আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্মদিন আজ। ১৯৪৭ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার নিভৃত পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছার জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা। ডিজিটাল ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রবক্তা স্বপ্নদর্শী এই নেত্রী ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দলকে সুসংগঠিত করেন এবং ১৯৯৬ সালে প্রথম ও ২০০৮ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে দলকে দেশের নেতৃত্বের আসনে বসাতে সক্ষম হন।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবু সাফল্য সহজ ছিল না। রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ যাত্রায় পার করেছেন নানা চড়াই-উতরাই। কারাভোগ করেছেন, একাধিকবার গৃহবন্দী ছিলেন। চারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। প্রায় তিন দশক ধরে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাঙালির প্রাণের নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নিভে গিয়েছিল সম্ভাবনার অনন্ত দুয়ার। কিন্তু কে জানতো বঙ্গবন্ধু ঠিক রেখে গেছেন তার যোগ্য উত্তরসূরি। ১৯৭৫ এর সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
কিন্তু ঘাতকদের ষড়যন্ত্র আর অনিরাপত্তার কারণে পরিবারের সবাইকে হারানোর পরও দীর্ঘ ৬ বছর দেশে ফিরতে পারেননি তারা। কিন্তু আওয়ামী লীগ তখনও চেনা ভঙ্গিমায়। অল্প সময়ের মধ্যেই নেতা-কর্মীরা চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। নতুন করে দেশ গড়ার স্বপ্নে বলীয়ান হয়ে ওঠেন। তখন শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই নেতা-কর্মীরা কাউন্সিলের মাধ্যমে তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করেন। ১৯৯৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে।
প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮ সালে দ্বিতীয়, ২০১৪ সালে তৃতীয় ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসএসসি পাস করেন ঢাকার আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে। এরপর ভর্তি হন তৎকালীন ইন্টারমিডিয়েট গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজে (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়)।
স্নাতক পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কারাবন্দী পিতার আগ্রহে ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হয়। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্ম নেন তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
পিতামাতা হারা নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত অবস্থায় জনগণের ডাকে বাংলাদেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, মানবিক মানুষ, বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। দেশে এসেই আওয়ামী লীগ সংগঠিত করার কাজে মনোঃসংযোগ ঘটান। হতাশাগ্রস্ত কর্মীদের উজ্জীবিত করেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য দেশব্যাপী সফর শুরু করে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
তিনি ফিরেছিলেন বলেই পাল্টে গেছে বাংলাদেশের গতিপথ। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের রাজনীতিতে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে সাধারণ মানুষের দাবি দাওয়া আদায়ে বরাবরের মতোই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গণমানুষের দল হিসেবে তৃণমূল হতে শুরু করে জাতীয় পর্যায়েও সুদৃঢ় অবস্থান ধরে রেখেছে দলটি। আমাদের গৌরবের ইতিহাস মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে।
পাশাপাশি ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনে দলটির দায়িত্বশীল ও সংগ্রামী ভূমিকা মুক্তিকামী মানুষদের অনুপ্রেরণা হয়ে আন্দোলিত করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও যৌক্তিক দাবি আদায়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
স্বৈরতন্ত্রের বিলুপ্তিসহ যুদ্ধাপরাধের বিচার ও অন্যান্য প্রত্যেকটি ইতিবাচক আন্দোলন সংগ্রামের প্রথম সারিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যথোপযুক্ত ভূমিকা জনগণের নিকট নিজেদের সঠিক অবস্থান তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বাঙালির ইতিহাস, বাংলার সংস্কৃতি ও সভ্যতা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় দলটি সৃষ্টিলগ্ন থেকেই নৈপুণ্য দেখিয়েছে। বর্তমান সময়েও ছিটমহলের সুরাহাকরণ, সমুদ্র বিজয় ইত্যাদি অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের নিকট দল হিসেবে যৌক্তিকতা দেখিয়ে চলেছে।
অন্য দলের তুলনায় আওয়ামী লীগের পার্থক্য ও দূরদর্শিতার স্পষ্ট ছাপও রাখতে সক্ষম হয়েছে দলটি। তবে শেখ হাসিনার এ পথ মসৃণ ছিল না, কন্টকাকীর্ণ পথকে মাড়িয়েই তিনি আজকের অবস্থানে এসেছেন। অসংখ্যবার আক্রমণ হয়েছে তার ওপর, মৌলবাদী গোষ্ঠী শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিতে সোচ্চার এখনো। তদুপরি তিনি নিরলস সংগ্রাম করে চলেছেন দেশের জন্য।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস হামলা সংঘটিত হয়েছিল খুনি চক্রদের মদদে। মূলত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই মৌলবাদীদের স্বার্থ রক্ষা হয়। কিন্তু সেদিন সৃষ্টিকর্তার মহিমায় বেঁচে যান রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা যে মানবঢাল তৈরি করেছিলেন সেটিও বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ইতিহাস।
মানবিক মানুষ হিসেবে শেখ হাসিনা উপমহাদেশীয় তথা বৈশ্বিক রাজনীতিতে অনন্য। সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বে তিনি মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অন্য কোন রাষ্ট্রপ্রধান কি সহসাই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন? এখানেই শেখ হাসিনা অনন্য। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনাকে মাদার অব হিউম্যানিটি পদকে ভূষিত করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকার কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমারের সরকারকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানোর ব্যাপারেও তৎপর।
২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পরে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার বিচক্ষণ ও সাহসী সিদ্ধান্তে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে অগ্রগতির সোপানে পা ফেলেছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের অনেকগুলো সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর থেকে অনেকাংশে এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে ব্যাপকভাবে আশার সঞ্চার করেছে, বাংলাদেশকে অণুসরণ করছে বহির্বিশ্ব।
বর্তমান সরকারের গ্রহণীয় উদ্যোগ বিশেষ করে মেগা প্রকল্পের তড়িৎ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীল বিশ্বে কর্মদক্ষতার গুণে আলাদা বিশেষত্ব অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক তাদের সংযুক্তি প্রত্যাহার করে নেয় পদ্মা সেতু থেকে। দৃঢ়চিত্তের অধিকারী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নিজেদের টাকায় করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পদ্মা সেতু এখন আর কল্পনা নয়, বাস্তবে প্রতিফলিত হতে চলেছে, ইতিমধ্যে সেতুর উন্নয়ন কাজের ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিভিন্ন জায়গায় বিচার সালিশের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। তাছাড়া, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য কোন অর্থ ছাড় দেয়নি বিশ্বব্যাংক। তদুপরি দুর্নীতির অভিযোগ করাটা কোনভাবেই মানানসই ছিল না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমগ্র বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। একক কোনো ক্ষেত্র নয়-শিক্ষা,স্বাস্থ্য অর্থনীতি, অবকাঠামো, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, আইসিটিসহ সর্বক্ষেত্রেই শেখ হাসিনা রেখেছেন চূড়ান্ত সাফল্যের স্বাক্ষর।
করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ জাতিসংঘ, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে তিনি নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং করোনা মহামারির বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি জীবিকা ও অর্থনীতি বাঁচাতে নিয়েছেন কার্যকরী পদক্ষেপ। দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ধরে রাখতে কৃষি ও শিল্পসহ অর্থনৈতিক খাতগুলোতে সময়োপযোগী প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হয়।
এ কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ চলতি জাতিসংঘ সফরেও বিশ্ব নেতৃত্বের প্রশংসায় ভাসছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের মানুষ এবং এই দেশের উন্নয়নের জন্য হলেও শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু হওয়া দরকার। শুভ জন্মদিন প্রধানমন্ত্রী।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট