০১:০২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন

শত শত মুসলিমকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে ভারত

সীমান্তের নো ম্যানস্ ল্যান্ডে ভারত থেকে বিতাড়িত একটি দল/ ছবি: বিবিসি

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারত কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই অবৈধভাবে দেশটি থেকে শত শত বাংলাভাষী মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। ভারতের দাবি, যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে তারা সবাই অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু তাদের এসব দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া এদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নাগরিক। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ নিয়ে এক বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসের ৭ তারিখ থেকে জুনের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ভারত দেড় হাজারেরও বেশি মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুকে বাংলাদেশে বিতাড়িত করেছে। মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীও এই তালিকায় রয়েছে। তবে ভারত সরকার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়নি বলে জানিয়েছে হিউমান রাইটস ওয়াচ। এই সংখ্যা তারা পেয়েছে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ বা বিজিবির দেওয়া তথ্য থেকে।

হিউমান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলছেন, ভারতীয় নাগরিকসহ বাঙালি মুসলিমদের দেশ থেকে যথেচ্ছভাবে বিতাড়িত করে দিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি বৈষম্য তৈরি করছে।

কী আছে প্রতিবেদনে?
এই প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য জুন মাসে ১৮ জনের সাক্ষাতকার নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এদের মধ্যে এমন মানুষও ছিলেন যারা নিজেরাই এই প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছেন। অন্য ৯টি এমন সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগীদের পরিবারের ব্যক্তিরা কথা বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে।

যাদের সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে এমন ভারতীয় নাগরিকও আছেন যারা বাংলাদেশে বিতাড়িত হওয়ার পরে আবারও ভারতে ফিরে এসেছেন এবং আটক হওয়ার পরে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন, এমন কয়েকজনের পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেছে এই মানবাধিকার সংগঠন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে এসব সাক্ষাতকারের বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। এ ধরনের অনেক সাক্ষাতকার বিবিসি বাংলা এরই মধ্যে সম্প্রচার ও প্রকাশ করেছে। যাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশই আসাম আর পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক এবং তারা বাংলাভাষী মুসলিম। এ বিষয়টি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বার বারই উঠে এসেছে।

জুলাই মাসের ৮ তারিখ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রাপ্ত তথ্যাবলী দিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল, তবে এর কোনো জবাব আসেনি।

সংগঠনটি জানিয়েছে, আসাম, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িষ্যা আর রাজস্থানের বিজেপিশাসিত সরকার মুসলিমদের আটক করছে। এদের বেশিরভাগই গরীব, পরিযায়ী শ্রমিক। আটক করার পরে এদের ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

কিছু ক্ষেত্রে সীমান্তরক্ষীরা আটক হওয়া ব্যক্তিদের মারধর করেছে এবং যথাযথ ভাবে তাদের নাগরিকত্ব যাচাই না করেই জোর করে বাংলাদেশ সীমান্ত পার করতে বাধ্য করছে। সীমান্ত পার করে দেওয়ার পরে নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পেরেছেন এমন ডজন-খানেক মানুষকে ভারত আবারও ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে এই মানবাধিকার সংগঠন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে গত এপ্রিলে হিন্দু পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পরেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুসলিমদের হেনস্থা করা শুরু করে পুলিশ, ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ অগ্রাহ্য করে, ফোন-নথি এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সামগ্রী কেড়ে নেওয়া হয় যাতে আটক হওয়া ব্যক্তিরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও না করতে পারে।

মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ কয়েক দশক ধরে চলছে, কিন্তু এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। আবার রাজনৈতিক কারণে কখনো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয় বলেও মন্তব্য করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

বেআইনিভাবে রোহিঙ্গা আর পরিযায়ী শ্রমিকদের বিতাড়ন
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করছে যে, বাংলাদেশ থেকে যারা বেআইনিভাবে ভারতে প্রবেশ করেছেন, তাদেরই বিতাড়িত করা হচ্ছে। যাদের বিতাড়ন করা হয়েছে, এরকম অনেকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তারা বাংলাদেশি নাগরিক, কিন্তু বহু মানুষ বলেছেন যে তারা বাংলাদেশি নন। সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না যাওয়ায় অনেক ভারতীয় নাগরিক– যাদের বেশিরভাগই বাংলাভাষী মুসলিম এমন লোকজনকে বেআইনি ভাবে বিতাড়িত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার বারবার বলেছে প্রত্যর্পণের যে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি আছে, তা লঙ্ঘন করছে ভারত সরকারের এই একতরফা সিদ্ধান্ত। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশ আহ্বান জানিয়েছে, স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে প্রক্রিয়া আছে, যার ওপরে নজর রাখা যাবে এমন পদ্ধতি যাতে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ৮ মে ভারত সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বলেছিল এই তথাকথিত পুশ-ইন মেনে নেওয়া যায় না। সে সময় ঢাকা জানিয়েছিল যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশি নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং যাদের সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যর্পণ করা হবে, এমন ব্যক্তিদেরই তারা ফিরিয়ে নেবে।

ওই মাসেই ভারত সরকার প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও আসামের একটি ডিটেনশন সেন্টার থেকে বিতাড়িত করে দেয় বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দফতরকে উদ্ধৃত করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, অন্য ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারের কাছে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে জোর করে। তাদের শুধু লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সাঁতরে সমুদ্র পার হকে বলা হয়েছিল। এই ঘটনাকে মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুস ‘মানবিক শালীনতার অবমাননা” বলে বর্ণনা করেছেন।

অ্যান্ড্রুসকে উদ্ধৃত করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, ওই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি ‘ননরিফাউলমেন্ট’ নীতির ‘গুরুতর লঙ্ঘন’। এই আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে এমন জায়গায় ফেরত পাঠানো যায় না, যেখানে তার জীবন ও স্বাধীনতা ঝুঁকির মুখে পড়বে।

এই ঘটনা নিয়ে ভারতের শীর্ষ আদালতে মামলা হলে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য এটিকে ‘সুন্দর সাজানো কাহিনী’ বলে বর্ণনা করে। ওই অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই বলেও মন্তব্য করেছিল শীর্ষ আদালত। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘কেন্দ্রীয় সরকার এই ঘটনা কিন্তু অস্বীকারও করেনি।’

ভারতকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরামর্শ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি মনে করিয়ে দিয়েছে যে, সব ধরনের জাতিগত বৈষম্য নিবারণে আন্তর্জাতিক কনভেনশন, বেসামরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী ভারত এটা সুনিশ্চিত করতে বাধ্য- যাতে প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং জাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির ভিত্তিতে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত না হয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনটিতে মূলত নজর দেওয়া হয়েছে যেসব মানুষকে বাংলাদেশে ‘বিতাড়ন’ করা হয়েছে, তাদের ওপরে। তবে বিবিসি বাংলা নিয়মিতই প্রতিবেদন প্রকাশ করছে যে বহু মানুষকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আইনজীবীদের ভাষায় ‘বেআইনি’ভাবে আটক করে রাখা হচ্ছে পরিচয় যাচাইয়ের নাম করে।

বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে যে, ভারতের পরিচয়পত্র দেখানোর পরেও সেসব যাচাই করিয়ে আনা হচ্ছে তাদের আদি বাড়ি যে রাজ্যে সেখানকার থানা থেকে। এই প্রক্রিয়ায় কখনও দুই, তিন, চার এমনকি ছয়দিন পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে আর এই পুরো সময়টা আটক করে রাখা হচ্ছে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা কিছু ডিটেনশন সেন্টারে।

গত তিন চার দিনে দিল্লি এবং হরিয়ানার গুরুগ্রামের অনেক ঘটনা বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে। তবে ভারত সরকার অবশ্য গত দুই-তিন মাসে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা নাগরিকদের ‘বিতাড়ন’ করা নিয়ে কোনো কথাই বলেনি।

বিচ্ছিন্নভাবে অবশ্য ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ভারতে থাকার অধিকার নেই’, এরকম মানুষের নাম ‘কেন ভারতের ভোটার তালিকায় থাকবে’ ইত্যাদি মন্তব্য করেছেন সরকারি মন্ত্রী-আমলারা।

অন্যদিকে বাংলাদেশ যে পুশ ইন-এর অভিযোগ করে, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়টি স্বীকার করে না। তারা বলে থাকে এধরনের কোনো শব্দ তাদের কর্মপদ্ধতিতে নেই।

কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএসএফ কর্মকর্তারা গত কয়েক মাসে বিবিসিকে বলেছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে এত বেশি সংখ্যায় অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ছে বিভিন্ন রাজ্যে, তাদের কারাগারে আটকে রাখতে গেলে সব জেল খালি করে দিতে হবে।

আবার প্রত্যর্পণের যে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি আছে, সেটা মেনে চলতে গেলে ভারত আর বাংলাদেশ দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব একাধিক দফতরের মাধ্যমে পরিচয় যাচাই করার যে পদ্ধতি, তাতেও দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তাই পুশ ইন করার পদ্ধতি তারা গ্রহণ করছেন, এই বক্তব্য বিএসএফ কর্মকর্তাদের।

তবে যেসব ক্ষেত্রে ভুল করে ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাদের অনেককে আবার ফিরিয়েও এনেছে সরকার, এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন ভারতীয় কর্মকর্তারা।

 

ডিএস./

 

জনপ্রিয়

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন

শত শত মুসলিমকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে ভারত

প্রকাশিত : ১২:৩২:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ জুলাই ২০২৫

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ভারত কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই অবৈধভাবে দেশটি থেকে শত শত বাংলাভাষী মুসলিমকে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। ভারতের দাবি, যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে তারা সবাই অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু তাদের এসব দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া এদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নাগরিক। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ নিয়ে এক বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসের ৭ তারিখ থেকে জুনের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ভারত দেড় হাজারেরও বেশি মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুকে বাংলাদেশে বিতাড়িত করেছে। মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীও এই তালিকায় রয়েছে। তবে ভারত সরকার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য দেয়নি বলে জানিয়েছে হিউমান রাইটস ওয়াচ। এই সংখ্যা তারা পেয়েছে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ বা বিজিবির দেওয়া তথ্য থেকে।

হিউমান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলছেন, ভারতীয় নাগরিকসহ বাঙালি মুসলিমদের দেশ থেকে যথেচ্ছভাবে বিতাড়িত করে দিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি বৈষম্য তৈরি করছে।

কী আছে প্রতিবেদনে?
এই প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য জুন মাসে ১৮ জনের সাক্ষাতকার নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এদের মধ্যে এমন মানুষও ছিলেন যারা নিজেরাই এই প্রক্রিয়ার শিকার হয়েছেন। অন্য ৯টি এমন সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগীদের পরিবারের ব্যক্তিরা কথা বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে।

যাদের সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে এমন ভারতীয় নাগরিকও আছেন যারা বাংলাদেশে বিতাড়িত হওয়ার পরে আবারও ভারতে ফিরে এসেছেন এবং আটক হওয়ার পরে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন, এমন কয়েকজনের পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেছে এই মানবাধিকার সংগঠন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে এসব সাক্ষাতকারের বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। এ ধরনের অনেক সাক্ষাতকার বিবিসি বাংলা এরই মধ্যে সম্প্রচার ও প্রকাশ করেছে। যাদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশই আসাম আর পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক এবং তারা বাংলাভাষী মুসলিম। এ বিষয়টি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বার বারই উঠে এসেছে।

জুলাই মাসের ৮ তারিখ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রাপ্ত তথ্যাবলী দিয়ে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিল, তবে এর কোনো জবাব আসেনি।

সংগঠনটি জানিয়েছে, আসাম, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িষ্যা আর রাজস্থানের বিজেপিশাসিত সরকার মুসলিমদের আটক করছে। এদের বেশিরভাগই গরীব, পরিযায়ী শ্রমিক। আটক করার পরে এদের ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

কিছু ক্ষেত্রে সীমান্তরক্ষীরা আটক হওয়া ব্যক্তিদের মারধর করেছে এবং যথাযথ ভাবে তাদের নাগরিকত্ব যাচাই না করেই জোর করে বাংলাদেশ সীমান্ত পার করতে বাধ্য করছে। সীমান্ত পার করে দেওয়ার পরে নিজেদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পেরেছেন এমন ডজন-খানেক মানুষকে ভারত আবারও ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে এই মানবাধিকার সংগঠন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে গত এপ্রিলে হিন্দু পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার পরেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুসলিমদের হেনস্থা করা শুরু করে পুলিশ, ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ অগ্রাহ্য করে, ফোন-নথি এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সামগ্রী কেড়ে নেওয়া হয় যাতে আটক হওয়া ব্যক্তিরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও না করতে পারে।

মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ কয়েক দশক ধরে চলছে, কিন্তু এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। আবার রাজনৈতিক কারণে কখনো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয় বলেও মন্তব্য করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

বেআইনিভাবে রোহিঙ্গা আর পরিযায়ী শ্রমিকদের বিতাড়ন
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবি করছে যে, বাংলাদেশ থেকে যারা বেআইনিভাবে ভারতে প্রবেশ করেছেন, তাদেরই বিতাড়িত করা হচ্ছে। যাদের বিতাড়ন করা হয়েছে, এরকম অনেকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তারা বাংলাদেশি নাগরিক, কিন্তু বহু মানুষ বলেছেন যে তারা বাংলাদেশি নন। সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না যাওয়ায় অনেক ভারতীয় নাগরিক– যাদের বেশিরভাগই বাংলাভাষী মুসলিম এমন লোকজনকে বেআইনি ভাবে বিতাড়িত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার বারবার বলেছে প্রত্যর্পণের যে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি আছে, তা লঙ্ঘন করছে ভারত সরকারের এই একতরফা সিদ্ধান্ত। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশ আহ্বান জানিয়েছে, স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে প্রক্রিয়া আছে, যার ওপরে নজর রাখা যাবে এমন পদ্ধতি যাতে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ৮ মে ভারত সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বলেছিল এই তথাকথিত পুশ-ইন মেনে নেওয়া যায় না। সে সময় ঢাকা জানিয়েছিল যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশি নাগরিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে এবং যাদের সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যর্পণ করা হবে, এমন ব্যক্তিদেরই তারা ফিরিয়ে নেবে।

ওই মাসেই ভারত সরকার প্রায় ১০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও আসামের একটি ডিটেনশন সেন্টার থেকে বিতাড়িত করে দেয় বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দফতরকে উদ্ধৃত করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, অন্য ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারের কাছে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে জোর করে। তাদের শুধু লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সাঁতরে সমুদ্র পার হকে বলা হয়েছিল। এই ঘটনাকে মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুস ‘মানবিক শালীনতার অবমাননা” বলে বর্ণনা করেছেন।

অ্যান্ড্রুসকে উদ্ধৃত করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, ওই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি ‘ননরিফাউলমেন্ট’ নীতির ‘গুরুতর লঙ্ঘন’। এই আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে এমন জায়গায় ফেরত পাঠানো যায় না, যেখানে তার জীবন ও স্বাধীনতা ঝুঁকির মুখে পড়বে।

এই ঘটনা নিয়ে ভারতের শীর্ষ আদালতে মামলা হলে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য এটিকে ‘সুন্দর সাজানো কাহিনী’ বলে বর্ণনা করে। ওই অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই বলেও মন্তব্য করেছিল শীর্ষ আদালত। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘কেন্দ্রীয় সরকার এই ঘটনা কিন্তু অস্বীকারও করেনি।’

ভারতকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরামর্শ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি মনে করিয়ে দিয়েছে যে, সব ধরনের জাতিগত বৈষম্য নিবারণে আন্তর্জাতিক কনভেনশন, বেসামরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী ভারত এটা সুনিশ্চিত করতে বাধ্য- যাতে প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং জাতি, বর্ণ, বংশ ইত্যাদির ভিত্তিতে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত না হয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনটিতে মূলত নজর দেওয়া হয়েছে যেসব মানুষকে বাংলাদেশে ‘বিতাড়ন’ করা হয়েছে, তাদের ওপরে। তবে বিবিসি বাংলা নিয়মিতই প্রতিবেদন প্রকাশ করছে যে বহু মানুষকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আইনজীবীদের ভাষায় ‘বেআইনি’ভাবে আটক করে রাখা হচ্ছে পরিচয় যাচাইয়ের নাম করে।

বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে যে, ভারতের পরিচয়পত্র দেখানোর পরেও সেসব যাচাই করিয়ে আনা হচ্ছে তাদের আদি বাড়ি যে রাজ্যে সেখানকার থানা থেকে। এই প্রক্রিয়ায় কখনও দুই, তিন, চার এমনকি ছয়দিন পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে আর এই পুরো সময়টা আটক করে রাখা হচ্ছে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা কিছু ডিটেনশন সেন্টারে।

গত তিন চার দিনে দিল্লি এবং হরিয়ানার গুরুগ্রামের অনেক ঘটনা বিবিসি বাংলা জানতে পেরেছে। তবে ভারত সরকার অবশ্য গত দুই-তিন মাসে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা নাগরিকদের ‘বিতাড়ন’ করা নিয়ে কোনো কথাই বলেনি।

বিচ্ছিন্নভাবে অবশ্য ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ভারতে থাকার অধিকার নেই’, এরকম মানুষের নাম ‘কেন ভারতের ভোটার তালিকায় থাকবে’ ইত্যাদি মন্তব্য করেছেন সরকারি মন্ত্রী-আমলারা।

অন্যদিকে বাংলাদেশ যে পুশ ইন-এর অভিযোগ করে, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়টি স্বীকার করে না। তারা বলে থাকে এধরনের কোনো শব্দ তাদের কর্মপদ্ধতিতে নেই।

কিন্তু অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএসএফ কর্মকর্তারা গত কয়েক মাসে বিবিসিকে বলেছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে এত বেশি সংখ্যায় অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ছে বিভিন্ন রাজ্যে, তাদের কারাগারে আটকে রাখতে গেলে সব জেল খালি করে দিতে হবে।

আবার প্রত্যর্পণের যে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি আছে, সেটা মেনে চলতে গেলে ভারত আর বাংলাদেশ দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব একাধিক দফতরের মাধ্যমে পরিচয় যাচাই করার যে পদ্ধতি, তাতেও দীর্ঘ সময় লেগে যায়। তাই পুশ ইন করার পদ্ধতি তারা গ্রহণ করছেন, এই বক্তব্য বিএসএফ কর্মকর্তাদের।

তবে যেসব ক্ষেত্রে ভুল করে ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে তাদের অনেককে আবার ফিরিয়েও এনেছে সরকার, এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন ভারতীয় কর্মকর্তারা।

 

ডিএস./