদ থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ভাড়ায় নন-এসি বাস পাওয়া যায়। বাসে যেতে সময় লাগে চার ঘণ্টার মতো। শ্রীমঙ্গল পৌঁছে সেখান থেকে আপনার চাহিদা অনুযায়ী কোনো গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন লাউয়াছড়া উদ্যানে। ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, জিপ, মাইক্রোবাস যেকোনো কিছুতেই যাওয়া যায়। যাওয়া-আসা ও সেখানে ঘুরে বেড়ানোর সময়সহ রিজার্ভ নিলে সিএনজি ৪০০-৫০০ টাকা নেবে। আর আপনি চাইলে দিনে এসে দিনেই ফিরে যেতে পারবেন লাউয়াছড়া উদ্যানে থেকে। আর থাকতে চাইলে শ্রীমঙ্গল শহরে গিয়ে থাকতে হবে।