০৪:০৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪

সাত পণ্যেই আটকা রপ্তানি

দেশের অর্থনীতির টানাপোড়েনের সময়ও স্বস্তি দিয়েছে রপ্তানিখাত। বিদেশে পণ্য পাঠিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ৫২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ এনেছেন রপ্তানিকারকরা। গতবারের ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখে এবার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১৫ বিলিয়ন বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৬৭ বিলিয়ন ডলার। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েই এসেছে ধাক্কা। এ সময়ে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাকি ১১ মাসে গড়ে রপ্তানি করতে হবে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানিপণ্যে বৈচিত্র্য না আনতে পারলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মূলত ৩৪ ক্যাটাগরির পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে সাত পণ্য থেকেই এসেছে প্রায় ৯৪ শতাংশ রপ্তানি আয়। এককভাবে মোট রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাকখাত থেকে। যদিও আমাদের রপ্তানির তালিকায় সাত শতাধিক পণ্য রয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফাঁকা বুলি আওড়ালেও পণ্য বৈচিত্র্যকরণে নীতিনির্ধারকরা আন্তরিক নন। তৈরি পোশাকে বেশি নজর, পণ্যের বাজার ধরতে অনাগ্রহ, পণ্য প্রক্রিয়াকরণ ও জাহাজীকরণ, ট্যারিফ নীতিমালা প্রণয়ন না করাসহ একাধিক কারণে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে আগ্রহী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, তৈরি পোশাক, হোমটেক্সটাইল, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাতপণ্য, চামড়া ও চামড়াপণ্য এবং হালকা প্রকৌশল পণ্য- এই সাত ধরনের পণ্যেই মূলত আটকে আছে রপ্তানি। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে ওই আট পণ্য থেকে এসেছে চার হাজার ৯১০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের মতো ২০২০-২১ অর্থবছরেও ৮ পণ্য থেকে এসেছিল মোট রপ্তানির ৯৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ, একই অবস্থা ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরও। সে বছর ৯৫ শতাংশ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯৫ দশমিক ১৬ শতাংশ রপ্তানি আয় এসেছিল পণ্যগুলো থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে ৪২৬১ কোটি ডলার (৮১.৮১ শতাংশ), চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ১২৪ কোটি ডলার (২.৩৮ শতাংশ), কৃষিজাত পণ্য থেকে ১১৬ কোটি ডলার (২.২২ শতাংশ), পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ১১৩ কোটি ডলার (২.১৬ শতাংশ), হোম টেক্সটাইল থেকে ১৬২ কোটি (৩.১১ শতাংশ), হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ ৫৩ কোটি ডলার (০.৪৪ শতাংশ), হালকা প্রকৌশল পণ্য থেকে ৭৯ কোটি ডলার (১.৫১ শতাংশ)। সাত শতাধিক পণ্যের মধ্যে মাত্র সাতটিতে নির্ভরতার কারণ জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, তিন কারণে পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হচ্ছে না। দেশীয় বাজারভিত্তিক শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যে ধরনের নীতি আমরা গ্রহণ করেছি, তাতে হাই-ইমপোর্ট ট্যারিফ দিয়ে উদ্যোক্তাদের সুরক্ষিত করেছি। বিনিয়োগটা হয় লাভের ভিত্তিতে। এখন যদি আমরা দেখি আমাদের দেশীয় বাজারটাই সুরক্ষিত, সেক্ষেত্রে রপ্তানি, যেটা আন্তর্জাতিক বাজার নির্ভরশীল সেখানে অনিশ্চয়তা অনেক। সুরক্ষিত বাজারে লাভ বেশি, বিনিয়োগ-তো সেদিকেই যাবে। পোশাকখাতে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কর হার কম, বন্দরে তাদের অনেক সুবিধা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা ভর্তুকিও পান। এজন্য যারা রপ্তানিতে যেতে চান তারা তৈরি পোশাকই বেছে নেন। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সমস্যা আছে। আন্তর্জাতিক বাজার খুব সেনসিটিভ। হাইজিনিক স্ট্যান্ডার্ড মানা হচ্ছে কি না, কোয়ালিটি সার্টিফিকেশন যদি আন্তর্জাতিক মানের না হয় তাহলে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশনের কোনো উদ্যোগ বা রোডম্যাপও নেওয়া হয়নি। কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা এর প্রধান কাঁচামাল আমাদের দেশেই পাওয়া যায়। একই কথা চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও। কোয়ালিটির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন পেলে এসব পণ্যের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যার সমাধান হয়। তৃতীয় কারণ হলো মার্কেট অ্যাক্সেসের সুযোগ তৈরি করতে না পারা। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে হলে আমাদের বাণিজ্যচুক্তির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট হোক বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট। ভিয়েতনামের ১৬টি ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট আছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। আমাদের আছে একটি, ভুটানের সঙ্গে। বাজারে প্রবেশে আমরা এখনো সুবিধার জায়গায় আছি। ইউরোপের বাজারে আমরা এখনো ডিউটি-ফ্রি অ্যাকসেস পাচ্ছি। এখনো এলডিসির তালিকায় থাকার কারণে এই সুবিধাটা পাচ্ছি। এখান থেকে যখন উঠে যাবো তখন তো আমরা আর সুবিধাটা পাবো না। যেসব সমস্যার কথা বলছেন উদ্যোক্তারা: ইপিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০টির বেশি পণ্যে বেশ প্রবৃদ্ধি ছিল। তবে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। যার মধ্যে ফল, সবজি ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি করতে পারেনি। একই অবস্থা মসলা, চা এবং অন্যান্য পণ্যে। শুধু তামাকজাত পণ্যে ৭৮ দশমিক ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই তামাকই কৃষিজাত পণ্যকে টেনে নিয়ে গেছে। বিদেশের বাজারে শিম, লাউ, কুমড়া, পেঁপে, করলা, কচুরলতি, কাঁকরোল, বরবটি, চিচিঙ্গা, লালশাক, ডাঁটাশাক, ঝিঙ্গা, ধুন্দল, ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, লটকন, লিচুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এরপরও এসব পণ্য তেমন রপ্তানি হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লেনভাড়া বৃদ্ধি ও কার্গো স্পেসের সমস্যার কারণে গত অর্থবছর ভালো করতে পারেনি দেশের অ্যাগ্রো প্রসেসিং খাত। রপ্তানি বাড়াতে বিনিয়োগের পাশাপাশি এ খাতটির বিদ্যমান সমস্যা দূর করার কথা বলছেন তারা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এস এম জাহাঙ্গীর বলেন, কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার পরও আমরা মাত্র এক হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করি। উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। আমাদের প্রধান সমস্যা হলো উড়োজাহাজের জায়গা। যেহেতু পচনশীল পণ্য, আমাদের তা আকাশপথে পাঠাতে হয়। এক্ষেত্রে ভরসা করতে হয় বিদেশি উড়োজাহাজগুলোর ওপর। সম্প্রতি উড়োজাহাজের ভাড়া যেমন বেড়েছে, জায়গাও সংকুচিত হয়েছে। ফরেন এয়ারওয়েজে কার্গো স্পেস অনেক সময় অ্যাভেইলেবল থাকে না। দেখা যায় আমদানিকারকের চাহিদা আছে কিন্তু কার্গো স্পেস না পেলে তো রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তার মতে, উড়োজাহাজের অতিরিক্ত ভাড়া মেটানোয় পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বিশ্ববাজারে। ফলে ভারতীয়, লাতিন আমেরিকার দেশের ফল-সবজির কাছে মার খাচ্ছে দেশীয় কৃষিপণ্য। ১৪৫টির বেশি দেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। দেশের শীর্ষ শিল্পগ্রুপটি ২০৩০ সাল নাগাদ দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে চায়। বর্তমান সময়ের জ্বালানি ও ডলার সংকট থেকে উত্তরণে রপ্তানির আকার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেন, আমাদের দক্ষতায় ঘাটতি আছে। আমাদের পোর্টগুলো যত দ্রুত দক্ষ হাতে পরিচালিত হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যয় যত কমবে, ততই আমাদের রপ্তানি প্রসার লাভ করবে। উদ্যোক্তারদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, আমরা ভিয়েতনাম, জার্মানির মতোই পণ্য বা সেবা দিতে পারি। যে যেখানে আছি সবাই মিলে চেষ্টা করি, আমরা এগিয়ে যাবো। তবে পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে সরকার বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে বলে দাবি করেছেন ইপিবির পণ্য উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ শাহজালাল। তিনি বলেন, সরকারের ১৪টি সংস্থা রপ্তানিকারকদের বিভিন্ন সেবা দেয়। এখন পণ্য রপ্তানিতে কী ধরনের সমস্য, সংকট আছে সেগুলো চিহ্নিত করতে আমরা কাজ করছি। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে অংশীজনের সঙ্গে বসে সমাধানের কৌশল প্রণয়ন করা হবে। এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মুখে পণ্য বৈচিত্র্যকরণের কথা বললেও কাজের ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা অগ্রগতি দেখি না। বন্দরে ট্রেড লজিস্টিকসের সমস্যা বহুদিনের। রাজস্ব বোর্ড এক যুগ ধরে ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি নিয়ে কাজ করার কথা বলছে। রপ্তানিকারকদের জন্য ট্যারিফ যৌক্তিক করতে একটা কৌশলপত্র তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। বন্দরের ক্যাপাসিটি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পণ্য ওঠানামায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এতে তারা পিছিয়ে যাচ্ছেন।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

সাব এডিটরস কাউন্সিলের নতুন সভাপতি অনিক, সম্পাদক জাওহার

সাত পণ্যেই আটকা রপ্তানি

প্রকাশিত : ১২:০০:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ অগাস্ট ২০২২

দেশের অর্থনীতির টানাপোড়েনের সময়ও স্বস্তি দিয়েছে রপ্তানিখাত। বিদেশে পণ্য পাঠিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ৫২ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ এনেছেন রপ্তানিকারকরা। গতবারের ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখে এবার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১৫ বিলিয়ন বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৬৭ বিলিয়ন ডলার। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েই এসেছে ধাক্কা। এ সময়ে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাকি ১১ মাসে গড়ে রপ্তানি করতে হবে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানিপণ্যে বৈচিত্র্য না আনতে পারলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মূলত ৩৪ ক্যাটাগরির পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে সাত পণ্য থেকেই এসেছে প্রায় ৯৪ শতাংশ রপ্তানি আয়। এককভাবে মোট রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাকখাত থেকে। যদিও আমাদের রপ্তানির তালিকায় সাত শতাধিক পণ্য রয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফাঁকা বুলি আওড়ালেও পণ্য বৈচিত্র্যকরণে নীতিনির্ধারকরা আন্তরিক নন। তৈরি পোশাকে বেশি নজর, পণ্যের বাজার ধরতে অনাগ্রহ, পণ্য প্রক্রিয়াকরণ ও জাহাজীকরণ, ট্যারিফ নীতিমালা প্রণয়ন না করাসহ একাধিক কারণে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে আগ্রহী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, তৈরি পোশাক, হোমটেক্সটাইল, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাতপণ্য, চামড়া ও চামড়াপণ্য এবং হালকা প্রকৌশল পণ্য- এই সাত ধরনের পণ্যেই মূলত আটকে আছে রপ্তানি। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে ওই আট পণ্য থেকে এসেছে চার হাজার ৯১০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের মতো ২০২০-২১ অর্থবছরেও ৮ পণ্য থেকে এসেছিল মোট রপ্তানির ৯৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ, একই অবস্থা ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরও। সে বছর ৯৫ শতাংশ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯৫ দশমিক ১৬ শতাংশ রপ্তানি আয় এসেছিল পণ্যগুলো থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে ৪২৬১ কোটি ডলার (৮১.৮১ শতাংশ), চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ১২৪ কোটি ডলার (২.৩৮ শতাংশ), কৃষিজাত পণ্য থেকে ১১৬ কোটি ডলার (২.২২ শতাংশ), পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ১১৩ কোটি ডলার (২.১৬ শতাংশ), হোম টেক্সটাইল থেকে ১৬২ কোটি (৩.১১ শতাংশ), হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ ৫৩ কোটি ডলার (০.৪৪ শতাংশ), হালকা প্রকৌশল পণ্য থেকে ৭৯ কোটি ডলার (১.৫১ শতাংশ)। সাত শতাধিক পণ্যের মধ্যে মাত্র সাতটিতে নির্ভরতার কারণ জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, তিন কারণে পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হচ্ছে না। দেশীয় বাজারভিত্তিক শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যে ধরনের নীতি আমরা গ্রহণ করেছি, তাতে হাই-ইমপোর্ট ট্যারিফ দিয়ে উদ্যোক্তাদের সুরক্ষিত করেছি। বিনিয়োগটা হয় লাভের ভিত্তিতে। এখন যদি আমরা দেখি আমাদের দেশীয় বাজারটাই সুরক্ষিত, সেক্ষেত্রে রপ্তানি, যেটা আন্তর্জাতিক বাজার নির্ভরশীল সেখানে অনিশ্চয়তা অনেক। সুরক্ষিত বাজারে লাভ বেশি, বিনিয়োগ-তো সেদিকেই যাবে। পোশাকখাতে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কর হার কম, বন্দরে তাদের অনেক সুবিধা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা ভর্তুকিও পান। এজন্য যারা রপ্তানিতে যেতে চান তারা তৈরি পোশাকই বেছে নেন। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সমস্যা আছে। আন্তর্জাতিক বাজার খুব সেনসিটিভ। হাইজিনিক স্ট্যান্ডার্ড মানা হচ্ছে কি না, কোয়ালিটি সার্টিফিকেশন যদি আন্তর্জাতিক মানের না হয় তাহলে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশনের কোনো উদ্যোগ বা রোডম্যাপও নেওয়া হয়নি। কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা এর প্রধান কাঁচামাল আমাদের দেশেই পাওয়া যায়। একই কথা চামড়াজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও। কোয়ালিটির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন পেলে এসব পণ্যের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যার সমাধান হয়। তৃতীয় কারণ হলো মার্কেট অ্যাক্সেসের সুযোগ তৈরি করতে না পারা। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে হলে আমাদের বাণিজ্যচুক্তির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট হোক বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট। ভিয়েতনামের ১৬টি ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট আছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। আমাদের আছে একটি, ভুটানের সঙ্গে। বাজারে প্রবেশে আমরা এখনো সুবিধার জায়গায় আছি। ইউরোপের বাজারে আমরা এখনো ডিউটি-ফ্রি অ্যাকসেস পাচ্ছি। এখনো এলডিসির তালিকায় থাকার কারণে এই সুবিধাটা পাচ্ছি। এখান থেকে যখন উঠে যাবো তখন তো আমরা আর সুবিধাটা পাবো না। যেসব সমস্যার কথা বলছেন উদ্যোক্তারা: ইপিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০টির বেশি পণ্যে বেশ প্রবৃদ্ধি ছিল। তবে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ। যার মধ্যে ফল, সবজি ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি করতে পারেনি। একই অবস্থা মসলা, চা এবং অন্যান্য পণ্যে। শুধু তামাকজাত পণ্যে ৭৮ দশমিক ৬০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই তামাকই কৃষিজাত পণ্যকে টেনে নিয়ে গেছে। বিদেশের বাজারে শিম, লাউ, কুমড়া, পেঁপে, করলা, কচুরলতি, কাঁকরোল, বরবটি, চিচিঙ্গা, লালশাক, ডাঁটাশাক, ঝিঙ্গা, ধুন্দল, ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, লটকন, লিচুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এরপরও এসব পণ্য তেমন রপ্তানি হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লেনভাড়া বৃদ্ধি ও কার্গো স্পেসের সমস্যার কারণে গত অর্থবছর ভালো করতে পারেনি দেশের অ্যাগ্রো প্রসেসিং খাত। রপ্তানি বাড়াতে বিনিয়োগের পাশাপাশি এ খাতটির বিদ্যমান সমস্যা দূর করার কথা বলছেন তারা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এস এম জাহাঙ্গীর বলেন, কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ার পরও আমরা মাত্র এক হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করি। উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। আমাদের প্রধান সমস্যা হলো উড়োজাহাজের জায়গা। যেহেতু পচনশীল পণ্য, আমাদের তা আকাশপথে পাঠাতে হয়। এক্ষেত্রে ভরসা করতে হয় বিদেশি উড়োজাহাজগুলোর ওপর। সম্প্রতি উড়োজাহাজের ভাড়া যেমন বেড়েছে, জায়গাও সংকুচিত হয়েছে। ফরেন এয়ারওয়েজে কার্গো স্পেস অনেক সময় অ্যাভেইলেবল থাকে না। দেখা যায় আমদানিকারকের চাহিদা আছে কিন্তু কার্গো স্পেস না পেলে তো রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। তার মতে, উড়োজাহাজের অতিরিক্ত ভাড়া মেটানোয় পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বিশ্ববাজারে। ফলে ভারতীয়, লাতিন আমেরিকার দেশের ফল-সবজির কাছে মার খাচ্ছে দেশীয় কৃষিপণ্য। ১৪৫টির বেশি দেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। দেশের শীর্ষ শিল্পগ্রুপটি ২০৩০ সাল নাগাদ দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে চায়। বর্তমান সময়ের জ্বালানি ও ডলার সংকট থেকে উত্তরণে রপ্তানির আকার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী। তিনি বলেন, আমাদের দক্ষতায় ঘাটতি আছে। আমাদের পোর্টগুলো যত দ্রুত দক্ষ হাতে পরিচালিত হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যয় যত কমবে, ততই আমাদের রপ্তানি প্রসার লাভ করবে। উদ্যোক্তারদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, আমরা ভিয়েতনাম, জার্মানির মতোই পণ্য বা সেবা দিতে পারি। যে যেখানে আছি সবাই মিলে চেষ্টা করি, আমরা এগিয়ে যাবো। তবে পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে সরকার বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে বলে দাবি করেছেন ইপিবির পণ্য উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ শাহজালাল। তিনি বলেন, সরকারের ১৪টি সংস্থা রপ্তানিকারকদের বিভিন্ন সেবা দেয়। এখন পণ্য রপ্তানিতে কী ধরনের সমস্য, সংকট আছে সেগুলো চিহ্নিত করতে আমরা কাজ করছি। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে অংশীজনের সঙ্গে বসে সমাধানের কৌশল প্রণয়ন করা হবে। এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মুখে পণ্য বৈচিত্র্যকরণের কথা বললেও কাজের ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা অগ্রগতি দেখি না। বন্দরে ট্রেড লজিস্টিকসের সমস্যা বহুদিনের। রাজস্ব বোর্ড এক যুগ ধরে ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি নিয়ে কাজ করার কথা বলছে। রপ্তানিকারকদের জন্য ট্যারিফ যৌক্তিক করতে একটা কৌশলপত্র তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। বন্দরের ক্যাপাসিটি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পণ্য ওঠানামায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এতে তারা পিছিয়ে যাচ্ছেন।