০৭:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

প্রাথমিক শিক্ষায় হাওরাঞ্চল: সমস্যা ও করণীয়

কিশোরগঞ্জ জেলার পূর্বদিকে বাংলাদেশের হাওর বেসিন এলাকার মাঝে অন্যতম উপজেলা অষ্টগ্রাম। ভাটির রাণী নামে খ্যাত অষ্টগ্রাম ও আশেপাশের মিঠামইন, ইটনা, নিকলী, নাসিরনগর, আজমিরীগঞ্জ, শাল্লা, খালিয়াজুড়ী ইত্যাদি উপজেলা বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকে। সুবিশাল হাওরের জলরাশির মাঝে দ্বীপ সদৃশ বাড়ি ঘর গুলোতে স্থবির হয়ে যায় জীবনের গতিশীলতা। জনমানুষের জীবনমান উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক উত্তরণ এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গঠন হল সরকারে অন্যতম অগ্রাধিকার খাত। সবার জন্য গুনগতমান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হল স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠন। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অভিপ্রায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের অন্যতম মাইলফলক হলো “লক্ষ্য-৪” বা “সবার জন্য গুণগত মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা”। তাছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম হল “শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি”। দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে হাওর এলাকায় শতভাগ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ অনেক কষ্টসাধ্য কাজ। এই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রথাগত ধ্যান-ধারণা, আর্থ সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি অনেক অনুঘটক গণমুখী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে বাধা হিসেবে কাজ করছে।

 

হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে নির্বাহী প্রধান হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাতের প্রচেষ্টা থেকেই এ লেখার অনুপ্রেরণা। অত্র অঞ্চলের কোমলমতি শিশুদের বিদ্যালয়ে আসার পথে প্রধান বাধা তাদের অভিভাবকদের অনিচ্ছা। অভিভাবকদেরকে তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার সুদূর প্রসারী ফলাফল সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত করতে পারলে তারা তাদের সন্তানদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হবে। সম্ভব হলে তাদেরকে দৃশ্যমান উদ্দীপকের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এই এলাকা থেকে যারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন সম্মানজনক অবস্থানে আছেন তাদের মাধ্যমে অভিভাবকগণকে উজ্জ্বীবিত করতে হবে। শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য তখনই আগ্রহী হয়, যখন বিদ্যালয়ে খেলার পরিবেশে তারা নতুন কিছু শিখতে পারে। শিক্ষক শুধু গুরুজন হিসেবেই নয়, শিশুদের সংস্পর্শে আসেন পরম হিতৈষী এবং বন্ধুবৎসল হিসেবে। তাই শিক্ষার হার উন্নীতকরণে প্রয়োজন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং শিক্ষা গ্রহণের সার্বিক পরিবেশ রূপান্তর। প্রয়োজন শিক্ষকদেরকে অভিনব উপায়ে শিশুদের শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রতিটি শিশুর চাহিদা ভিন্ন রূপে বুঝতে পারার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

 

হাওর এলাকায় শিশুদের শিক্ষায় প্রধান বাঁধা প্রাকৃতিক দূর্যোগে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি। তাই ঋতুর পরিবর্তনের সাথে শিক্ষায় যেন কোনো বাঁধা না আসে, সেজন্য তাদের প্রয়োজন সহজ ও বিকল্প যাতায়াতের ব্যবস্থা করা জরুরী। প্রয়োজনে উদ্যোগ নিতে হবে শিক্ষাকে তাদের দুয়ারে পৌছে দেয়ার। শিক্ষা শুধু জীবন গড়ার জন্যই নয়, মেধা-মনন-সত্ত্বাকে প্রভাবান্বিত করার জন্যও। আমাদের ইতিহাস, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ- এসকল আমাদের জাতিসত্ত্বার অংশ। এগুলোকে যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট যথাযথভাবে তুলে ধরা না যায়, তাহলে তারা কোনো দিনই জানবে না তাদের পূর্বপুরুষ কতটা আত্মত্যাগের দ্বারা তাদের জন্য স্বাধীন এই দেশ রেখে গিয়েছেন। ফলে তারা কোনো দিনই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ায় উদ্যম ও প্রত্যয় পাবে না। হাওরাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে তাই প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্বাধীনতার গৌরব স্পৃহা ছড়িয়ে দেয়া খুব জরুরি।

 

শিক্ষার্থীদের জন্য খেলনা সামগ্রী ও উপকরণ, সহজপাঠ্য বই, আহারের ব্যবস্থা, বৃত্তির ব্যবস্থা, শিক্ষা-উপকরণ, স্কুলের ইউনিফর্ম এসকলই শিক্ষার প্রকৃত বিকাশে অন্যতম উপাদান । শহর এলাকার বিদ্যাপীঠ সমূহের সাথে দূর্গম হাওর এলাকার বিদ্যালয় সমূহের শিক্ষার মান বৈষম্য একটি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। হাওর এলাকার উন্নয়ন বাস্তবায়নে গুণগত প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজন জনগণ, জনপ্রতিনিধি, সরকার, এনজিও, দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষক সহ সকল অংশীদারের সমানভাবে অংশগ্রহণ। কাউকে বাদ দিয়ে কারো প্রাধিকার এই ক্ষেত্রে তৈরি করে সুদূর প্রসারী ক্ষতিকর প্রভাবের। হাওরবাসীর উন্নয়নে বর্তমান সময়ে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন চিন্তাভাবনা-উদ্যোগ ও প্রয়াস অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সরকারের আন্তরিকতায় বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঝরে পড়ার হারও হ্রাস পাচ্ছে এবং শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিশেষে সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনে অষ্টগ্রাম তথা হাওরাঞ্চলের তরুণ প্রজন্ম অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি ।

 

 

      লেখক:

মো. হারুন-অর-রশিদ

উপজেলা নির্বাহী অফিসার

অষ্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

প্রাথমিক শিক্ষায় হাওরাঞ্চল: সমস্যা ও করণীয়

প্রকাশিত : ০৬:১৪:৫৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ মার্চ ২০২২

কিশোরগঞ্জ জেলার পূর্বদিকে বাংলাদেশের হাওর বেসিন এলাকার মাঝে অন্যতম উপজেলা অষ্টগ্রাম। ভাটির রাণী নামে খ্যাত অষ্টগ্রাম ও আশেপাশের মিঠামইন, ইটনা, নিকলী, নাসিরনগর, আজমিরীগঞ্জ, শাল্লা, খালিয়াজুড়ী ইত্যাদি উপজেলা বছরের অধিকাংশ সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকে। সুবিশাল হাওরের জলরাশির মাঝে দ্বীপ সদৃশ বাড়ি ঘর গুলোতে স্থবির হয়ে যায় জীবনের গতিশীলতা। জনমানুষের জীবনমান উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক উত্তরণ এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গঠন হল সরকারে অন্যতম অগ্রাধিকার খাত। সবার জন্য গুনগতমান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হল স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠন। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অভিপ্রায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের অন্যতম মাইলফলক হলো “লক্ষ্য-৪” বা “সবার জন্য গুণগত মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা”। তাছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম হল “শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি”। দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে হাওর এলাকায় শতভাগ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ অনেক কষ্টসাধ্য কাজ। এই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রথাগত ধ্যান-ধারণা, আর্থ সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি অনেক অনুঘটক গণমুখী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে বাধা হিসেবে কাজ করছে।

 

হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে নির্বাহী প্রধান হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাতের প্রচেষ্টা থেকেই এ লেখার অনুপ্রেরণা। অত্র অঞ্চলের কোমলমতি শিশুদের বিদ্যালয়ে আসার পথে প্রধান বাধা তাদের অভিভাবকদের অনিচ্ছা। অভিভাবকদেরকে তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার সুদূর প্রসারী ফলাফল সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত করতে পারলে তারা তাদের সন্তানদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হবে। সম্ভব হলে তাদেরকে দৃশ্যমান উদ্দীপকের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করতে হবে। এই এলাকা থেকে যারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন সম্মানজনক অবস্থানে আছেন তাদের মাধ্যমে অভিভাবকগণকে উজ্জ্বীবিত করতে হবে। শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য তখনই আগ্রহী হয়, যখন বিদ্যালয়ে খেলার পরিবেশে তারা নতুন কিছু শিখতে পারে। শিক্ষক শুধু গুরুজন হিসেবেই নয়, শিশুদের সংস্পর্শে আসেন পরম হিতৈষী এবং বন্ধুবৎসল হিসেবে। তাই শিক্ষার হার উন্নীতকরণে প্রয়োজন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং শিক্ষা গ্রহণের সার্বিক পরিবেশ রূপান্তর। প্রয়োজন শিক্ষকদেরকে অভিনব উপায়ে শিশুদের শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রতিটি শিশুর চাহিদা ভিন্ন রূপে বুঝতে পারার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

 

হাওর এলাকায় শিশুদের শিক্ষায় প্রধান বাঁধা প্রাকৃতিক দূর্যোগে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি। তাই ঋতুর পরিবর্তনের সাথে শিক্ষায় যেন কোনো বাঁধা না আসে, সেজন্য তাদের প্রয়োজন সহজ ও বিকল্প যাতায়াতের ব্যবস্থা করা জরুরী। প্রয়োজনে উদ্যোগ নিতে হবে শিক্ষাকে তাদের দুয়ারে পৌছে দেয়ার। শিক্ষা শুধু জীবন গড়ার জন্যই নয়, মেধা-মনন-সত্ত্বাকে প্রভাবান্বিত করার জন্যও। আমাদের ইতিহাস, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ- এসকল আমাদের জাতিসত্ত্বার অংশ। এগুলোকে যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট যথাযথভাবে তুলে ধরা না যায়, তাহলে তারা কোনো দিনই জানবে না তাদের পূর্বপুরুষ কতটা আত্মত্যাগের দ্বারা তাদের জন্য স্বাধীন এই দেশ রেখে গিয়েছেন। ফলে তারা কোনো দিনই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ায় উদ্যম ও প্রত্যয় পাবে না। হাওরাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে তাই প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্বাধীনতার গৌরব স্পৃহা ছড়িয়ে দেয়া খুব জরুরি।

 

শিক্ষার্থীদের জন্য খেলনা সামগ্রী ও উপকরণ, সহজপাঠ্য বই, আহারের ব্যবস্থা, বৃত্তির ব্যবস্থা, শিক্ষা-উপকরণ, স্কুলের ইউনিফর্ম এসকলই শিক্ষার প্রকৃত বিকাশে অন্যতম উপাদান । শহর এলাকার বিদ্যাপীঠ সমূহের সাথে দূর্গম হাওর এলাকার বিদ্যালয় সমূহের শিক্ষার মান বৈষম্য একটি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। হাওর এলাকার উন্নয়ন বাস্তবায়নে গুণগত প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে প্রয়োজন জনগণ, জনপ্রতিনিধি, সরকার, এনজিও, দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষক সহ সকল অংশীদারের সমানভাবে অংশগ্রহণ। কাউকে বাদ দিয়ে কারো প্রাধিকার এই ক্ষেত্রে তৈরি করে সুদূর প্রসারী ক্ষতিকর প্রভাবের। হাওরবাসীর উন্নয়নে বর্তমান সময়ে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন চিন্তাভাবনা-উদ্যোগ ও প্রয়াস অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সরকারের আন্তরিকতায় বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঝরে পড়ার হারও হ্রাস পাচ্ছে এবং শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিশেষে সুন্দর ভবিষ্যৎ গঠনে অষ্টগ্রাম তথা হাওরাঞ্চলের তরুণ প্রজন্ম অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি ।

 

 

      লেখক:

মো. হারুন-অর-রশিদ

উপজেলা নির্বাহী অফিসার

অষ্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ।