০৫:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

১৫ আগষ্ট হোক সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকার

”মুজিব তুমি জন্মেছিলে বলে
জন্মেছে এই দেশ
মুজিব তোমার আরেক নাম
স্বাধীন বাংলাদেশ।”

প্রথমেই আমি বিনম্র চিত্তে, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুব রহমানকে । ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস, বাঙালী জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন, এক বিয়োগান্তক দিন। ১৫ আগষ্টের এই হত্যা শুধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুব রহমানকে হত্যা নয়, এ হত্যা শুধু তার পরিবারকে হত্যা নয় । এ হত্যা একটি আদর্শকে হত্যা, এ হত্যা একটি শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে হত্যা, এ হত্যা সোনার বাংলা বিনির্মানের স্বপ্নকে হত্যা । যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন এবং শ্মসানে পরিণত হওয়া একটি দেশ যখন বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে প্রায় শূণ্য অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল,স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যখন সদ্য স্বাধীন একটি দেশ সারা বিশ্বে মর্যাদাশীল জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছিল ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রæ এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের স্বীকার হয়ে তাদেরই এদেশীয় দোসরদের হতে নির্মম ভাবে নিহিত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুব রহমান । রচিত হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়, রক্তাক্ত ১৫ আগষ্ট, এক শোক গাঁথা,এক নিরন্তর রক্তক্ষরণের দিন ।

একটা জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি,গৌরবের ধন এবং অহংকার হচ্ছে তার স্বাধীনতা । স্বাধীনতা কোন অকস্মাৎ ঘটনা নয়, দীর্ঘস্থায়ী স্বপ্ন,পরিকল্পনা আর সংগ্রামের পথ ধরেই আসে স্বাধীনতা। আর যার হাত ধরে, যার নেতৃত্বে আসে এই স্বাধীনতা সে হয় জাতির জনক । একটি জাতির জীবনে এই স্বাধীনতা, এই মুক্তি একদিনে আসেনা, তারজন্য পাড়ি দিতে হয় সুদীর্ঘ পথ । সে পথ কুসুমাস্তির্ণ নয়, সে পথ বন্ধুর, সে পথ কন্টকাকীর্ণ । সে পথে রয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই । না পাওয়ার বঞ্চনা আর শোষণ-নিপিড়ন যখন একটা জাতির জীবনে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তখনই সে জাতীর জীবনে স্বাধীনতার বীজ বপিত হয় । আর এই শোষণ ও বঞ্চনা যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে তখন সে জাতির স্বাধীনতার আকাংখাও প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে । এমনই সন্ধিক্ষণে কোন সুযোগ্য নেতা তার কেরেসমেটিক লিডারশিপ দ্বারা সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখান । বাঙালী জাতির স্বাধীনতার সেই স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তাই তো তিনি জাতির জনক, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাইতো কবি অন্নদা শংকর রায় বলেছেনÑ

যতকাল রবে পদ্মা-যমুনা-গৌরী-মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান ।

কবি জসীম উদ্দিনের ভাষায়—-
মুজিবুর রহমান !
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান ।

অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর অসীম সাহসিকতার জন্য কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি। শেখ মুজিবকে দেখলাম। ব্যক্তিত্ব আর সাহসে মানুষটি হিমালয়। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম । জসীম উদ্দিন তার ‘বঙ্গবন্ধু̕ কবিতায় যথার্থই বলেছেন——-

রাজভয় আর কারাশৃঙ্খল হেলায় করেছ জয়,
ফাঁসির মঞ্চে মহত্ত¡ তব কখনো হয়নি ক্ষয়।
বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূর্ত রাজ,
প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।

একটু পিছনে ফিরে তাকানো যাক । আমরা সবাই জানি ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় । ব্রিটিশদের হাতে অনেক শোষণ-বঞ্চনা আর সীমাহীন নিস্পেষণের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয় । অনেক স্বপ্ন ছিল, অনেক আশা ছিল কিন্তু অল্প দিনেই সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল, চরমভাবে আশাহত হলাম আমরা। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ আর বঞ্চনার মাত্রা যেন ব্রিটিশদেরকেও ছাড়িয়ে গেল। প্রথমেই আঘাত আসে ভাষার উপর । ঘোষণা করা হয়, “টৎফড় ধহফ টৎফড় ংযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ” । সাথে সাথেই প্রতিবাদ, আর প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ । রাজপথে বুকের তাজারক্ত ঢেলে মাতৃভাষাকে রক্ষা করলো এদেশের তরুণ প্রাণ । পূর্ব পাকিস্তানের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দ্বারা উন্নত হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তান । এক হিসাবমতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বাজেটের ৬৪ শতাংশ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে আর মাত্র ৩৬ শতাংশ ব্যয় হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানে । ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে । শুরু হলো স্বাধীকার আন্দোলন । ̕৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন। ’৬৬ তে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন তার ঐতিহাসিক ৬ দফা, দাবি উঠলো সায়ত্ত¡শাসনের । জুলুম নির্যাতন আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা, ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে আইযুব খানের পতন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তর না করার গভীর ষড়যন্ত্র । অবশেষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাসন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । সবশেষে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটল এক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ । আমরা পেলাম এক নুতন পতাকা, আমরা পেলাম স্বাধীনতা। পলাশীর পান্তরে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আবার সেই স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়।

স্বাধীনতা মানে কি ? আভিধানিক অর্থে স্বাধীনতা মানে মুক্তি,বাঁধাহীনতা । আবার সীমাহীন আনন্দ সম্ভার উপভোগই স্বাধীনতা, আর মর্তের মানুষের পরম পাওয়া এই স্বাধীনতা অর্থাৎ স্বকীয়তার আনন্দময় উত্তোরণ । স্বাধীনতা মানে একটা জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি । কিন্তু বর্তমানের এই অস্থিরতাপূর্ণ সমাজে আমরা কি স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারছি ! যে লক্ষ্য আর স্বপ্নকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করেছিল, সে লক্ষ্য আর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে আমরা আজ উ™£ান্ত,আমরা আজ দিশেহরা। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করাই যেন কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। আমরা কি এই সমাজ চেয়েছিলাম ! মুক্তিযোদ্ধারা কি এই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য দেশকে স্বাধীন করেছিল ! যে সমাজে শিক্ষকরা যথাযোগ্য মর্যাদা পায়না, আর গুণীজনেরা থাকে উপেক্ষিত । যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, যে সমাজে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে, যে সমাজ থেকে নৈতিকতা আর মূল্যবোধ প্রায় নির্বাসিত । যে সমাজে অবক্ষয় অপ্রতিরোধ্য,যে সমাজে সন্ত্রাস আসন গেড়ে বসেছে আর অর্থনীতি লুটেরাদের দখলে । যে সমাজে সততা বোকামীর পরিচায়ক, যে সমাজ নীতির কথা শুনে উপহাস করে । যে সমাজে ধনী আর দরিদ্রের বৈষম্য আকাশচুম্বি, যে সমাজ বিত্ত আর বৈভবের মোহে অন্ধ, যে সমাজে ন্যায়-অন্যায় আর ভাল-মন্দের বিচার করা হয় অর্থের তুলাদন্ডে । না কখনই না, আমরা এমন সমাজ চাইনি । আমারা চেয়ে ছিলাম সোনার বাংলা, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা । সোনার বাংলা মানে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, শোষণ আর বঞ্চনাহীন বাংলাদেশ । সোনার বাংলা মানে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ । সোনার বাংলা মানে অসাম্প্রদায়িক বংলাদেশ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ । সোনার বাংলা মানে দুঃখী মানুষের মুখে হাসির বাংলাদেশ । শেখ ফজলল করীমের ভাষায়—

“প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়েঘরে ।”
যে দিন সত্যিকার ভাবেই এই দেশ সোনার বাংলা হয়ে উঠবে, সেদিন ১৫ আগষ্টের অনুষ্ঠান পালনের যথার্থতা প্রমাণিত হবে, জাতির জনকের আত্মা শান্তি পাবে এবং তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জনানো যথার্থ হবে ।
আমি হতাশাবাদীদের দলে নই, ও ধস হড়ঃ ঢ়বংংরসরংঃ । ও ধস াবৎু সঁপয ড়ঢ়ঃরসরংঃ, আমি আশাবাদী । আমি বিশ্বাস করি আমরা যদি প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সচেতন হই, সচেষ্ট হই, সৎ হই এবং দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করি তাহলে বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবেলা করেই বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে, সোনার বাংলার পথে এগিয়ে যাবে, আসবে বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত অর্থনৈতিক মুক্তি আর হাসি ফুটবে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে। আপনারা জানেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধিতে অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে । আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের এই বিস্বয়কর উত্থানে সমগ্র বিশ্ব চক্ষুবিস্ফোরিত নেত্রে দেখছে, ডযধঃ রং ইধহমষধফবংয ফড়রহম ? ইধহমষধফবংয রং ফড়রহম সরৎধপষব । প্রত্যাশা করা হচ্ছে উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতায় আমরা মধ্যম আয়ের দেশ অতিক্রম করে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে সামিল হবো ইনশাল্লাহ । বর্তমানে কোভিট-১৯ এর কালো থাবায় অর্থনীতি কিছুটা বিপর্যস্ত হলেও প্রত্যাশা করছি অল্প সময়ের মধ্যে এ আঁধার কেটে উন্নয়নের চাকা আবার গতিশীল হয়ে উঠবে। তবে উন্নয়নকে দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই করতে হলে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিকট উন্নয়নের সুফল পৌছাতে হলে আমাদেরকে কিছু কিছু জায়গায় দ্রæত উন্নতি করতে হবে, আমাদেরকে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে, দুর্নীতি হ্রাস করতে হবে, মাদকের সর্বনাশী ছোবল থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে হবে, প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে ,সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সর্বোপরি সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে । তাহলেই বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি ফুটবে এবং আমরা সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে এক আত্মমর্যাদাশীল উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব । আর সেদিনই পূরণ হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন ।

লেখক: খালেদ মাহবুব মোর্শেদ, উপমহাব্যবস্থাপক,বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রেসিডেন্ট, রোটারী ক্লাব অব গাজীপুর ।

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

১৫ আগষ্ট হোক সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকার

প্রকাশিত : ০৫:৩৯:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২১

”মুজিব তুমি জন্মেছিলে বলে
জন্মেছে এই দেশ
মুজিব তোমার আরেক নাম
স্বাধীন বাংলাদেশ।”

প্রথমেই আমি বিনম্র চিত্তে, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুব রহমানকে । ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস, বাঙালী জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন, এক বিয়োগান্তক দিন। ১৫ আগষ্টের এই হত্যা শুধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুব রহমানকে হত্যা নয়, এ হত্যা শুধু তার পরিবারকে হত্যা নয় । এ হত্যা একটি আদর্শকে হত্যা, এ হত্যা একটি শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে হত্যা, এ হত্যা সোনার বাংলা বিনির্মানের স্বপ্নকে হত্যা । যুদ্ধ বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন এবং শ্মসানে পরিণত হওয়া একটি দেশ যখন বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে প্রায় শূণ্য অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল,স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যখন সদ্য স্বাধীন একটি দেশ সারা বিশ্বে মর্যাদাশীল জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছিল ঠিক তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রæ এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের স্বীকার হয়ে তাদেরই এদেশীয় দোসরদের হতে নির্মম ভাবে নিহিত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুব রহমান । রচিত হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়, রক্তাক্ত ১৫ আগষ্ট, এক শোক গাঁথা,এক নিরন্তর রক্তক্ষরণের দিন ।

একটা জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি,গৌরবের ধন এবং অহংকার হচ্ছে তার স্বাধীনতা । স্বাধীনতা কোন অকস্মাৎ ঘটনা নয়, দীর্ঘস্থায়ী স্বপ্ন,পরিকল্পনা আর সংগ্রামের পথ ধরেই আসে স্বাধীনতা। আর যার হাত ধরে, যার নেতৃত্বে আসে এই স্বাধীনতা সে হয় জাতির জনক । একটি জাতির জীবনে এই স্বাধীনতা, এই মুক্তি একদিনে আসেনা, তারজন্য পাড়ি দিতে হয় সুদীর্ঘ পথ । সে পথ কুসুমাস্তির্ণ নয়, সে পথ বন্ধুর, সে পথ কন্টকাকীর্ণ । সে পথে রয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই । না পাওয়ার বঞ্চনা আর শোষণ-নিপিড়ন যখন একটা জাতির জীবনে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তখনই সে জাতীর জীবনে স্বাধীনতার বীজ বপিত হয় । আর এই শোষণ ও বঞ্চনা যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে তখন সে জাতির স্বাধীনতার আকাংখাও প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে । এমনই সন্ধিক্ষণে কোন সুযোগ্য নেতা তার কেরেসমেটিক লিডারশিপ দ্বারা সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখান । বাঙালী জাতির স্বাধীনতার সেই স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তাই তো তিনি জাতির জনক, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাইতো কবি অন্নদা শংকর রায় বলেছেনÑ

যতকাল রবে পদ্মা-যমুনা-গৌরী-মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান ।

কবি জসীম উদ্দিনের ভাষায়—-
মুজিবুর রহমান !
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান ।

অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর অসীম সাহসিকতার জন্য কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়ের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি। শেখ মুজিবকে দেখলাম। ব্যক্তিত্ব আর সাহসে মানুষটি হিমালয়। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম । জসীম উদ্দিন তার ‘বঙ্গবন্ধু̕ কবিতায় যথার্থই বলেছেন——-

রাজভয় আর কারাশৃঙ্খল হেলায় করেছ জয়,
ফাঁসির মঞ্চে মহত্ত¡ তব কখনো হয়নি ক্ষয়।
বাংলাদেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রমূর্ত রাজ,
প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত-তাজ।

একটু পিছনে ফিরে তাকানো যাক । আমরা সবাই জানি ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় । ব্রিটিশদের হাতে অনেক শোষণ-বঞ্চনা আর সীমাহীন নিস্পেষণের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট দ্বি-জাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয় । অনেক স্বপ্ন ছিল, অনেক আশা ছিল কিন্তু অল্প দিনেই সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল, চরমভাবে আশাহত হলাম আমরা। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণ আর বঞ্চনার মাত্রা যেন ব্রিটিশদেরকেও ছাড়িয়ে গেল। প্রথমেই আঘাত আসে ভাষার উপর । ঘোষণা করা হয়, “টৎফড় ধহফ টৎফড় ংযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ” । সাথে সাথেই প্রতিবাদ, আর প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ । রাজপথে বুকের তাজারক্ত ঢেলে মাতৃভাষাকে রক্ষা করলো এদেশের তরুণ প্রাণ । পূর্ব পাকিস্তানের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দ্বারা উন্নত হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তান । এক হিসাবমতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বাজেটের ৬৪ শতাংশ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে আর মাত্র ৩৬ শতাংশ ব্যয় হতো সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানে । ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে । শুরু হলো স্বাধীকার আন্দোলন । ̕৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন। ’৬৬ তে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন তার ঐতিহাসিক ৬ দফা, দাবি উঠলো সায়ত্ত¡শাসনের । জুলুম নির্যাতন আর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা, ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে আইযুব খানের পতন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ক্ষমতা হস্তান্তর না করার গভীর ষড়যন্ত্র । অবশেষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাসন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । সবশেষে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটল এক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ । আমরা পেলাম এক নুতন পতাকা, আমরা পেলাম স্বাধীনতা। পলাশীর পান্তরে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আবার সেই স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়।

স্বাধীনতা মানে কি ? আভিধানিক অর্থে স্বাধীনতা মানে মুক্তি,বাঁধাহীনতা । আবার সীমাহীন আনন্দ সম্ভার উপভোগই স্বাধীনতা, আর মর্তের মানুষের পরম পাওয়া এই স্বাধীনতা অর্থাৎ স্বকীয়তার আনন্দময় উত্তোরণ । স্বাধীনতা মানে একটা জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি । কিন্তু বর্তমানের এই অস্থিরতাপূর্ণ সমাজে আমরা কি স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারছি ! যে লক্ষ্য আর স্বপ্নকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করেছিল, সে লক্ষ্য আর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে আমরা আজ উ™£ান্ত,আমরা আজ দিশেহরা। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করাই যেন কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। আমরা কি এই সমাজ চেয়েছিলাম ! মুক্তিযোদ্ধারা কি এই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য দেশকে স্বাধীন করেছিল ! যে সমাজে শিক্ষকরা যথাযোগ্য মর্যাদা পায়না, আর গুণীজনেরা থাকে উপেক্ষিত । যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, যে সমাজে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে, যে সমাজ থেকে নৈতিকতা আর মূল্যবোধ প্রায় নির্বাসিত । যে সমাজে অবক্ষয় অপ্রতিরোধ্য,যে সমাজে সন্ত্রাস আসন গেড়ে বসেছে আর অর্থনীতি লুটেরাদের দখলে । যে সমাজে সততা বোকামীর পরিচায়ক, যে সমাজ নীতির কথা শুনে উপহাস করে । যে সমাজে ধনী আর দরিদ্রের বৈষম্য আকাশচুম্বি, যে সমাজ বিত্ত আর বৈভবের মোহে অন্ধ, যে সমাজে ন্যায়-অন্যায় আর ভাল-মন্দের বিচার করা হয় অর্থের তুলাদন্ডে । না কখনই না, আমরা এমন সমাজ চাইনি । আমারা চেয়ে ছিলাম সোনার বাংলা, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা । সোনার বাংলা মানে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ, শোষণ আর বঞ্চনাহীন বাংলাদেশ । সোনার বাংলা মানে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ । সোনার বাংলা মানে অসাম্প্রদায়িক বংলাদেশ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ । সোনার বাংলা মানে দুঃখী মানুষের মুখে হাসির বাংলাদেশ । শেখ ফজলল করীমের ভাষায়—

“প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়েঘরে ।”
যে দিন সত্যিকার ভাবেই এই দেশ সোনার বাংলা হয়ে উঠবে, সেদিন ১৫ আগষ্টের অনুষ্ঠান পালনের যথার্থতা প্রমাণিত হবে, জাতির জনকের আত্মা শান্তি পাবে এবং তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জনানো যথার্থ হবে ।
আমি হতাশাবাদীদের দলে নই, ও ধস হড়ঃ ঢ়বংংরসরংঃ । ও ধস াবৎু সঁপয ড়ঢ়ঃরসরংঃ, আমি আশাবাদী । আমি বিশ্বাস করি আমরা যদি প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে সচেতন হই, সচেষ্ট হই, সৎ হই এবং দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করি তাহলে বর্তমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবেলা করেই বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে, সোনার বাংলার পথে এগিয়ে যাবে, আসবে বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত অর্থনৈতিক মুক্তি আর হাসি ফুটবে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে। আপনারা জানেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধিতে অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে । আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের এই বিস্বয়কর উত্থানে সমগ্র বিশ্ব চক্ষুবিস্ফোরিত নেত্রে দেখছে, ডযধঃ রং ইধহমষধফবংয ফড়রহম ? ইধহমষধফবংয রং ফড়রহম সরৎধপষব । প্রত্যাশা করা হচ্ছে উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতায় আমরা মধ্যম আয়ের দেশ অতিক্রম করে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে সামিল হবো ইনশাল্লাহ । বর্তমানে কোভিট-১৯ এর কালো থাবায় অর্থনীতি কিছুটা বিপর্যস্ত হলেও প্রত্যাশা করছি অল্প সময়ের মধ্যে এ আঁধার কেটে উন্নয়নের চাকা আবার গতিশীল হয়ে উঠবে। তবে উন্নয়নকে দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই করতে হলে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিকট উন্নয়নের সুফল পৌছাতে হলে আমাদেরকে কিছু কিছু জায়গায় দ্রæত উন্নতি করতে হবে, আমাদেরকে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে, দুর্নীতি হ্রাস করতে হবে, মাদকের সর্বনাশী ছোবল থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করতে হবে, প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে ,সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সর্বোপরি সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে হবে । তাহলেই বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি ফুটবে এবং আমরা সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে এক আত্মমর্যাদাশীল উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব । আর সেদিনই পূরণ হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন ।

লেখক: খালেদ মাহবুব মোর্শেদ, উপমহাব্যবস্থাপক,বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রেসিডেন্ট, রোটারী ক্লাব অব গাজীপুর ।

বিজনেস বাংলাদেশ/বিএইচ